নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা: সেলিনা হায়াত আইভী ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে শত কোটি টাকার মূল্যের একটি মন্দিরের দেবোত্তর সম্পত্তি দখলের অভিযোগ রয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে এই সম্পত্তি দখলের পাঁয়তারা করে যাচ্ছেন বলে অনেকদিন ধরেই তার ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে এর প্রতিকার চেয়ে আসছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনসহ স্থানীয়রা। প্রতিকার না পেয়ে ইতোমধ্যে তারা প্রতিকি অনশন করেছেন। এবার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনসহ অন্যান্যরা প্রতিবাদী গণসমাবেশের আয়োজন করেন। গতকাল শনিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে জেলা হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যানারে নগরীর দেওভোগ জিউস পুকুর দীঘিরপাড়ে এই গণসমাবেশে অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে যেকোনো মূল্যে ‘জীবন দিয়ে হলেও’ মেয়র ও তার পরিবারের কবল থেকে ওই মন্দিরেরর সম্পত্তি উদ্ধারে কঠোর শপথ নেন প্রতিবাদকারীরা।
সমাবেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ছাড়াও এতে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন জেলার সব শ্রেণিপেশার প্রতিনিধিরাও। দেবোত্তর সম্পত্তি রক্ষার দাবিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের আয়োজিত এই গণসমাবেশের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে অংশ নেন জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ, জেলা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, বাংলাদেশ ইয়ার্ন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েন, বাংলাদেশ নিটিং ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, জেলা আইনজীবী সমিতি, নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন ও জনপ্রতিনিধিরা।
ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’ শ্লোগান নিয়ে আয়োজিত এই গণসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও নেপালের সাবেক রাষ্ট্রদূত ড. নিম চন্দ্র ভৌমিক। নিম চন্দ্র ভৌমিক বলেন, নারায়ণগঞ্জ নগরী স্থাপনের সময়কালে শ্রী ভিকন লাল ঠাকুর শহরের দেওভোগ আখড়া এলাকায় দেবতা লক্ষ্মীনারায়ণের নামে ‘শ্রী শ্রী রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর বিগ্রহ মন্দির’ প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরটির পাশে পূজা-অর্চনা ও আশপাশের অধিবাসীদের সুবিধায় ৩৬৭ শতাংশ জমির ওপর একটি পুকুর খনন করান, যা স্থানীয়দের কাছে জিউস পুকুর নামে পরিচিত। অথচ এই মন্দিরের সম্পত্তি এখন আইভী ও তার পরিবারের সদস্যরা ‘খেয়ে’ ফেলার চক্রান্ত করছে।
তিনি বলেন, মন্দির বা যেকোনো ধর্মীয় সম্পত্তি দখল করা দুর্বৃত্তদের কাজ। আমরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনায় ইতঃপূর্বে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্মারকলিপি দিয়েছি।
বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর উদ্দেশে বলেন, ‘স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি এখন ক্ষমতায় আছে। নৌকা মার্কা নিয়ে নিবার্চন করে ক্ষমতার মসনদ দখল করে হিন্দু সম্পত্তি দখল করে রাখবেন তা হবে না। দেবোত্তর সম্পত্তি কেনাবেচা হয় না। জাল দলিল করে আপনার পরিবারের সদস্যরা যদি কেউ জমির কাগজপত্র তৈরি করে থাকে তা আদালতে টিকবে না। মন্দিরের জমি মন্দিরকে ফিরিয়ে দিন।’
গণসমাবেশে প্রধান বক্তা ছিলেন বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শ্রী নির্মল চ্যাটার্জী। নির্মল চ্যাটার্জী বলেন, ভূমি জরিপের সিএস (ব্রিটিশ) পর্চায় এই বিশাল সম্পত্তি দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে রেকর্ডভুক্ত হয়েছে। জিয়াউর রহমানের আমল থেকে দেবোত্তর এই সম্পত্তি দখল করতে উঠেপড়ে লাগে মেয়র আইভীর পরিবার। যে নকল দলিল করে এই সম্পত্তি দখলের চেষ্টা করা হচ্ছে তাতে মেয়র আইভীর মা, দুই ভাই এবং আত্মীয়-স্বজনের নাম রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, শেখ হাসিনার নৌকার পাল বাতাসের অনুকূলে আছে। আর সেই নৌকা প্রতীক নিয়ে আইভী মেয়র হয়ে ভূমি দস্যুতা করবে সে।
এদিকে সমাবেশে আইভীর এসব বির্তকিত কর্মকাণ্ডে বিব্রত জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা প্রতিবাদ জানিয়ে উল্টো একের পর এক হয়রানিমূলক মামলা শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। ওই সময় সামবেশে আগতরা ক্ষোভে আইভীর নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে।
সমাবেশে আওয়ামী লীগ নেতারা আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, আইভীর এসব অপকর্মে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বিব্রত। মন্দির অথবা মসজিদের ওয়াকফাহ সম্পত্তি দখল বা অপসারণের নামে কোনো রকম দলীয় ইমেজ সংকটে ফেলতে দেবে না নেতা কর্মীরা। এ মর্মে সমাবেশে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মোবাকালে করার প্রস্তুতি নিতে সম্মত হয়।
নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহা বলেন, মন্দিরের সম্পত্তি দখলের বিষয়ে আইভী বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কথা বলায় মেয়র আইভী আমার বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে মামলা করেছেন। কয়েক দিন আগে হকার ইস্যু নিয়ে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। তিনি আসলে দলীয় লেবাসে মসজিদ-মন্দিরের সম্পত্তি দখল করে দলের ক্ষতি করার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন।
খোকন সাহা এ সময় মন্দিরের সম্পত্তির পক্ষে বেশ কয়েকটি দলিল দেখিয়ে বলেন, ভূমি জরিপের সিএস (ব্রিটিশ) পর্চায় এই বিশাল সম্পত্তি দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে রেকর্ডভুক্ত হয়। যা আইনে বিক্রি করার নিয়ম নেই। কিন্তু জিয়াউর রহমানের আমল থেকে দেবোত্তর এই সম্পত্তি দখল করতে উঠেপড়ে লাগে মেয়র আইভীর পরিবার। যে নকল দলিল করে এই সম্পত্তি দখলের চেষ্টা করা হচ্ছে তাতে মেয়র আইভীর মা, দুই ভাই এবং আত্মীয়-স্বজনের নাম রয়েছে।’
নারায়ণগঞ্জ একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির জেলা সভাপতি চন্দন শীল নিজের বক্তব্যে বলেন, ‘আমরা জানলাম মেয়র আইভী শুধু মন্দিরই নয় মসজিদের জায়গা অপসারণ ও মাদরাসা উচ্ছেদ করেছেন। নিজের পছন্দমতো মাসদাইর কবরস্থান মসজিদে ইমাম নিয়োগ দিয়েছেন। ডিআইটি মসজিদের খতিব নিজেও এসব বক্তব্য দিয়েছেন। আপনি আওয়ামী লীগ করে দলকে আর বিতকির্ত করবেন না।’
তবে এসব বিষয়ে সিটি মেয়র সেলিনা হায়াত আইভীকে গণমাধ্যমকর্মীরা ফোন দিলেও তিনি কোনো বক্তব্য দেবেন না বলে জানিয়ে দেন।
এর আগে জিউস পুকুর ও লক্ষীনারায়ণ আখড়া মন্দিরের এই দেবোত্তর সম্পত্তি রক্ষার দাবিতে গত ১১ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সামনে প্রথমবারের মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি পালন করে জেলা ও মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদ। কর্মসূচি শেষে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন সংগঠনটির নেতারা। পরবর্তীতে একই দাবিতে ২ ডিসেম্বর নগরীর চাষাড়ায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পালন করা হয় প্রতীকী অনশন। এ অনশনে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা অংশ নেন এবং এ দাবির প্রতি সংহতি জানান।
সংশ্লিষ্ট বিশিষজ্ঞরা বলেন, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করা নিয়ে এই অঞ্চলে যে তোড়জোড় লক্ষ্যণীয় ছিল, সেটা এখনো অব্যাহত আছে বিষয়টা লজ্জাজনক। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই হিন্দুদের সম্পত্তি দখলের অভিযোগ আসে। আর এসবের প্রায় সবই করে থাকেন স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা। বিগত বিএনপি-জামাত আমলে এর হার লক্ষ্যণীয় অবস্থানে চলে গিয়েছিল। একইসাথে বিষয়টি খুবই আতঙ্কের ছিল। আওয়ামী লীগ আসাতে হিন্দু সম্প্রদায় কিছুটা স্বস্থির নিঃশ্বাস ছাড়তে পারলেও এমনসব ঘটনা যখন পুনরাবৃত্তি হতে দেখেন তখন স্বাভাবিকভাবেই তারা অসহায় হয়ে পড়েন। আর সেটা যদি হয় আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা, তখন বিষয়টি আরো আতঙ্কের পর্যায়ে চলে যায়। মেয়র আইভি নারায়ণগঞ্জ এবং সর্বোপরী দেশের একজন বিদগ্ধ রাজনীতিবিদ। তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ একদিকে যেমন গ্রহণ করা যায় না, তেমনি সমাজে হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি ও মন্দির বিষয়ে সমাজে এক খারাপ বার্তা পৌঁছায়। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বিষয়টির সুরাহা প্রত্যাশা করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০৪
আপনার মতামত জানানঃ