১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতবর্ষে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের নিয়ে যে গবেষণা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে, সেটি বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতজুড়ে শরণার্থী শিবিরগুলোতে কী ঘটেছিল, কীভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ চরম দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্যে জীবন যাপন করেছিল এবং কত বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল—এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দীর্ঘদিন ধরেই আংশিক তথ্য আর টুকরো স্মৃতির ওপর ভিত্তি করে বলা হতো। এবার যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী গবেষক নাজমুল ইসলাম, যুক্তরাজ্যপ্রবাসী গবেষক কৌস্তভ অধিকারী এবং মাহবুবুর রহমান জালালের এক দশকের বেশি সময় ধরে করা গবেষণার ফলাফল একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা সামনে এনেছে। তাদের গবেষণায় বলা হচ্ছে, ভারতের ১৭টি শরণার্থী শিবিরের রেকর্ড অনুযায়ী অন্তত সাড়ে ছয় লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এই সংখ্যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবিক বিপর্যয়কে নতুনভাবে দেখার সুযোগ করে দিচ্ছে।
শরণার্থী শিবিরে মানুষের মৃত্যুর এই হিসাব বের করা হয়েছে নিবন্ধন খাতায় লিপিবদ্ধ নাম ও পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে। গবেষকরা এ ক্ষেত্রে ‘লিনিয়ার রিগ্রেশন ফর্মুলা’ ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ বিভিন্ন শিবিরে নিবন্ধিত মৃত্যুর সংখ্যা এবং শরণার্থীর মোট সংখ্যা থেকে একটি আনুপাতিক হিসাব তৈরি করা হয়েছে। এই পদ্ধতি যদিও পুরোপুরি নিখুঁত নয়, তবুও এটি একটি বৈজ্ঞানিক ও গবেষণাভিত্তিক প্রয়াস, যা অনুমান বা গুজব নয়। এর ফলে একটি প্রমাণভিত্তিক আলোচনার সুযোগ তৈরি হলো। গবেষক নাজমুল ইসলামের ভাষায়, অনেকে আশ্রয়শিবিরে পৌঁছানোর আগেই পথেই মারা গেছেন, কিন্তু সেই তথ্য এভাবে সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। ফলে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা অস্বীকার করা যায় না।
পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার সল্টলেকের শরণার্থী শিবির ছিল তুলনামূলকভাবে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায়। কিন্তু সেখানেও জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে মারা গেছেন ৩ হাজার ৭৬১ জন শরণার্থী। মোট ১ লাখ ৭০ হাজার মানুষের মধ্যে এই পরিমাণ মৃত্যুই কেবল হিসাবভুক্ত হয়েছে। এই একটি উদাহরণ থেকেই বোঝা যায়, বৃহত্তর পরিসরে পরিস্থিতি কত ভয়াবহ ছিল। কেবল রোগব্যাধি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বা অপুষ্টিই নয়, মানসিক চাপ, ভিড় এবং চিকিৎসার অভাবও শরণার্থীদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ ছিল। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা শরণার্থী শিবিরগুলোর বাস্তবতা একে অপরের সঙ্গে খুব একটা আলাদা ছিল না।
এই গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে নতুনভাবে উপস্থাপন করা। পশ্চিমা বিশ্বে এখনো মুক্তিযুদ্ধে প্রাণহানি নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়নি। পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা নিয়ে যেমন আলোচনা হয়, শরণার্থী শিবিরের মৃত্যুর সংখ্যা তেমনভাবে উঠে আসেনি। অথচ গবেষক মফিদুল হকের ভাষায়, গণহত্যার স্বীকৃতি পেতে এই পরিসংখ্যানগুলো অপরিহার্য হতে পারে। কারণ আন্তর্জাতিক মহলে গণহত্যা বা মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণের ক্ষেত্রে সংখ্যা একটি বড় প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
শরণার্থী শিবিরে প্রাণহানির ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন মানবিক বিপর্যয় নয়; বরং এটি মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক বাস্তবতার অংশ। পাকিস্তানি সেনাদের দমননীতি, সীমান্তবর্তী এলাকায় নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ, গ্রাম–শহরে অগ্নিসংযোগ—এসব থেকে বাঁচতে মানুষ ভারতমুখী হয়েছিল। লাখ লাখ নারী, শিশু, বৃদ্ধ এবং অসহায় মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। ভারত সরকার এবং সাধারণ মানুষ সেই সময়ে বিপুলসংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল, কিন্তু এত বিপুলসংখ্যক মানুষের চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়নি। খাদ্য সংকট, বিশুদ্ধ পানির অভাব, অপর্যাপ্ত চিকিৎসা, অতিরিক্ত ভিড় এবং অনিরাপদ জীবনযাপন মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছিল।
শরণার্থী জীবনের দুর্দশা শুধু সংখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এই শিবিরগুলোতে বসবাসকারী মানুষের অভিজ্ঞতা মানব সভ্যতার এক ভয়াবহ অধ্যায়। অল্পবয়সী শিশুদের কাঁদতে কাঁদতে মারা যাওয়া, মায়েরা সন্তানকে বাঁচাতে না পেরে অসহায় হয়ে পড়া, বৃদ্ধদের অপুষ্টি আর অসুখে ধুঁকে ধুঁকে শেষ হয়ে যাওয়া—এসব দৃশ্য কোনো পরিসংখ্যানে ধরা যায় না। তবুও আজকের দিনে যখন এই গবেষণা আমাদের সামনে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা হাজির করছে, তখন সেটি আমাদের ইতিহাসচর্চাকে নতুন মাত্রা দিচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তারা কেবল গবেষণার প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেনি, বরং জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এই গবেষণার গুরুত্ব তুলে ধরছে। জাদুঘরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড হলো সম্প্রতি ইউনেসকোর স্বীকৃতি পাওয়া সুলতানার স্বপ্ন ডকু রিপোর্ট উদ্বোধন। রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের এই কাল্পনিক রচনা এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত হয়ে বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদা পেয়েছে। এই স্বীকৃতির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকালীন গবেষণাকে যুক্ত করে জাদুঘর বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে নতুনভাবে তুলে ধরছে।
এই গবেষণার আরেকটি দিক হলো ভবিষ্যতের ইতিহাসচর্চায় এর প্রভাব। এতদিন মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, নির্যাতন এবং যুদ্ধক্ষেত্রের মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি শরণার্থীদের মৃত্যু তেমনভাবে আলাদা করে আলোচিত হয়নি। অথচ এই মৃত্যুগুলোও পাকিস্তানি সেনাদের আগ্রাসনের পরোক্ষ ফল। যদি পাকিস্তানি সেনারা নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ না চালাতো, তবে লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতে পালাতে বাধ্য হতো না। সেই অর্থে শরণার্থী শিবিরে মৃত্যুগুলোও একধরনের যুদ্ধাপরাধের অংশ।
একই সঙ্গে এই গবেষণা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসকে আরও গভীরভাবে বোঝার সুযোগ দিচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে সংঘটিত লড়াই নয়; এটি ছিল একটি সর্বাত্মক মানবিক বিপর্যয়। এই বিপর্যয়ে মানুষ শুধু শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, মানসিকভাবেও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি হয়েছিল। অনেক পরিবার চিরতরে হারিয়েছে তাদের প্রিয়জনকে। এই ক্ষতির হিসাব কখনো পূরণ হওয়ার নয়। তবে আজও যখন নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করে, তখন এই ধরনের কাজ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় কী ভয়ংকর মূল্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল।
এই প্রেক্ষাপটে আরও গবেষণার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন, শুধু শরণার্থী শিবির নয়, বাংলাদেশের ভেতরেও যুদ্ধকালীন সময়ে যে বিপুলসংখ্যক মানুষ অনাহার, রোগব্যাধি, চিকিৎসার অভাবে বা আতঙ্কে মারা গেছে, তাদের হিসাবও সামনে আনা জরুরি। ননভায়োলেন্ট বা অযুদ্ধজনিত মৃত্যুর সংখ্যা যুক্ত হলে মোট প্রাণহানির একটি বিস্তৃত চিত্র তৈরি হবে। সেই চিত্র শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং আন্তর্জাতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকৃতি পেতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
অতএব, ভারতের শরণার্থী শিবিরে প্রাণহানির সংখ্যা নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক নতুন সংযোজন। এটি কেবল একটি পরিসংখ্যান নয়, বরং স্বাধীনতার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের প্রতিচ্ছবি। ইতিহাসের এই দলিল প্রমাণ করে, স্বাধীনতার স্বপ্ন অর্জন করতে গিয়ে বাঙালিকে কত ভয়ংকর মূল্য দিতে হয়েছে। একই সঙ্গে এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে স্মরণ করিয়ে দেয়, স্বাধীনতার প্রতিটি বিন্দু রক্তের দামে কেনা। এই গবেষণা যদি আন্তর্জাতিক মহলে যথাযথভাবে প্রচারিত হয়, তবে মুক্তিযুদ্ধকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পথে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হয়ে দাঁড়াবে।
আপনার মতামত জানানঃ