২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের প্রায় ১৭ শতাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাবে। এর ফলে দেশের ২ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়বে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট মঙ্গলবার মানবাধিকার কাউন্সিলের ৪৮তম অধিবেশনে একটি প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে এই তথ্য তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, মালদ্বীপের ৮০ শতাংশেরও বেশি স্থলভাগের অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র এক মিটারেরও কম উচ্চতায়, ইতোমধ্যেই সেখানে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে যা সমুদ্রের উচ্চতার মাত্রা বাড়ার সাথে সাথে আরও খারাপ হবে।
উপকূলীয় বাংলাদেশে এরই মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান লক্ষ করা গেছে। উপকূলের ৯৭.৯১ শতাংশ অঞ্চলের সাড়ে তিন কোটি মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের মতো ঝুঁকিতে রয়েছে যেমন—গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়, ঝড়ের তীব্রতা, উপকূলীয় বন্যা, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ সম্পৃক্ত।
এদিকে জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনাম সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশিরভাগ অঞ্চলে ২০৫০ সালের মধ্যে দৈনিক উচ্চ জোয়ারে ৪ কোটি ৮০ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করে এমন এলাকায় বন্যা হতে পারে।
পরিবেশগত দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুতি এশিয়ার একটি গুরুতর ঘটনা। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে চীন, বাংলাদেশ, ভারত এবং ফিলিপাইনে অন্যান্য দেশের তুলনায় দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুতির ঘটনা বেশি ঘটেছে, যা বিশ্বের মোট ৭০ শতাংশ।
এদিকে, বাংলাদেশ গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা এ তিনটি বৃহৎ নদীর অববাহিকায় অবস্থিত এবং এর ৮০ শতাংশ এলাকা প্লাবণভূমি। নদীপ্রধান দেশ হওয়ার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হিমালয়ের বরফ গলা ও বৃষ্টিপাতের সময়সীমায় তারতম্য এবং নদী ভরাট হওয়া, অপরিকল্পিত নগরায়ন, খাল-বিল, জলাভূমি ও নদী দখলসহ নানা কারণে নদী ভরাট হওয়ায় বাংলাদেশে বন্যা ঝুঁকি ও ক্ষয়ক্ষতি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, বিভিন্ন ধরনের চরম আবহাওয়াজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের কারণে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের চরম ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। বাংলাদেশ উপকূল বরাবর সমুদ্রের স্তর বছরে প্রায় তিন মিলিমিটার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১৯৭৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত মাটিতে লবণাক্ততা ২ শতাংশ বেড়েছে (মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, ২০১০)। এ লবণাক্ততার কারণে চাল উৎপাদন ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ এবং গম ৩২ শতাংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে।
এদিকে আইপিসিসির পঞ্চম প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় বাংলাদেশে প্রায় ২.৭ কোটি লোক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ২০১৩ সালে প্রকাশিত ক্লাইমেট ভালনারেবল মনিটর অনুসারে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে প্রতি বছর অতিরিক্ত ছয় লাখ মানুষ ঝুঁকিতে রয়েছে এবং ১২৫ কোটি ডলারের অতিরিক্ত অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশের জীবিকা নির্বাহের প্রায় ৮৮ শতাংশ কৃষি খাতের ওপর নির্ভরশীল এবং জিডিপিতে অবদান প্রায় ১৬ শতাংশ। কৃষি মৌসুমি অবস্থার যেকোনো পরিবর্তনের সাথে সংবেদনশীল, এমনকি তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, মৌসুমের সময় ও সময়কাল, বারবার বন্যাসহ মাটি ও পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির সাথে কৃষির উৎপাদন সরাসরি জড়িত।
২০২০ সালে প্রাক্কলিত দেশের মোট শ্রম খাতের প্রায় ৩৭.৭৫% কৃষিতে জড়িত। উচ্চতাপমাত্রা ও অধিক বৃষ্টিপাত কোনো কোনো ক্ষেত্রে শস্য উৎপাদনভিত্তিক আয় বাড়াতে অবদান রাখলেও (হোসেন এবং অন্যান্য, ২০১৯) অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত এবং অধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইতিবাচক সে অবদানকে নেতিবাচক অবস্থানে নামিয়ে নিয়ে আসতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের একটি গবেষণায় বলা হয়, কেবল ০.৩ মিটার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি থেকে মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশে ধান উৎপাদন ০.৫ মিলিয়ন টন হ্রাস পেতে পারে। এটি বিশ্বের বৃহৎ চালের ভোক্তাদের মধ্যে অন্যতম হওয়ায় দেশে ব্যাপক স্বাস্থ্য ও পুষ্টিহানি ঘটতে পারে।
আশঙ্কার বিষয় হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষকরা প্রায় ৫৫% প্রাকৃতিক সম্পদের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারে। কৃষিকাজের জন্য জমির পরিমাণ কমে গিয়ে খাদ্যশস্য উৎপাদন প্রায় ৩০% কমে যেতে পারে। এমনকি মানবসম্পদের জোগান ১৫% হ্রাস এবং কৃষকের স্বাস্থ্য ঝুঁকি প্রায় ২৫% বেড়ে যেতে পারে। ফলে সার্বিক উৎপাদনশীলতা কমে আয় হ্রাস পাওয়ায় আর্থিক সম্পদে গ্রামীণ মানুষের অভিগম্যতা প্রায় ৪৬% কমে যেতে পারে।
সেন্টার ফর রিসার্চ অন দি এপিডেমিওলজি অব ডিজাস্টারসের (সিআরইডি) তথ্যমতে, ১৯৯০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৫৫টি বন্যা ও ৭২টি ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়েছে। ১৯৭০ থেকে ১৯৯০ সময়ের তুলনায় এ সময়ে অনেক বেশি বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের পরিমাণ বেড়ে গেছে।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সংস্থা আইপিসিসির পঞ্চম গবেষণা প্রতিবেদনেও বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। যত ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসজনিত দুর্যোগের মাত্রা বাড়বে তত বেশি সমুদ্রে জেলেদের জীবন ও উপার্জনের ঝুঁকি বাড়বে।
গত কয়েক দশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করতে সক্ষম হলেও আইপিসিসির পঞ্চম অ্যাসেসমেন্ট প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯৮-২০০৯ সময়ে শুধু ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বাংলাদেশে জিডিপির ৫.৯% ক্ষতি হয়েছে।
বিবিএসের তথ্যমতে, ২০০৯-১৫ সময়ে বন্যায় প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৩ হাজার ৭০ কোটি ৮০ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে এবং এ ক্ষতি না হলে বাংলাদেশ প্রতি বছর অতিরিক্ত ০.৩০% জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারত। শুধু তা-ই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে আগামী তিন দশকে উপকূলের প্রায় দুই কোটি লোক বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়তে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪৩৬
আপনার মতামত জানানঃ