সম্প্রতি কাতার ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরা বাংলাদেশের সামরিক ও রাজনৈতিক দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া এবং ইসরায়েলের নিকট থেকে অবৈধভাবে নজরদারি যন্ত্র স্পাইওয়্যার কেনার চিত্রও উঠে আসে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে স্পাইওয়্যার কেনার বিষয়ে জানতে চাইলে বলেছিল, ওই নজরদারির যন্ত্র জাতিসংঘের একটি শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে কেনা হয়েছিল। কিন্তু জাতিসংঘ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে। এতে শান্তি মিশনে থাকা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ঝুঁকির মুখে পড়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের মত।
কাতার ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরা তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ইন্টারনেট এবং মোবাইল ফোন নজরদারী করার প্রযুক্তি ইসরায়েল থেকে আমদানি করেছে। পিকসিক্স নামের একটি ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানের তৈরি এই যন্ত্র দিয়ে ওয়াই-ফাই, সেলুলার এবং ভিডিও নজরদারী করা হয়।
ইসরায়েলকে বাংলাদেশ এখনো স্বীকৃতি দেয়নি, ফলে ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের সবধরনের বাণিজ্য নিষিদ্ধ রয়েছে। নিষিদ্ধ থাকা সত্বেও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এই বানিজ্যকে অবৈধ বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। আল জাজিরার তথ্যচিত্রে দেখানো হয়েছে যে, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ইসরায়েলি একটি প্রতিষ্ঠানের তৈরি আইএমএসআই ক্যাচার ক্রয় করেছে। তবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয় না। দেশটির সঙ্গে যেকোনো ধরণের বাণিজ্যই অবৈধ। তথ্যচিত্রে দেখানো হয়, ওই যন্ত্রের উৎপাদক দেশ হিসেবে হাঙ্গেরি উল্লেখ থাকলেও প্রকৃতপক্ষে এটি ইসরায়েলের পিকসিক্স নামে একটি কোম্পানির তৈরি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালে পূর্ব ইউরোপীয় দেশ হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টের কাছে দু’জন ইসরায়েলি গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞ এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর চারজন বাংলাদেশী গোয়েন্দাকে প্রশিক্ষণ দেয়।
আল জাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিক দল যেসব দলিল সংগ্রহ করেছে, তার মধ্যে নজরদারী করার প্রযুক্তি ক্রয় করার একটি কন্ট্রাক্ট আছে, যেখানে তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ১৮ই জুন, ২০১৮। এই চুক্তিতে সই করা হয়েছে ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ডিফেন্স পারচেসেস (ডিজিডিপি)-এর পক্ষ থেকে। ডিজিডিপি সামরিক বাহিনীর একটি সংস্থা, যেটি বাংলাদেশের সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করার দায়িত্ব পালন করে থাকে।
এই সরঞ্জাম ক্রয়ে মধ্যস্থতা করেছেন আয়ারল্যান্ডের একটি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা। ওই মধ্যস্থতাকারী আল জাজিরার গোপন ক্যামেরায় বলেন, “এই প্রযুক্তি খুবই আক্রমণাত্মক ও অনধিকারপ্রবেশমূলক। আপনি চাইবেন না যে জনগণ জানুক এই যন্ত্র আপনারা ব্যবহার করছেন।”
ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান থেকে সরঞ্জামটি ক্রয়ের বিভিন্ন নথিপত্র প্রদর্শন করা ছাড়াও, তথ্যচিত্রে ওই আইরিশ ব্যক্তির গোপনে ধারণকৃত বক্তব্যও প্রচার করা হয়। পাশাপাশি, এই যন্ত্র ক্রয়ের শর্ত হিসেবে ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানটির সাথে একটি “নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট” বা তথ্য প্রকাশ না করার একটি চুক্তিতে সই করে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী।
তথ্যচিত্রের এই নির্দিষ্ট দাবির বিষয়ে সেনাসদর “তীব্র প্রতিবাদ” জানিয়ে এক বিবৃতি প্রকাশ করে। বিবৃতিতে বলা হয়, “প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যবহারের জন্য হাঙ্গেরির একটি কোম্পানী থেকে ক্রয়কৃত সিগন্যাল সরঞ্জামাদিকে উদ্দেশ্য প্রনোদিতভাবে ইসরায়েল থেকে আমদানিকৃত মোবাইল মনিটরিং প্রযুক্তি হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।”
তবে আল জাজিরার কাছে জাতিসংঘের এক মুখপাত্র বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই দাবিকে অস্বীকার করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, শান্তিরক্ষা মিশনে এধরনের যন্ত্র চালানো হয় না। মুখপাত্র বলেন, “এই ধরণের যন্ত্র জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কর্মসূচিতে বাংলাদেশি কোনো কন্টিনজেন্টে ব্যবহার বা মোতায়েন করা হয়নি।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যেসব অভিযোগ আল জাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে এবং বিপরীতে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যেই বিবৃতি দিয়েছে, তা নিয়ে আমরা অবগত আছি। দুর্নীতির অভিযোগসমূহ অত্যন্ত গুরুতর বিষয়, যা তদন্ত করে দেখা উচিত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।”
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে সৈন্য বা সদস্য পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম সারিতে। আল জাজিরা জানায়, সারা বিশ্বে ৬৮০০ জন সেনা শান্তিরক্ষা মিশনে রয়েছে। ২০১৬ সালে সরকারি নথির বরাতে বার্তাসংস্থা এএফপি জানায়, মিশনে অংশগ্রহণকারী দশ সহস্রাধিক বাংলাদেশি বছরে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বা ৭৫০০ কোটি টাকা দেশে পাঠিয়ে থাকেন। কিন্তু সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের স্বপক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে অবৈধ ইসরায়েলি স্পাইওয়্যার ক্রয়ের সাথে শান্তিরক্ষা মিশনকে জড়িয়ে সেনাসদর মন্তব্য করলে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে।
শান্তিরক্ষা মিশনকে জড়িয়ে সেনাসদরের বক্তব্য বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা মিশনকে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যবহারের জন্য নজরদারি যন্ত্র কেনার জন্য জাতিসংঘের অনুমতি লাগবে, এটা খুবই স্বাভাবিক। যেহেতু সেনাসদর দাবি করেছে শান্তিরক্ষা মিশনে কাজের জন্য এই স্পাইওয়্যার কেনা হয়েছে, সেখানে জাতিসংঘের অনুমতি ছাড়া তা করতে পারে না। এদিকে জাতিসংঘের মুখপাত্রের বক্তব্য প্রমাণ করে যে সেনাসদরের কোনো অনুমতি নেই। এতে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা মিশনে ভূমিকা এবং মিশনে থাকা নিয়ে এক ধরনের ঝুঁকি তৈরী হয়েছে বলে মনে করেন তারা।
আগামী সপ্তাহে নিউইয়োর্কে সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের সাথে শান্তিরক্ষা কর্মসূচি বা পিস অপারেশন্স বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জ্যঁ পিয়েরে লাখোয়া ও অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তার পূর্বনির্ধারনী বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে জাতিসংঘের শান্তি মিশন উপলক্ষ্যে এই স্পাইওয়্যার কেনা হয়েছে, উপযুক্ত প্রমাণ দিতে না পারলে শান্তিরক্ষায় থাকা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মিশন থেকে উৎখাত হতে পারেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা। এতে দেশের রেমিটেন্স খাত এবং সর্বোপরী বাংলাদেশের এতোদিনকার অর্জন হুমকির মুখে পড়ে যাবে বলে মনে করেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০৭
আপনার মতামত জানানঃ