কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নান তার স্ত্রীর নামে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণের কাজ শুরু করেন। স্বাস্থ্য সচিবের পরিবারের দেওয়া জমিতে এই কমিউনিটি ক্লিনিকটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এ ক্লিনিক নির্মাণে সব ধরনের সহযোগিতা এমনকি দেখভাল করছেন স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নান। এ ক্লিনিক নির্মাণ বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যকে অবগত করা হয়নি কেনো এই অভিযোগে গতকাল শনিবার দুপুরে এমপির অনুগত লোকজন স্বাস্থ্য সচিবের ওপর হামলা করেন। এ সময় সচিবের বাড়িতে অবস্থানরত এসিল্যান্ড ঘটনা জানতে চাইলে তার ওপরেও হামলা করা হয় বলে অভিযোগ। স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নানের অভিযোগ, বর্তমান এমপি নূর মোহাম্মদের নির্দেশে তার লোকজন নির্মানাধীন একটি কমিউনিটি ক্লিনিকের নির্মাণ কাজে হামলা ও ভাংচুর করে।
স্বাস্থ্যসচিবের অভিযোগ, তাদের জমিতে কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে স্থানীয় সাংসদ নূর মোহাম্মদের অনুসারীরা এই হামলা চালায়। তিনি বলেন, “আমি আমার বাড়ির কাছে আমার প্রয়াত স্ত্রীর নামে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক ও ছোট একটি রাস্তা নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু কিছু লোক বাধা দিচ্ছে। তারা বলছে, এমপি সাহেবের নির্দেশ ছাড়া এই কাজ হবে না। তারা আজ হামলা চালিয়েছে।”
তিনি বলেন, স্থানীয় (কিশোরগঞ্জ-২, কটিয়াদী-পাকুন্দিয়া আসনের) সংসদ সদস্য সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ-এর নির্দেশে তার লোকজন ভাঙচুর, মারপিট ও হুমকিসহ এই তাণ্ডব চালিয়েছে। এমন অসহায় পরিস্থিতির মুখোমুখি কোনোদিন তাকে হতে হয়নি বলেও জানান তিনি।
প্রত্যক্ষদর্শী ও এলাকাবাসীর সূত্রে জানা যায়, স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নান এবং পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) সাংসদ নূর মোহাম্মদের বাড়ি একই গ্রামে। স্বাস্থ্য সচিবের পরিবারের সদস্যদের দেওয়া জায়গায় তার মায়ের নামে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করা হচ্ছে। ক্লিনিক নির্মাণে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা দিচ্ছেন স্বাস্থ্য সচিব। ক্লিনিকটি নির্মাণের বিষয়ে সাংসদকে অবহিত করা হয়নি বলে অভিযোগ তার অনুগতদের।
এ নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই দু’পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা চলছিল। রবিবার কিশোরগঞ্জে সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল পরিদর্শন উপলক্ষে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য সচিব গ্রামের বাড়িতে যান। পরে গতকাল বেলা ১১টার দিকে বাড়ির পাশের নির্মাণাধীন ক্লিনিকের কাজ দেখতে যান সচিব। এ সময় ক্লিনিকে যাতায়াতের রাস্তাটি অন্যের জায়গায় তৈরি করা হচ্ছে অভিযোগ তুলে ২০ থেকে ২৫ জন লোক গিয়ে নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার দাবি জানায়। এ নিয়ে সচিবের সঙ্গে তাদের কথাকাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে তারা চলে যায়।
এরপর দুপুর একটার দিকে কয়েকটি অটোরিকশা ও মাইক্রোবাসে করে নির্মাণাধীন ক্লিনিকের সামনে শতাধিক লোক যায়। তাদের হাতে লাঠি ও ধারালো অস্ত্র ছিল। এ সময় তারা সচিবের নাম ধরে ক্লিনিকের সামনে দাঁড়িয়ে গালিগালাজের পাশাপাশি নির্মাণকাজ বন্ধ রাখতে বলে।
সচিব বাড়িতে আসার পর থেকে তার সঙ্গে সেখানে অবস্থান করছিলেন এসিল্যান্ড আশরাফুল আলম। তিনি বাড়ির বাইরে আসামাত্র তাকে মারধর শুরু করে হামলাকারীরা। একপর্যায়ে তাকে পাশের পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়। পরে এলাকার মানুষ তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। এরপর হামলাকারীরা ক্লিনিকের নির্মাণশ্রমিকদের মারধর করে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্য সচিবের বাড়িতেও হামলা চালায়। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে ঘটনাস্থলে যায় র্যাব সদস্যরা। হামলার পর এলাকায় উত্তেজনা দেখা দেওয়ায় সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, একটি কমিউনিটি ক্লিনিকের রাস্তা নির্মাণকে কেন্দ্র করে স্বাস্থ্যসচিব মো. আ. মান্নানের গ্রামের বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ সময় দুই পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় এসিল্যান্ডসহ বেশ কয়েকজন আহত হন।
আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারে সচিব মো. আবদুল মান্নান তার অসহায়ত্বের বর্ণনা দিয়ে বলেন, প্রথম ১০/১৫ জনের যে দলটি এসেছিল তাদেরকে ‘আমি বলি কমিউনিটি ক্লিনিক হচ্ছে, রাস্তা হচ্ছে। এসব কাজ জনগণের উপকারের জন্য করা হচ্ছে। আমরা ভূমি দিয়েছি। সরকার টাকা দিচ্ছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী অবগত আছেন। জনগণের কাজ তোমরা বন্ধ করে দেবে কেন? এ সময় তারা বলেন, ভালো কাজ হচ্ছে বলেই তো চাঁদা দিতে হচ্ছে না। এখন এমপি সাহেব নির্দেশ দিয়েছেন কাজ বন্ধ থাকবে। তাই কাজ বন্ধ করতে এসেছি। এর কিছুক্ষণ পর ৬০/৭০ জনের সন্ত্রাসী দল এসে এলোপাতাড়ি মারপিট শুরু করে। তাদের হাতে আহত হন এসিল্যান্ড, প্রকৌশলীসহ ১০/১২ জন শ্রমিক।
তবে এমপি নূর মোহাম্মদ বলেছেন, এলাকায় এমন একটি উন্নয়ন কাজ হচ্ছে, সেটি জানতেন না। এলাকার লোকজন এ বিষয়ে সচিবের কাছে জানতে গেলে তার লোকজন খারাপ আচরণ করেন।
সংসদ সদস্য সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলেছেন, একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে সে ওয়াক্ফের জমি দখল করে, এলাকায় যা খুশি তা করে বেড়ায়। এমনকি অন্যের জমি দখল করে ও মাজারের জমি দখল করে সেখানে কমিউনিটি ক্লিনিক করছে। এসব ব্যাপারে লোকজন প্রশ্ন করলে কোনো উত্তর পায় না। এলাকার মানুষ তার অবজ্ঞা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হওয়ায় তারা রুখে দাঁড়িয়েছে। এর বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ঘটনাটি ঘটেছে। এলাকার এমপি হিসেবে এলাকাবাসীর এই কাজ পরোক্ষভাবে হলেও আমার ওপরই বর্তায়।
হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারী কমিশনার আশরাফুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, “আমি সচিব মহোদয়কে প্রটোকল দিতে ওখানে গিয়েছিলাম। হঠাৎ কিছু লোকজন রড, লোহার পাইপ ও দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে এসে হামলা করে। আমি বাইরে গিয়ে জানতে চাইলে তারা আমার উপর হামলা করে। আমার শরীরে আঘাত করে।”
বিকালে কটিয়াদী উপজেলা কোয়ার্টারে আহত সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আশরাফুল আলমের অবস্থার খোঁজ নিতে যান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আব্দুল্লাহ আল মাসউদ। তিনি জানান, এসিল্যান্ড আশরাফুল আলমকে রড দিয়ে পেটানো হয়েছে। এতে তার শরীরের মাংস থেঁতলে গেছে।
কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম ও পুলিশ সুপার মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম বলেন, এ হামলায় এসিল্যান্ড লাঞ্ছিত ও আহত হয়েছেন।
এদিকে শনিবারের হামলা, ভাঙচুরের ঘটনায় কটিয়াদী থানায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। শনিবার রাতে কটিয়াদী উপজেলার সহকারী কমিশনার ভূমি ও উপজেলা প্রকৌশলী বাদী হয়ে মামলা দুটি দায়ের করেন। রাতেই পুলিশ অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেফতার করেছে।
স্বাস্থ্য সচিবের বাড়িতে হামলার ঘটনায় এদিকে কটিয়াদী থানার ওসি এমএ জলিলকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
আজ রোববার সকালে তাকে প্রত্যাহার করে ঢাকা রেঞ্জে নেওয়া হয়। কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ-এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এলাকায় কোনো কাজ শুরু করলেই স্থানীয় সাংসদকে অবহিত করার বিষয়টি প্রচললিত। কথিত আছে, তাদের জানানোর অর্থ হলো নির্মাণ কাজটির বাজেট থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ তাদের দেওয়া। এটাকেই অন্যভাবে চাঁদাবাজি বলা হয়ে থাকে। স্বাস্থ্য সচিব নিজের জমির ওপর কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করছেন আর স্থানীয় সাংসদকে অবহিত করা হয় নাই, এতে সাংসদের স্থানীয় প্রভাব আর ক্ষমতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। তাই নিজের প্রভাব আর ক্ষমতা পরিদর্শনের স্বার্থে এবং একইসাথে নির্মাণ বাজেটের উল্লেখসংখ্যক পরিমাণ অর্থ নিজের পকেটে না আসাতে সমর্থক কিংবা দলীয় কর্মীদের মাধ্যমে এমনটি করে থাকতে পারেন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। ঘটনায় কেন্দ্রীয়ভাবে হস্তক্ষেপ কামনা করে তারা দাবি জানান, স্বাস্থ্যসচিব ও এসিল্যাণ্ডের ওপর হওয়া আক্রমণের সুষ্ঠু তদন্ত করে এর সুরাহা নিশ্চিত করা জরুরি। একইসাথে কমিউনিটি ক্লিনিক সম্পর্কিত কোনো অনিয়ম ঘটে থাকলে সেটাও যাচাইয়ের আওতায় আনার দাবি জানান তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৪০
আপনার মতামত জানানঃ