নব্বই দশকের শেষ দিকে দেশে মাদক হিসেবে ইয়াবা সেবন চললেও ২০০২ সালের দিকে তা ধরা পড়ে। যদিও শুরুর দিকে এ নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না প্রশাসনের। সেই ইয়াবাই এখন মাথাব্যথার বড় কারণ। পুলিশ, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সবাই একমত যে দেশটিতে এ মুহূর্তে যে মাদকটি ব্যবহারের শীর্ষে আছে তা হল – ইয়াবা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসেবে, ২০০৮ সালে যে পরিমাণ ইয়াবা ব্যবহার হতো ২০১৬ সালে এর ব্যবহার বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছিল। বর্তমানে এই মাদকটি নেতৃত্ব দিচ্ছে। এর বাইরে হেরোইন, গাঁজা ও ফেনসিডিল বহুকাল ধরেই এদেশে অনেক মাদকসেবী ব্যবহার করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নতুন যে মাদকের নাম শোনা যাচ্ছে তা হলো- ক্রিস্টাল মেথ বা আইস।
প্রায় দুই বছর আগে ঢাকার মোহাম্মদপুরে নিয়মিত অভিযানে ৫ গ্রাম আইসসহ এক যুবককে আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তখনই আইসের কথা জানা যায়। এরপর ওই যুবকের স্বীকারোক্তিতে জিগাতলার একটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় হাসিব বিন মোয়ামের রশিদ নামে এক ব্যক্তিকে। রশিদ ওই বাসার তলকুঠুরীতে ‘আইস’ তৈরির কারখানা বসিয়ে সবে উৎপাদন শুরু করেছিল বলে জানান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক খুরশীদ আলম।
গতবছর নভেম্বরে রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় অভিযান চালিয়ে মেথামফিটামিন মাদক ‘আইস’ বা ‘ক্রিস্টাল মেথ’সহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) মো. মোসাদ্দেক হোসেন রেজা বলেন, দুই বছর ধরে আইস দেশে আসতে শুরু করেছে।
গত ৪ নভেম্বরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ গেণ্ডারিয়া থেকে ছয়জনকে ৬০০ গ্রাম আইসসহ গ্রেপ্তার করে। ডিএমপির উপ-কমিশনার এইচ এম আজিমুল হক বলেন, ঢাকায় পুলিশের অভিযানে আইস পাওয়ার ঘটনা সেটাই প্রথম। এরপর এ বছরের ১৪ জানুয়ারি হাতিরপুল ও হতিরঝিল এলাকায় গোয়েন্দা পুলিশ অভিযান চালিয়ে আইসসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে।
আইস থাইল্যান্ডে বেশি ব্যবহার হয়। এই মাদকটিও মিয়ানমার হয়ে আসতে শুরু করেছে। ইয়াবার সঙ্গে আইসও পাওয়া যাচ্ছে এখন। গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, প্রতি ১০ গ্রাম আইস মাদক ব্যবসায়ীরা বিক্রি করে এক লাখ টাকায়, যা রাজধানীর অভিজাত ও উচ্চবিত্তরা ব্যবহার করে থাকেন। প্রতিবার এই মাদক আইস সেবনে খরচ হয় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। ব্যয়বহুল এই মাদক অভিজাত শ্রেণির মাদকসেবী ছাড়া সেবন সম্ভব না।
জানা যায়, আইসের উৎপত্তিস্থল অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও চায়না। এটি স্নায়ু উত্তেজক মাদক। অত্যন্ত দামি এই মাদক ব্যবহারে ক্ষতি অনেক বেশি। এটি সেবনের ফলে মাদকাসক্তরা দীর্ঘ সময় কাজ ও চিন্তা করার স্ট্যামিনা পায় বলে জানায়। দীর্ঘদিন এটি ব্যবহার করলে হৃদরোগ ও স্ট্রোক হয়। এছাড়া দাঁত ক্ষয়ে যায়।
ইয়াবায় এমফিটামিন থাকে পাঁচ ভাগ আর ক্রিস্টাল মেথ বা আইসের পুরোটাই এমফিটামিন। তাই এটি ইয়াবার চেয়ে অনেকগুণ বেশি ক্ষতিকর মাদক। ইয়াবার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে মানবদেহে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা ইয়াবার মতোই সহজে বহনযোগ্য, তবে ইয়াবার চেয়ে বেশিগুণ ক্ষতিকর শরীরের জন্য। তারা বলেন, ক্রিস্টাল মেথ বা আইস সেবন করলে কারও স্ট্রোক হতে পারে। হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। মানসিক অবসাদ বা বিষণ্ণতার কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হতে পারে। আরও অন্যান্য ঝুঁকি তো আছেই। মূলত মানসিক ক্ষেত্রে এটি বেশি প্রভাব ফেলে। কেউ আসক্ত হলে এটি ছাড়া তিনি আর ঘুমাতে পারেন না।
বিশেষজ্ঞরা আরো জানান, ‘আইস’ লবণের মতো দানাদারজাতীয় মাদক। দেখতে কখনো চিনির মতো, কখনো মিছরির মতো। আইস উচ্চমাত্রার মাদক, যা সেবনের পর মানবদেহে দ্রুত উত্তেজনার সৃষ্টি করে। এই মাদক সেবনের পর মস্তিষ্ক বিকৃতিতে মৃত্যু হতে পারে। তাছাড়া অনিদ্রা, অতিরিক্ত উত্তেজনা, স্মৃতিভ্রম ও হৃদরোগকে বেগবান করে। আসক্তদের যৌনক্ষমতা, কিডনি, লিভারসহ অঙ্গ-প্রতঙ্গ নিমেষেই শেষ হয়ে যায়। তারা বিকৃত যৌনাচারে লিপ্ত হয়ে ওঠে। স্বভাব হয়ে যায় হিংস্র। হত্যাসহ যেকোনো অপরাধ করতে তারা দ্বিধা করে না।
তারা বলেন, সমাজে চরম নিষ্ঠুরতা-নির্মমতা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। তরুণ সমাজকে দ্রুত গ্রাস করে ফেলছে সর্বনাশা মাদক। তাই ভয়ংকর এই মাদক নির্মূলে এখনই সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ইয়াবার বিকল্প হিসেবে বাজারে খাট বা এনপিএসের পর আবির্ভাব ঘটল আইস বা ক্রিস্টাল মেথ নামক নতুন এই মাদকের।
তারা বলেন, এই মাদক সয়লাব হলে ইয়াবার চেয়ে বেশি বিপর্যয়ের মুখে পড়বে দেশের তরুণ সমাজ। স্ক্যানিংয়ে ধরা পড়ছে না আইস। এই মাদক শরীরে প্রবেশ করলে আর ছাড়ে না বলে অভিমত দেন বিশেষজ্ঞরা। জানা গেছে, আইস নিয়ে চরম বিপাকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। কারণ এটি শনাক্ত করা কঠিন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ডিএনসি সূত্র জানায়, আইস মিথাইলের সঙ্গে শতভাগ অ্যামফিটামিন থাকায় এটা বিশ্বজুড়েই ভয়ংকর মাদক হিসেবে চিহ্নিত। দেশে এখনও আইস সেবনকারী কেউ চিকিৎসা নিয়েছে বলে তথ্য যেমন নেই, তেমনি এই ধরনের মাদকের সেবনকারীর ওপর গবেষণাও হয়নি। তবে বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া আইস বহনকারী ও ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য এবং এটিতে ইয়াবার শতভাগ উপাদান থাকায় এর ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেন, এমননিতেই ইয়াবা আসক্তরা নানা উপসর্গে ভুগে থাকে। শতভাগ অ্যামফিটামিনযুক্ত মাদকে ভয়াবহভাবে দৈহিক ও মানসিক ক্ষতি যে হবে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই এটা দেশে ছড়ানোর আগেই কড়া নজরদারি বাড়াতে হবে। এটা ইয়াবার মতো ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৪১
আপনার মতামত জানানঃ