ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের জয়কে শুধু একটি ছাত্ররাজনৈতিক সাফল্য হিসেবে দেখা যায় না, বরং এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিপথের একটি বড় ইঙ্গিত। অতীতে যে সংগঠনটি কখনও ডাকসুর কোনো পদে জয়ী হতে পারেনি, তারা এবার ভিপি, জিএসসহ ১২টি সম্পাদকীয় পদের মধ্যে ৯টি দখল করেছে। এটি প্রমাণ করে, দীর্ঘ সময় নিষিদ্ধ বা প্রান্তিক অবস্থায় থাকার পরও তারা সাংগঠনিক শক্তি হারায়নি, বরং নতুন প্রজন্মের মধ্যে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে।
আওয়ামী লীগের দীর্ঘ দেড় দশকের শাসনের পতনের পর যে ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হয়েছে, সেটি ইসলামপন্থীরা দ্রুত পূরণ করতে চাইছে। ২০১৩ সালের পর জামায়াতে ইসলামীর ওপর কার্যত নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলেও তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির গোপনে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। ডাকসুর নির্বাচনে প্রকাশ্যে অংশগ্রহণ ও বিপুল জয়ের মধ্য দিয়ে তারা মূলধারার রাজনীতিতে পুনঃপ্রবেশের পথ তৈরি করেছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় মোড় ঘোরানো ঘটনা।
এই বিজয় দেখিয়ে দিচ্ছে যে ইসলামপন্থী রাজনীতি এখনও তরুণ সমাজের একটি অংশকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম। বিশেষ করে মেয়েদের হলে শিবিরের প্রার্থীদের নজিরবিহীন সমর্থন পাওয়া সমাজে ধর্মীয় মূল্যবোধভিত্তিক রাজনীতির নতুন একটি প্রবণতা নির্দেশ করছে। এর মানে হচ্ছে, আগামী দিনে ইসলামপন্থীরা কেবল পুরুষ শিক্ষার্থীদের নয়, নারী শিক্ষার্থীদেরও একটি অংশকে সংগঠিত করতে পারবে, যা ভবিষ্যতে জাতীয় রাজনীতিতেও তাদের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে।
কিন্তু এই উত্থান বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ। ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে, ইসলামপন্থী সংগঠনগুলোর উত্থানের সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো বেশি ঝুঁকির মুখে পড়ে। ডাকসুর নির্বাচনে শিবির চারজন নারী ও একজন অমুসলিমকে প্রার্থী করলেও এটি কতটা বাস্তব অন্তর্ভুক্তির প্রতিফলন, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। অনেকের মতে, এটি মূলত কৌশল, যাতে তারা বহুত্ববাদী ইমেজ তুলে ধরে বৃহত্তর সমর্থন অর্জন করতে পারে। কিন্তু তাদের দীর্ঘদিনের আদর্শ যে বহুত্ববাদ-বিরোধী, সেটি অস্বীকার করা যায় না। এ অবস্থায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে শঙ্কা বাড়ছে যে, শিবিরের প্রকাশ্য উত্থান তাদের জন্য রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।
জাতীয় নির্বাচনে এই ফলাফলের প্রভাব গভীর হতে পারে। প্রথমত, শিবিরের সাংগঠনিক সাফল্য জামায়াতে ইসলামীকে নতুন করে পুনর্জীবিত করবে। দ্বিতীয়ত, বিএনপি ডাকসু নির্বাচনে কোনো সাফল্য না পাওয়ায় তাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়বে। তৃতীয়ত, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি বা দুর্বলতার কারণে যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা ইসলামপন্থীরা পূরণ করতে চাইবে। ফলে জাতীয় নির্বাচনেও যদি একই ধারা বজায় থাকে, তবে জামায়াত ও তাদের শরিকরা আবারও বড় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।
ডাকসুর এই ফলাফল এক নতুন বাস্তবতা সামনে এনেছে—বাংলাদেশ কি একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামিস্ট রাষ্ট্রের দিকে এগোচ্ছে, নাকি শিবিরের নতুন নেতৃত্ব সত্যিই বহুত্ববাদী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি করতে চাইছে? তাদের প্রকাশ্য উত্থান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে কি না, সেটাই এখন মূল প্রশ্ন।
সারকথা হলো, ডাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের জয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলাম ইজমের শক্ত পুনর্জাগরণের ইঙ্গিত বহন করছে। এর ফলে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ এবং জাতীয় নির্বাচনের চরিত্র—সবই নতুন করে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ছে।
আপনার মতামত জানানঃ