নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুনের ৭ বছর পূর্ণ হলো আজ (২৭ এপ্রিল)। আলোচিত ওই সাত খুনের নৃশংসতা সারাদেশেই সাড়া ফেলেছিল। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও আলোচিত ছিল ইস্যুটি। তবে আলোচিত ওই হত্যাকাণ্ডের ৭ বছর পূর্ণ হলেও হত্যা মামলার রায় এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। আদালতের পরে হাইকোর্টে দ্রুত রায় ঘোষণা করা হলেও আপিল বিভাগে রায়টি নিষ্পত্তি হতে ধীরগতির কারণে হতাশা প্রকাশ করেছেন নিহতের স্বজনরা। তাদের দাবি, উচ্চ আদালত যেন দ্রুত এই হত্যাকাণ্ডে আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির রায় কার্যকর করেন।
যেভাবে অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডটি ঘটে
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের একটি আদালতে হাজিরা শেষে প্রাইভেট কারযোগে ফিরছিলেন সিদ্ধিরগঞ্জের বাসিন্দা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন ও গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম।
একই সময়ে আদালতের কার্যক্রম শেষে অপর একটি প্রাইভেটকারে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহীম। পথিমধ্যে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সামনে থেকে সাদাপোশাক পরিহিত র্যাব সদস্যরা তাদের সাতজনকেই অপহরণ করেন। এ ঘটনায় উত্তাল হয়ে ওঠে নারায়ণগঞ্জ। দফায় দফায় চলতে থাকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড অবরোধ।
৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীর চর ধলেশ্বরী এলাকা থেকে ছয়জনের ও ১ মে একজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সাতজনকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একই পন্থা ও কায়দা অবলম্বন করা হয়। নিহতদের মধ্যে সবাইকে একই পদ্ধতিতে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়, যাতে লাশ ভেসে উঠতে না পারে।
পরে উদ্ধার করা লাশের সবারই হাত-পা বাঁধা ছিল, পেটে ছিল ফাঁড়া। ১২টি করে ইটভর্তি সিমেন্টের বস্তার দুটি বস্তা বেঁধে দেওয়া হয় প্রতিটি লাশের সঙ্গে। তাদের সবার লাশের মুখ ছিল ডাবল পলিথিন দিয়ে মোড়ানো। মামলা চলাকালে প্রধান আসামি নূর হোসেনকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনাসহ নানা ঘটনায় গেল পৌনে তিন বছর ধরেই আলোচিত ছিল সাত খুনের মামলাটি।
মামলা ও আদালতের রায়
অপহরণের ঘটনার একদিন পর কাউন্সিলর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় ছয়জনকে আসামি করে ফতুল্লা থানায় মামলা করেন। এ ছাড়া আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পালও একই থানায় পৃথক আরেকটি মামলা করেন।
পরবর্তী সময়ে ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি এ হত্যাকাণ্ডে সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ ৩৫ জনকে আসামি করে চার্জ গঠন করে। পুলিশের চার্জশিট গ্রহণ করার পর ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন ৩৮ কর্মদিবসে ১০৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণের মাধ্যমে বহুল প্রতীক্ষিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে প্রধান আসামি নূর হোসেন ও সাবেক তিন র্যাব কর্মকর্তাসহ ২৬ আসামির মৃত্যুদণ্ড এবং বাকি ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করেন আদালত। পরে আসামিপক্ষ এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করে।
২০১৭ সালের ২২ আগস্ট উচ্চ আদালতের রায়ে নূর হোসেন, র্যাবের তারেক সাঈদ, আরিফ হোসেন ও এমএম রানাসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১১ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করেন। পরে আসামিপক্ষ আবারও এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করে।
নিম্ন আদালতের পর উচ্চ আদালত ২০১৮ সালে ২২ আগস্ট ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রেখে বাকি আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা বহাল রাখেন।
বর্তমানে মামলাটি সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন। আড়াই বছর ধরে মামলাটি আপিল বিভাগে থাকায় নিহতদের আত্মীয়-স্বজনরা হতাশা প্রকাশ করেছেন। নিহতদের পরিবারসহ নারায়ণগঞ্জবাসী সাত খুন মামলার রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানিয়েছেন।
আলোচিত সাত খুনে নিহতরা হলেন-নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকার, যুবলীগ নেতা মনিরুজ্জামান স্বপন, স্বপনের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর, নজরুলের সহযোগী তাজুল ইসলাম, নজরুলের বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক ইব্রাহিম। ৭ জন নিহতের পরিবারের মধ্যে পাঁচটি পরিবার উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে এখন অর্থকষ্টে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
সাত বছরেও রায় কার্যকর না হওয়ায় হতাশ স্বজনরা
নিম্ন আদালতে ও হাইকোর্ট মামলাটির কার্যক্রম দ্রুত চলমান থাকলেও আপিল বিভাগে মামলাটির কার্যক্রম অত্যন্ত ধীরগতিতে চলছে বলে অভিযোগ করেছেন নিহতের স্বজনরা। অপরদিকে মামলাটির রায় দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমে নরঘাতকদের ফাঁসি দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
৭ খুনে নিহত মনিরুজ্জামান স্বপনের ছোট ভাই মিজানুর রহমান রিপন বলেন, আলোচিত ৭ খুনের পরে নারায়ণগঞ্জে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলাটির রায় ঘোষণার পরে হাইকোর্টেও মামলাটির রায় দ্রুত ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু আপিল বিভাগে মামলাটির কার্যক্রম অত্যন্ত ধীরগতিতে চলছে। যে কারণে আমরা বর্তমানে মামলাটির ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কায় আছি। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন আলোচিত ৭ খুনের রায় যাতে দ্রুত কার্যকর হয় তিনি সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন। আমরা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি কামনা করছি।
নিহত নাসিকের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বলেন, আলোচিত ৭ খুনের পরে নারায়ণগঞ্জে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলাটির রায় ঘোষণার পরে হাইকোর্টেও মামলাটির রায় দ্রুত ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু আপিল বিভাগে মামলাটির কার্যক্রম অত্যন্ত ধীরগতিতে চলছে।
যে কারণে আমরা বর্তমানে মামলাটির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় আছি। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন আলোচিত ৭ খুনের রায় যাতে দ্রুত কার্যকর হয় তিনি সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন।
আমরা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি কামনা করছি। তিনি জানান, আজ ৭ খুনের নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে প্রয়াত নজরুলের সিদ্ধিরগঞ্জের বাসায় ও স্থানীয় মসজিদে বিশেষ দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে।
নিহত তাজুল ইসলামের বাবা বলেন, ‘সাত বছর ধরে অনেক দুঃখ-যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছি। আমার সংসারে ছেলেটাই ছিল উপার্জনক্ষম। তাকে হত্যার পর থেকে তার মা অসুস্থ হয়ে বাড়িতে পড়ে আছে। তার ইচ্ছে ছেলে হত্যার বিচার দেখে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবে। কিন্তু এখনও রায় কার্যকর হয়নি। দেশে করোনা পরিস্থিতির কারণে হয়তো কার্যক্রম হচ্ছে না। আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ করব আপিল বিভাগে মামলার শুনানি যেন দ্রুত করা হয়।’
সাত খুনের ঘটনায় নিহত গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী নুপুর আক্তার বলেন, ‘আমার মেয়ের বয়স এখন সাত বছর। জন্মের আগেই তার বাবাকে খুন করা হয়েছে। এখনও খুনিদের শাস্তি হয়নি। সাত বছরে আমাদের কেউ সহযোগিতা করেনি। যার স্বামী নেই, তার কাছে কিছুই নেই। তবু শেষ বিচারের রায় শোনার অপেক্ষায় আছি।’
আলোচিত ওই হত্যাকাণ্ডের দুইটি মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, ‘শুরু থেকে একটি পক্ষ এ মামলার কার্যক্রম বিলম্ব করতে চেয়েছে। কিন্তু বিচারিক আদালত দ্রুত মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ করেছে। হাইকোর্টেও মামলার রায় হয়েছে কিন্তু আপিল বিভাগে মামলার কার্যক্রম বিলম্ব হচ্ছে। আমি মনে করি, রাষ্ট্রপক্ষ গুরুত্ব দিলে আপিল বিভাগে দ্রুত মামলার শুনানি হতে পারে। এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায়ের অপেক্ষা করছে সারা দেশের মানুষ।’
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ দেশে ফাঁসির রায় পাওয়া ব্যক্তির উচ্চ আদালতে গিয়ে শাস্তি কমে যাওয়ার এমনকি তার পুরোপুরি মুক্তি পাওয়ার বহু ঘটনা রয়েছে। আবার পুরো বিচারকাজ শেষ হওয়ার পরও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক কুখ্যাত খুনিরসাজা কমানোর কিছু নজিরও এ দেশে রয়েছে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় প্রভাবশালী একটি পক্ষ থেকে মামলার কার্যক্রম বিলম্ব করার চেষ্টায় রায় কার্যকরের ভবিষ্যৎ দেখা যাচ্ছে না।
তারা বলেন, নারায়ণগঞ্জ সাত হত্যার ঘটনা দেশের অন্যতম প্রধান বিভীষিকাময় ও কলঙ্কজনক ঘটনা। নূর হোসেনের সতীর্থরা সারা বাংলাদেশেই ছড়িয়ে আছে। তাদের সন্ত্রাস, ভীতির শিকার অসংখ্য ভুক্তভোগী। সব খবর সব সময় প্রকাশিত হয় না বলে তাদের কুকর্ম, অত্যাচারের খবর অজানা রয়ে যায়। তারা থেকে যায় আইনের আওতার ঊর্ধ্বে। অন্যদিকে তারেক সাইদ, আরিফ হোসেন ও মাসুদ রানার মতো অফিসার যে র্যাবে নেই বা ভবিষ্যতে আসবে না এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় না। সরকারের নজরদারি ও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সতর্কতাই শুধু এ ধরনের বিভীষিকার পুনরাবৃত্তি থেকে জনগণকে রক্ষা করতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫৫
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ