বিশ্ব বসতি দিবস আজ। অথচ এ দেশের লাখো মানুষের কোনো স্থায়ী বসতি নেই—প্রতিদিনই কেউ না কেউ নদীর গর্ভে হারাচ্ছে তার ঘর, জমি আর শিকড়ের টান। ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, তিস্তা, মেঘনা কিংবা ধরলার মতো নদীগুলোর প্রবল স্রোত আর অস্থির চরভূমি যেন বছরের পর বছর মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে বাস্তুচ্যুত জীবনের দিকে। গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার উড়িয়া ইউনিয়নের রতনপুর গ্রাম যেন তার এক জীবন্ত উদাহরণ। কিছুদিন আগেও এখানে ছিল ফসলভরা মাঠ, মানুষের কোলাহল, নদীর পাড়ে জীবনের সরল স্রোত। কিন্তু মাত্র এক মাসের ব্যবধানে সবকিছু বদলে গেছে। এখন সেখানে হাহাকার আর আতঙ্ক। প্রায় ৫০ বিঘা জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। অন্তত ২০টি পরিবার হারিয়েছে ঘরবাড়ি, জমি আর জীবিকার ভরসা। তারা কেউ আত্মীয়ের বাড়িতে, কেউবা উঁচু চরে আশ্রয় নিয়েছে। সাময়িক ত্রাণ বা সাহায্য পেলেও টিকে থাকার লড়াই তাদের প্রতিদিনের সঙ্গী।
এ দৃশ্য শুধু রতনপুরের নয়, পুরো দেশের বহু নদীপাড়ে একই বাস্তবতা। গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, ভোলা কিংবা শরীয়তপুর—যেখানেই নদী, সেখানেই ভাঙনের ভয়। প্রতি বছর হাজার হাজার পরিবার তাদের ভিটামাটি হারিয়ে অস্থায়ী আশ্রয়ে চলে যায়। স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা আসে খুব সামান্য। নদীভাঙনে কতজন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় তার কোনো নির্ভরযোগ্য সরকারি তথ্যও নেই। তবে মাঠপর্যায়ের চিত্র বলছে, এক দশকে কেবল উত্তরাঞ্চলেই কয়েক লাখ মানুষ নদীর স্রোতে হারিয়েছে তাদের বসতি।
কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা ও দুধকুমার নদীর তীরে প্রায় প্রতি বছর দুই থেকে আড়াই হাজার পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়। গত ১০ বছরে এ জেলার নয় উপজেলার নদীভাঙনে প্রায় ৩০ হাজার পরিবার তাদের ভিটেমাটি হারিয়েছে। এদের মধ্যে ৭০ ভাগই আবার নতুন চর জেগে উঠলে সেখানে বসতি গড়ে তোলে। কিন্তু চরভূমিতে টিকে থাকা সহজ নয়—না আছে বিশুদ্ধ পানি, না আছে শিক্ষা বা চিকিৎসা, বর্ষায় আবার ডুবে যায় পুরো গ্রাম। বাকিরা শহরমুখী হয়, কেউ ঢাকায়, কেউ অন্য জেলায় গিয়ে মজুর, রিকশাচালক বা গৃহকর্মীর কাজ করে জীবিকা খোঁজে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, সুরক্ষা বাঁধ না থাকায় ভাঙন নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। কুড়িগ্রামের বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাবলু মিয়া জানান, ইউনিয়নের ৮০ ভাগ এলাকা এখনো অরক্ষিত। তিন বছর আগে ব্রহ্মপুত্রের বুকে থাকা ‘মুসার চর’ পুরোপুরি নদীতে তলিয়ে গেছে। তখন শতাধিক পরিবার অন্য চরে গিয়ে বসতি গড়েছে। এমন হাজারো পরিবারের অস্তিত্ব এখন শুধু স্মৃতিতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীভাঙন এখন আর কেবল প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়, এটি জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাবেরই অংশ। অকালবৃষ্টি, বন্যা, নদীর প্রবাহপথ পরিবর্তন আর তীররক্ষাবাঁধের অভাব—সব মিলিয়ে প্রতিনিয়ত ক্ষয় বাড়ছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আসাদ হোসেন মনে করেন, নদীভাঙন শুধু জমি হারানো নয়—এটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটও তৈরি করছে। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হন, তাদের অধিকাংশই কৃষক ও নিম্নবিত্ত মানুষ। তারা জমি হারিয়ে শহরে গিয়ে শ্রমিকে পরিণত হন, ফলে কৃষিক্ষেত্রেও প্রভাব পড়ে।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে ২৪ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। কারণ হিসেবে সংস্থাটি উল্লেখ করেছে বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তবে নদীভাঙনের সংখ্যা আলাদা করে নেই। ২০২০ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, শুধু সেই বছরই বাংলাদেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ৪৪ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে—এদের বেশির ভাগই নদীভাঙনের শিকার। কেউ কেউ জীবনে ২০-২৫ বার পর্যন্ত জায়গা বদলেছেন। এদের বড় অংশই ঠাঁই নিয়েছে রাজধানী ও বড় শহরের বস্তিগুলোতে।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্যানেলের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে নদীভাঙন, বন্যা, ঝড় ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে অন্তত দুই কোটি মানুষকে স্থানান্তরিত হতে হবে। এর মধ্যে নদীভাঙনের কারণেই ২০ থেকে ৫০ লাখ মানুষ বসতি হারাবে। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয়, ভবিষ্যতের বাংলাদেশে নদীভাঙন হবে একটি মানবিক সংকটের কেন্দ্রবিন্দু।
পদ্মা নদীকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাঙনপ্রবণ নদী হিসেবে চিহ্নিত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। ১৯৬৭ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে পদ্মা নদীই একা গিলে ফেলেছে ৬৬ হাজার হেক্টরের বেশি এলাকা—যা ঢাকার আয়তনের আড়াই গুণ। আর ১৯১১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে পদ্মার দুই পারে ভেঙে গেছে ১ হাজার ৭৪৯ বর্গকিলোমিটার জমি, যদিও পলি পড়ে নতুন করে গড়ে উঠেছে ১ হাজার ৩১৬ বর্গকিলোমিটার ভূমি। অর্থাৎ মানুষের বসতি হারিয়েছে স্থায়ীভাবে অন্তত ৪৩৩ বর্গকিলোমিটার জমি।
এভাবে ভাঙন মানে কেবল জমি হারানো নয়, হারিয়ে যায় জীবনের ইতিহাসও। এক প্রজন্ম যেখানে বড় হয়, পরের প্রজন্ম সেখানে ফিরে যেতে পারে না। স্কুল, মসজিদ, খেলার মাঠ, কবরস্থান—সবকিছু নদী গিলে নেয়। সরকার ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কিছু কিছু এলাকায় তীর সংরক্ষণ কাজ করলেও তা পর্যাপ্ত নয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প থাকলেও সেগুলোর বাস্তবায়নে দেরি ও অনিয়ম নিয়ে স্থানীয়দের অভিযোগ আছে। অনেক সময় প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই ভাঙন অন্য দিকে চলে যায়।
এই বাস্তুচ্যুতি কেবল ভৌগোলিক নয়, সামাজিকও। নদীভাঙনে যারা শহরে আসে, তারা মূলত শহরের প্রান্তে গিয়ে অস্বাস্থ্যকর বস্তিতে ওঠে। তাদের সন্তানরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়, স্বাস্থ্যসেবা অপ্রতুল থাকে। ফলে জন্ম নেয় নতুন এক দারিদ্র্যচক্র। কাজের সন্ধানে এরা রিকশা চালায়, দিনমজুরি করে, কেউবা গার্মেন্টস কারখানায় কাজ নেয়। কিন্তু শহরে এসে টিকে থাকাটাও সহজ নয়। তারা শহরের অনানুষ্ঠানিক শ্রমবাজারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে—যেখানে নিরাপত্তা নেই, নিশ্চয়তা নেই।
নদীভাঙনের এই ভয়াবহতা মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থায়ী সমাধানের জন্য আগে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করতে হবে। সেখানে আগাম ব্যবস্থা নিতে হবে—তীররক্ষা, বনায়ন, পলি ব্যবস্থাপনা ও নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের কাজ। পাশাপাশি বাস্তুচ্যুতদের পুনর্বাসনের টেকসই পরিকল্পনা করতে হবে। কেবল ত্রাণ বা অস্থায়ী আশ্রয়ে সীমিত না রেখে তাদের জন্য বিকল্প জীবিকা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের নদীগুলো আমাদের জীবনের অংশ, কিন্তু আজ সেগুলোই হয়ে উঠছে ভয়াবহ বাস্তুচ্যুতির কারণ। এই নদীগুলোর ভাঙন থামানো না গেলে ভবিষ্যতে আরও লাখো মানুষ হারাবে তাদের ঘরবাড়ি, ইতিহাস ও শেকড়। বিশ্ব বসতি দিবসের এই দিনে তাই প্রশ্ন জাগে—যারা প্রতিদিন নদীর গর্ভে বিলীন হচ্ছে, তাদের জন্য কোথায় সেই নিরাপদ বসতি?
বাংলাদেশের উন্নয়নের গল্পে নদীভাঙনের এই অধ্যায় যেন ভুলে যাওয়া যায় না। কারণ এটি কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়—এটি মানবিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত এক দীর্ঘমেয়াদি সংকট। নদীভাঙনের ঢেউ এখন শুধু নদীপাড়ে নয়, আমাদের জাতীয় চেতনার ভেতরেও আঘাত হানছে। আর তাই আজকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ—নদীর স্রোতের সঙ্গে টিকে থাকার এই লড়াইকে মানবিকভাবে মোকাবিলা করা, যেন আর কোনো রতনপুরের গল্প নদীর জলে হারিয়ে না যায়।
আপনার মতামত জানানঃ