ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, কলকাতা হাইকোর্টের একটি ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে সেটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। এক গর্ভবতী নারীসহ ছয়জন ভারতীয় নাগরিককে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ সন্দেহে দিল্লি পুলিশ আটক করে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু পরে প্রমাণিত হয় যে তারা প্রকৃতপক্ষে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বাসিন্দা। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে রিট পিটিশন দায়ের করা হয়েছিল, তার রায়ে হাইকোর্ট স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে আটক ও বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া ছিল বেআইনি। আদালতের মতে, আইন কখনোই প্রশাসনকে এই ক্ষমতা দেয়নি যে কারো বাড়ির দরজায় কড়া নেড়ে তাকে বিদেশি ঘোষণা করা যাবে। সন্দেহভাজন কাউকে আটক করলেও তার পরিচয় যাচাইয়ের জন্য সময় দেওয়া আবশ্যক, কিন্তু দিল্লি পুলিশ সে নিয়ম মানেনি।
ঘটনাটি শুরু হয়েছিল দিল্লিতে। সেখানকার পুলিশ পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা দুটি পরিবারকে আটক করে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তারা অবৈধ বাংলাদেশি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ফরেনার্স রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিসের (এফআরআরও) নির্দেশে তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়। অথচ বীরভূম জেলার পুলিশ দ্রুত নথি সংগ্রহ করে দিল্লি পুলিশের কাছে পাঠিয়েছিল, যেখানে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল তারা ভারতের নাগরিক। সেই নথি পাঠানো হয়েছিল নির্ধারিত ৩০ দিনের ভেতরেই, কিন্তু ততদিনে পরিবারগুলিকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আদালতের রায়ে এই অতি দ্রুত সিদ্ধান্তকে প্রশাসনিক ভুল এবং মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ঘটনায় বিশেষভাবে আলোচনায় উঠে এসেছেন গর্ভবতী নারী সোনালি খাতুন। তাকে আটক করার সময় তিনি অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন, বর্তমানে তিনি প্রায় আট মাসের গর্ভবতী। বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ কারাগারে বন্দি অবস্থায় তিনি চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ কারণে নতুন প্রশ্ন উঠেছে—যদি তার সন্তান বাংলাদেশে জন্ম নেয়, তবে সেই সন্তানের নাগরিকত্ব কী হবে। ভারতীয় নাগরিক হয়েও যদি কেউ বিদেশি হিসেবে গ্রেফতার হয়, তবে তার সন্তান জন্মের আগেই নাগরিকত্বের অনিশ্চয়তায় পড়ে যায়, যা গুরুতর মানবাধিকার সংকটের দিকেই ইঙ্গিত করে।
হাইকোর্টের এই রায় শুধু ছয়জন ব্যক্তির মুক্তির প্রশ্ন নয়, বরং একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে যুক্ত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে অবৈধ বাংলাদেশি শনাক্ত করার নামে ব্যাপক অভিযান চালানো হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শ্রমিকরা অন্য রাজ্যে কাজ করতে গেলে তাদের অনেককেই শুধু বাংলায় কথা বলার কারণে বাংলাদেশি সন্দেহে গ্রেফতার করা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেস অভিযোগ করছে, এই প্রক্রিয়ায় প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকরা অন্যায্যভাবে ভুক্তভোগী হচ্ছেন। আদালতের এই রায় তাই শুধু আইনি সিদ্ধান্ত নয়, বরং পরিযায়ী শ্রমিক ও সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষদের জন্য সুরক্ষার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মানবাধিকার কর্মীরা একে ‘মাইলফলক’ রায় বলে আখ্যা দিয়েছেন। কারণ এই রায় স্পষ্ট করেছে যে রাষ্ট্র কাউকে বিনা প্রমাণে বিদেশি ঘোষণা করতে পারে না। বিদেশি আইন অনুযায়ী সন্দেহভাজনের ওপরেই নাগরিকত্ব প্রমাণের দায় থাকলেও প্রশাসনের প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু প্রমাণ হাজির করতে হয়, নইলে সন্দেহ তোলাই অযৌক্তিক। আদালত বলেছে, কর্তৃপক্ষের হাতে যথাযথ তথ্য-প্রমাণ না থাকলে শুধুমাত্র অনুমানের ভিত্তিতে মানুষকে বিদেশি ঘোষণা করা যাবে না।
পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনীতিবিদরাও এই ঘটনায় সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য সামিরুল ইসলাম প্রমাণ সংগ্রহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি শুধু বর্তমান নথিই নয়, সোনালি খাতুনের পূর্বপুরুষদের জমির দলিল পর্যন্ত হাজির করেন, যেগুলো ১৯৫০, ১৯৬০ এবং ১৯৭০-এর দশকের। অর্থাৎ বহু পুরনো দলিলেও প্রমাণিত হয় যে এই পরিবারগুলো ভারতেরই নাগরিক। অথচ সেই প্রমাণ উপস্থাপনের আগেই তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। এই ঘটনাটি স্পষ্টভাবে তুলে ধরে যে প্রশাসনের তাড়াহুড়া কতটা ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকাও এখানে উল্লেখযোগ্য। যখন ছয়জনকে সীমান্তে ঠেলে দেওয়া হয়, তখন বাংলাদেশ পুলিশ চেষ্টা করেছিল তাদের ফেরত পাঠাতে। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ গ্রহণ না করায় শেষ পর্যন্ত তাদের চাঁপাইনবাবগঞ্জে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। বাংলাদেশের পুলিশ জানায়, আটক করার সময়েই তারা নিশ্চিত হয়েছিলেন যে একজন নারী গর্ভবতী। তবু আইনি জটিলতার কারণে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি।
ঘটনাটির সামাজিক প্রভাবও গভীর। সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে যারা শ্রমের জন্য অন্য রাজ্যে যান, তাদের মনে সবসময় ভয় কাজ করে যে তাদের বাংলাদেশি সন্দেহে আটক করা হতে পারে। আদালতের এই রায় অন্তত কিছুটা হলেও সেই আতঙ্ক কমাবে। কারণ এখন আইনি নজির হিসেবে স্পষ্ট হয়ে গেল যে অযাচিতভাবে কাউকে বিদেশি ঘোষণা করা যাবে না এবং তার বিরুদ্ধে কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না।
রাজনৈতিকভাবে এই রায় একটি বড় বার্তা দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী শুরু থেকেই এই দুই পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর ফলে তৃণমূল কংগ্রেস এই ঘটনাকে মানুষের জয় হিসেবে দেখাচ্ছে। তাদের মতে, যদি আদালতের রায় না আসত, তবে হয়তো এই পরিবারগুলো চিরতরে বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যেত। এটি প্রমাণ করেছে যে ন্যায়বিচারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষা করা সম্ভব।
অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য এই রায় একটি অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিল্লি পুলিশ যেভাবে মাত্র দুদিনে তদন্ত শেষ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল, আদালত সেটিকে তীব্র সমালোচনা করেছে। নীতিগতভাবে যেখানে ৩০ দিন পর্যন্ত সময় নেওয়ার নিয়ম রয়েছে, সেখানে মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় বিদেশি ঘোষণা করে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া অনিয়ম এবং অমানবিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আদালত স্পষ্ট করেছে, এই প্রক্রিয়া আইনসিদ্ধ নয়, বরং আইনের অপব্যবহার।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এ ধরনের ঘটনা একক নয়। ইতিমধ্যেই অন্তত ১৫ জনকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে, যারা একইভাবে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। তবে এসব ক্ষেত্রে মামলা হয়নি। সোনালি খাতুনদের মামলা তাই একটি নজির স্থাপন করল, যা ভবিষ্যতে অনুরূপ ঘটনার বিচার প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলবে।
সর্বোপরি এই রায় ভারতীয় সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে—নাগরিকত্ব শুধুমাত্র কাগজে নয়, আইনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়া, সন্দেহের ভিত্তিতে তাদের ঠেলে দেওয়া নয়। পরিযায়ী শ্রমিক, সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ এবং বাংলাভাষী শ্রমিকরা যারা ভিন রাজ্যে কাজ করতে যান, তারা এখন কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবেন যে আদালত তাদের পাশে রয়েছে।
এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করল, রাষ্ট্রযন্ত্র কখনো কখনো সাধারণ মানুষের ওপর অন্যায় চাপিয়ে দেয়, কিন্তু গণতান্ত্রিক কাঠামোয় আদালতই শেষ আশ্রয়। সোনালি খাতুন ও তার পরিবারের মুক্তির রায় তাই শুধু একটি পরিবারের জয় নয়, বরং অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষের ন্যায়বিচারের প্রতীক। এটি মানবাধিকার, আইনের শাসন এবং নাগরিক নিরাপত্তার লড়াইয়ে এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নেবে।
আপনার মতামত জানানঃ