
ভারতের উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলায় জোশিমঠে হিমবাহ ভেঙে ভয়াবহ তুষারধসের ঘটনা ঘটেছে। এতে একশর’ বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে অফিশিয়ালি এপর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১৪ জন বলে জানা গেছে এবং নিখোঁজের তালিকায় রয়েছে ১৭০ জন। ভয়াবহ এই তুষার ধ্বসে প্রবল জলোচ্ছ্বাসে একের পর এক গ্রাম ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক হতে পারে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে আশপাশের গ্রাম খালি করে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন জেলা প্রশাসক৷ জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে এমনটি ঘটেছে।
ভারতীয় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, রোববার সকালে তুষারধসের জেরে অলকানন্দা ও ধৌলিগঙ্গা নদীর জলস্তর প্রবলভাবে বেড়ে যায়। এতে তীব্র জলোচ্ছ্বাসে বহু গ্রাম ভেসে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিধ্বস্ত উত্তরাখণ্ডের বিভিন্ন জেলায় সতর্কতা জারি করেছে সরকার।
এক ভিডিওতে দেখা গেছে, বাধভাঙা পানি গঙ্গার দু’পাশের বাড়ি ঘর ভেঙে তীব্র গতিতে এগোচ্ছে। হতাহতের আশঙ্কা করে খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে ভারত-তিব্বত সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ১০০ জনের উদ্ধারকারী দল। চামোলি থেকে ঋষিকেশ যাওয়ার রাস্তায় ইতিমধ্যেই জারি হয়েছে লাল সতর্কতা।
ধসের কারণে ধউলিগঙ্গার দু’পাশের গ্রাম খালি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে পাওয়া খবর অনুযায়ী, তপোবনের কাছে নন্দাদেবী হিমবাহে ফাটল ধরায় ঋষিগঙ্গা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের আংশিক ক্ষতি হয়েছে বলে অনুমাণ।
উত্তরাখণ্ডের চামোলি থানার পুলিশ জানিয়েছে, অলকানন্দা নদীর তীরে যে বসতিগুলি রয়েছে, ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে সেই জায়গাগুলিকেও খালি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভাগিরথী নদীর গতিপথ বন্ধ করা হয়েছে।
শুধু উত্তরাখণ্ড নয়, উত্তরপ্রদেশের গঙ্গার দু’পারেও জারি করা হয়েছে চূড়ান্ত সতর্কতা। ঘটনায় আটকে পড়েছেন বহু পর্যটক। শ্রীনগর ও ঋষিকেশ বাধের লাগোয়া অঞ্চল খালি করে দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে হিমবাহ ধসের কারণে তপোবনে হাইড্রো বিদ্যুত্ প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখানে ১৫০ জনের বেশি কর্মী কর্মরত ছিলেন। তবে এই ঘটনার পর থেকে দেড়শো জন কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। তাদের উদ্ধার কাজ চলছে।
নিখোঁজ শ্রমিকরা তপোবন পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পে কাজ করছিলেন। প্রশাসনের আশঙ্কা তাদের কেউই হয়তো বেঁচে নেই। সংবাদসংস্থা এএনআইকে উত্তরাখাণ্ডের মুখ্যসচিব ওম প্রকাশ বলেন, আটকে পড়া পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পের অনেকেই পানির তোড়ে ভেসে গিয়ে থাকতে পারেন। নিহত এবং আহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋষিগঙ্গা জলবিদ্যুত প্রকল্পও তুষারধসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তুষারধসের সময় ১৫০ জন শ্রমিক সেখানে কাজ করছিলেন। তারা এখনও নিখোঁজ রয়েছেন।
স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, এই ঘটনা এত দ্রুত ঘটেছে যে কাউকে সতর্ক করার সময়ও পাওয়া যায়নি। ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে গেছেন। তিনি বলেন, আমাদের কোনো ধারণা নেই যে কতজন নিখোঁজ রয়েছে।
ধারণা করা হয়েছে যে, অলকা নদীতে আরও পানি ঢুকবে এবং তীরবর্তী এলাকাগুলো তলিয়ে যাবে। একইসাথে হুমকির মুখে পড়বে হাইড্রো প্রকল্পগুলো। ভারত আবহাওয়া অধিদফতর বলেছে যে, বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস নেই। তবে কেন্দ্রীয় পানি কমিশনের আধিকারিকরা ইতিমধ্যে বলেছিলেন হিমবাহ ফেটে বন্যা শুরু হয়েছে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণেই এই তুষার ধসের ঘটনা ঘটেছে।
জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত জাতিসংঘ আন্তঃসরকারী প্যানেলের সর্বশেষ মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুসারে, হিমবাহের ক্রমাগত অবনতি এবং ভূগর্ভস্থ হিমায়িত অঞ্চলে গলন শুরু হলে পাহাড়ের স্লোপগুলোর স্থায়িত্ব হ্রাস পেতে থাকে এবং এতে হিমবাহের হ্রদের সংখ্যা ও ক্ষেত্র বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।
বলা হচ্ছে যে, আসন্ন দশকগুলোতে হিমবাহ হ্রদের সংখ্যা এবং বেশিরভাগ অঞ্চলে ক্রমাগত বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। নতুন এই হ্রদগুলি খাড়া এবং সম্ভাব্য অস্থিতিশীল পর্বত প্রাচীরের নিকটে বিকাশ লাভ করবে। যেখানে হ্রদ প্রবাহগুলি আরও সহজেই গতিময় হতে পারে।
আইআইটি ইন্দোরের গ্লেসিওলজি অ্যান্ড হাইড্রোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফারুক আযম বলেছেন, এ জাতীয় বরফ ফেটে যাওয়া ‘অত্যন্ত বিরল ঘটনা’।
তিনি বলেন, স্যাটেলাইট এবং গুগল আর্থের ছবিতে অঞ্চলের কাছাকাছি কোনও হিমবাহ লেক দেখা যায় না, তবে এই অঞ্চলে জলের পকেট থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। হিমবাহের অভ্যন্তরে থাকা জলের এই পকেট থেকেই এই ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। এটা নিশ্চিত করে জানতে আমাদের বিশ্লেষণ, আবহাওয়া প্রতিবেদন ও ডাটা প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তুষারপাত ও বৃষ্টিপাতের মতো অন্যান্য আবহাওয়ার নিদর্শনগুলোকে প্রভাবিত করছে। উষ্ণতার কারণেই প্রচুর পরিমাণে তুষার গলে যাচ্ছে বলে মনে করেন তারা। তারা বলেন, বরফ অঞ্চলের উপরিভাগের তাপমাত্রা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। আগে তাপমাত্রা মাইনাস ৬ থেকে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ছিল, এখন সেটা বাড়তে বাড়তে মাইনাস ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছে। এর ফলে অত্র অঞ্চলে বরফ গলে যাওয়ার জন্য আরো সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে।
পৃথিবীর এখন সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। যে গতিতে জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে তাতে অচিরেই পৃথিবীর কোনো কোনো দেশ ভয়াবহ সংকটে পড়তে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবেও অধিকাংশ দেশের জন্য হুমকি। বিশেষ কোনো দেশ বা জনগোষ্ঠী নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের মুখে পড়েছে সারা বিশ্বের মানুষ৷ বিশেষত গত ২০ বছরে এই প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা থেকে অ্যামেরিকা মহাদেশেও৷ মানুষের বিভিন্ন কাজকর্ম জলবায়ুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাই বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষের তৈরি কারণগুলোই বেশি দায়ী।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের নেপথ্যে মানুষের কাজকর্মের প্রভাব প্রতিবছর বাড়ছে। কিন্তু আবহাওয়ায় উষ্ণতা, আর্দ্রতা ও শীতলতার তীব্রতা কতটা বাড়বে—এখন পর্যন্ত সেসব বিষয় মূল্যায়নের ঘাটতি রয়েছে।
তারা বলেন, অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে মানুষের অকালমৃত্যুর ঝুঁকি ইতিমধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এটি ভবিষ্যতে আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশের সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। কেবল বৈশ্বিক উষ্ণতার গতি কমালেই হবে না, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে আসন্ন ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সবাইকে প্রস্তুত করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২১
আপনার মতামত জানানঃ