দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ, যারা শোক জানাতে এসেছিলেন তাদের পরিবহণের জন্য ভুয়া অর্থব্যয়ের হিসেব দেখানো হয়েছে। এ অভিযোগে দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এক প্রতিবেদনে এখবর নিশ্চিত করেছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি।
গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ইস্টার্ন কেপ প্রদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস এর নামকরা সব সদস্যরা রয়েছেন। তারা অবশ্য এই অভিযোগের বিষয়ে কোন মন্তব্য করেননি। আইনজীবীরা তাদেরকে দুর্নীতি এবং মানি লন্ডারিং এর দায়ে অভিযুক্ত করেছেন। অর্থমূল্যে যার পরিমাণ প্রায় সাত লাখ ডলার।
২০১৪ সালে প্রথম এই দুর্নীতির অভিযোগগুলো উঠতে থাকে। ইস্টার্ন কেপ এর কুনুতে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ম্যান্ডেলার সেই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় বিশ্বের নানা দেশ থেকে রাষ্ট্রপ্রধানরা আসেন। আইনজীবীদের অভিযোগ, যারা শোক জানাতে এসেছিলেন তাদের পরিবহণের জন্য ভুয়া অর্থব্যয়ের হিসেবে দেখানো হয়েছে। একই সঙ্গে ইস্ট লন্ডনে যেসব ভেন্যুতে স্মরণ-সভার আয়োজন করা হয়েছিল সেখানেও একই রকম অভিযোগ উঠেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বর্ণবাদ-বিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা মৃত্যুতে গোটা দক্ষিণ আফ্রিকা জুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে এ ধরণের দুনীতি এবং জালিয়াতির খবর অনেককেই হতবাক করেছে।
ম্যান্ডেলার ৯৫ বছরের জীবনের দীর্ঘ ২৭টি বছরই কেটেছে নিপীড়ক শাসকের কারা প্রকোষ্ঠে। ১৯৪৪ সালে তিনি যোগ দেন কৃষ্ণাঙ্গ মুক্তি সংগঠন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে (এএনসি)। শ্বেতাঙ্গ শাসকদের বর্ণবাদী নীতির বিরুদ্ধে এএনসির সংগ্রামের মূল আদর্শ ছিল ‘সাদা-কালো ভেদাভেদ নেই, সব মানুষের সমান অধিকার’। সুদীর্ঘ সেই সংগ্রামের পদে পদে ম্যান্ডেলা নিগৃহীত ও নিপীড়িত হয়েছেন। প্রথমে তাদের আন্দোলন ছিল অহিংস। কিন্তু ১৯৬০ সালে শার্পভিলে নিরীহ কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর সরকারি বাহিনীর গণহত্যা ও এএনসিকে নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করার পর তারা অহিংস নীতি পরিত্যাগ করেন। ১৯৬২ সালে ম্যান্ডেলা ও তার কয়েকজন সহযোদ্ধাকে গ্রেপ্তার করে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৬৪ সালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে পাঠানো হয় রবেন দ্বীপের কারাগারে। দীর্ঘ ২৭ বছর কারাভোগের পর ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি মুক্তি পান।
কিন্তু ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে এএনসি প্রতিশোধের পথে না গিয়ে শান্তি ও সমঝোতার পথে অগ্রসর হয়। ডব্লিউ ডি ক্লার্কের সরকারের সঙ্গে মিলে বর্ণবাদের অবসান ঘটিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় সর্বজনীন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৯৩ সালে তারা যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। ১৯৯৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন তিনি। ১৯৯৪ সালের এপ্রিলে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম সর্বজনীন সাধারণ নির্বাচনে এএনসি ও নেলসন ম্যান্ডেলা বিজয়ী হয়ে দেশটির প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি গঠন করেন ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’, যা বর্ণবাদী সময়ের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর তদন্ত ও অনুসন্ধান করে। ১৯৯৬ সালে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনার তত্ত্বাবধান করেন। ১৯৯৯ সালের নির্বাচনে তিনি দ্বিতীয়বারে মতো অংশ না নিয়ে রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
২০১৩ সালে পৃথিবী তার সর্বকালের সেরা সন্তানদের একজনকে হারায়। ওই বছরের৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শান্তি, সমঝোতা ও মিলনের প্রতীক, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। মৃত্যুর দশদিন পর দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তীসম বর্ণবাদ বিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে সমাহিত করা হয়। ইস্টার্ন কেপ প্রদেশের কুনু নামের যে গ্রামে তার শৈশব কেটেছে, সেখানকার পারিবারিক এক কবরস্থানে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। বিশ্বের নানা দেশ থেকে রাষ্ট্রপ্রধানরাসহ হাজার চারেক লোক এই শেষকৃত্যে যোগ দিয়েছিলেন।
এসডব্লিউ/বিবিসি/কেএইচ/১৯৪৭
আপনার মতামত জানানঃ