ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন সবসময়ই দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিশেষ তাৎপর্য বহন করেছে। স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে সামরিক শাসনবিরোধী সংগ্রাম পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ডাকসু নেতৃত্ব জাতীয় রাজনীতির গতিপথকে প্রভাবিত করেছে। ২০২৫ সালের ডাকসু নির্বাচন তাই শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন নয়; এটি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এক প্রতীকী অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রথমবার যখন শিক্ষার্থীরা ভোট দিতে যাচ্ছে, তখন জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপটেও এর গভীর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কার্যকর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচন নানা বিতর্ক আর অনিয়মের কারণে সমালোচিত হয়েছিল। এর পর দীর্ঘ সময় নির্বাচন স্থগিত থাকায় ছাত্ররাজনীতি কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। নতুন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য এই নির্বাচন তাই একাধারে গণতান্ত্রিক চর্চার পুনর্জাগরণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য পরীক্ষার মঞ্চে পরিণত হয়েছে। এ কারণেই নির্বাচনকে ঘিরে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, গোটা দেশের রাজনৈতিক মহল এবং জনগণের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এবারের ডাকসু নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি কিংবা প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। প্রচারণা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, আবার অনেক প্রার্থী নিজ গ্রামের বাড়িতেও গিয়ে ভোট চেয়েছেন। এ থেকে স্পষ্ট হয় যে ডাকসু আর কেবল ক্যাম্পাসভিত্তিক নয়; বরং জাতীয় নির্বাচনের প্রাক-প্রস্তুতির অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ যেমন বলছেন, এটি মূলত একটি রিহার্সাল—যেখানে দলগুলো যাচাই করবে তাদের জনপ্রিয়তা, প্রচারণা কৌশল এবং সাংগঠনিক শক্তি কতটা কার্যকর।
তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ এ নির্বাচনের আরেকটি বড় দিক। দীর্ঘদিন ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার পর তারা এখন নতুন উৎসাহে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। নারী প্রার্থীর সংখ্যা বেড়েছে, যদিও তাদের অনেককে সাইবার হয়রানির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তবুও এ অংশগ্রহণ জাতীয় রাজনীতিতে নারীর প্রতিনিধিত্বকে আরো শক্তিশালী করার ইঙ্গিত বহন করছে। তরুণ ভোটারদের ভূমিকা সবসময়ই ক্ষমতার ভারসাম্যে বড় ভূমিকা রাখে। তাদের রাজনৈতিক অবস্থান আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে নির্ধারক হতে পারে।
ডাকসু নির্বাচনের প্রভাব সরাসরি জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলে প্রতিফলিত নাও হতে পারে, তবে এর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব অনেক গভীর। বিজয়ী ছাত্র সংগঠনগুলো আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে এবং নিজেদের সাফল্যের অভিজ্ঞতা জাতীয় প্রচারণায় কাজে লাগাবে। অপরদিকে পরাজিত পক্ষ নিজেদের কৌশল পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হবে। ফলে জাতীয় নির্বাচনের আগে এই নির্বাচন দলগুলোর জন্য এক ধরনের মানসিক লড়াই এবং সাংগঠনিক প্রস্তুতির অনুশীলন।
বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খান মনে করেন, ডাকসুর ফলাফল তরুণদের রাজনৈতিক চেতনা ও দিকনির্দেশনায় প্রভাব ফেলবে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকে। চব্বিশের আন্দোলন যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শুরু হয়েছিল, তেমনি এবারও ডাকসু থেকে নতুন নেতৃত্ব উঠে আসতে পারে যারা জাতীয় নির্বাচনের সমীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
জাতীয় নির্বাচনের সামনে দাঁড়িয়ে ডাকসু নির্বাচনের তাৎপর্য বহুমাত্রিক। একদিকে এটি নিরপেক্ষ সরকারের সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের সক্ষমতার প্রমাণ হবে। অন্যদিকে এটি তরুণ ভোটারদের রাজনৈতিক ঝোঁক বোঝার সুযোগ তৈরি করবে। বিজয়ী পক্ষ জাতীয় নির্বাচনে নিজেদের প্রচারণায় ডাকসুর সাফল্যকে তুলে ধরবে, আর এভাবে ভোটারদের মনে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করবে।
তরুণরা ঐতিহাসিকভাবে ক্ষমতার বিপরীতে থাকে। এ কারণে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ডাকসু নির্বাচনে সরকার সমর্থিত কোনো সংগঠন ভালো ফল করতে পারবে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এবার যেহেতু নির্বাচন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হচ্ছে, তাই এটি হবে সত্যিকারের প্রতিযোগিতা। আর এই প্রতিযোগিতা জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য মর্যাদার লড়াইয়ে পরিণত হবে।
সর্বশেষে বলা যায়, ডাকসু নির্বাচন জাতীয় রাজনীতির জন্য এক প্রতীকী সূচক। এটি দেখাবে তরুণদের রাজনৈতিক অভিমুখ কোন দিকে যাচ্ছে এবং কোন শক্তি ভবিষ্যতের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে ডাকসু তাই এক প্রকার পরীক্ষাগার, যেখানে দলগুলো নিজেদের শক্তি ও দুর্বলতা যাচাই করবে। যদিও এটি জাতীয় নির্বাচনের সঠিক পূর্বাভাস নয়, তবুও ডাকসুর ফলাফল দেশের রাজনীতিতে একটি মনস্তাত্ত্বিক ও সাংগঠনিক দিকনির্দেশনা প্রদান করবে, যা জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।
আপনার মতামত জানানঃ