মহাবিশ্বের সূচনা থেকেই মানুষ তার রহস্য খুঁজে ফিরছে। আকাশের নক্ষত্রমালা, গ্যালাক্সি কিংবা অসীম শূন্যতা—সবকিছুর মধ্যেই লুকিয়ে আছে জন্মের গল্প। সেই গল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলো ব্ল্যাক হোল। সাধারণত আমরা জানি, বিশাল কোনো নক্ষত্র সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে ধ্বংস হলে তার কেন্দ্রে সৃষ্টি হয় ব্ল্যাক হোল। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা জানাচ্ছে, হয়তো এমন কিছু ব্ল্যাক হোল রয়েছে, যেগুলো কোনো নক্ষত্রের মৃত্যুর ফল নয়, বরং মহাবিশ্বের জন্মলগ্নেই তৈরি হয়েছিল। এই আবিষ্কার মহাবিশ্ব বোঝার পদ্ধতিকে নতুন আলোচনার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের সাহায্যে এমন এক প্রাচীন ব্ল্যাক হোলের সন্ধান পেয়েছেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক রোবার্তো মাইওলিনো এবং তাঁর সহকর্মীরা জানাচ্ছেন, তারা একটি ক্ষুদ্র লাল বিন্দু বা QSO1-এ ব্ল্যাক হোলের উপস্থিতি শনাক্ত করেছেন। এর বিশেষত্ব হলো, এই ব্ল্যাক হোলের চারপাশে কোনো গ্যালাক্সি নেই। সাধারণভাবে ব্ল্যাক হোলের অবস্থান থাকে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে। ফলে এই আবিষ্কার প্রচলিত ধারণাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।
গবেষকেরা জানিয়েছেন, তারা সরাসরি বিগ ব্যাংয়ের একেবারে প্রথম মুহূর্তের প্রমাণ পাননি। তবে এই ব্ল্যাক হোলকে দেখা গেছে মহাবিশ্বের জন্মের আনুমানিক ৭০ কোটি বছর পর। মহাজাগতিক পরিমাপে এটি অত্যন্ত প্রাচীন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই ব্ল্যাক হোলের ভর প্রায় ৫০ কোটি সৌর ভর। অর্থাৎ সূর্যের ভরের ৫০ কোটি গুণ। আশপাশের বস্তুগুলোর ভরের তুলনায় এটি দ্বিগুণ বেশি। তুলনামূলকভাবে আমাদের ছায়াপথ মিল্কিওয়ের ব্ল্যাক হোল তার গ্যালাক্সির চেয়ে অনেক ছোট। অথচ এখানে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র।
আরও বিস্ময়কর হলো, এর চারপাশে পাওয়া গেছে কেবল হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম—যেগুলো মহাবিশ্বের আদিম মৌল। কার্বন, অক্সিজেন বা লোহা তৈরি হয়েছিল অনেক পরে নক্ষত্রের জন্ম ও বিস্ফোরণের মাধ্যমে। তাই ধারণা করা হচ্ছে, এই ব্ল্যাক হোল গ্যালাক্সির জন্মের আগেই তৈরি হয়েছিল। এ ঘটনা মহাবিশ্বের বিবর্তন সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত ধারণাকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করছে।
এই আবিষ্কার প্রমাণ করতে পারলে এটি হবে প্রাইমর্ডিয়াল ব্ল্যাক হোল বা আদিম ব্ল্যাক হোলের প্রথম প্রত্যক্ষ প্রমাণ। বহু দশক ধরে বিজ্ঞানীদের মধ্যে এ নিয়ে বিতর্ক ছিল। কেউ মনে করতেন, মহাবিস্ফোরণের পরপরই কিছু অঞ্চলে পদার্থের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্ল্যাক হোল তৈরি হয়েছিল। এগুলো গ্রহের সমান কিংবা একটি পরমাণুর আকারের হতে পারে। তবে এত দিন পর্যন্ত কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছিল না।
তবে এই আবিষ্কার এখনও প্রাথমিক। ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকাশবিদ অ্যান্ড্রু পন্টজেন সতর্ক করে বলেছেন, এটি চূড়ান্ত প্রমাণ নয়। গবেষকেরা যে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, তা এখনো পরোক্ষ প্রমাণের ওপর দাঁড়িয়ে। তবু তিনি আশাবাদী, আগামী দশকে নতুন প্রজন্মের মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ শনাক্তকারী যন্ত্র মহাবিশ্ব জুড়ে ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ব আরও স্পষ্ট করে তুলতে পারবে। তখন হয়তো বিতর্কের অবসান ঘটবে।
আদিম ব্ল্যাক হোল সত্যিই থাকলে তা শুধু ব্ল্যাক হোল সম্পর্কিত ধারণাই পাল্টাবে না, বরং মহাবিশ্বের জন্ম ও বিবর্তন সম্পর্কেও নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। আমরা জানতে পারব, মহাবিশ্বের প্রথম কয়েক সেকেন্ডে কী ঘটেছিল। এই জ্ঞান কেবল বৈজ্ঞানিক কৌতূহল মেটাবে না, বরং আমাদের অস্তিত্ব সম্পর্কেও গভীর প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেবে।
মানুষ বহু যুগ ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে জানতে চেয়েছে, আমরা কোথা থেকে এসেছি, মহাবিশ্ব কীভাবে শুরু হয়েছিল, আমাদের ভবিষ্যৎ কী। প্রাচীন ব্ল্যাক হোলের এই আবিষ্কার সেই উত্তর খোঁজার যাত্রায় এক বড় পদক্ষেপ। এটি প্রমাণ করলে আমাদের মহাজাগতিক ইতিহাস নতুন করে লিখতে হবে। হয়তো আগামী প্রজন্ম নিশ্চিত করে বলতে পারবে, মহাবিশ্বের জন্মলগ্নেই ব্ল্যাক হোল জন্ম নিয়েছিল। আর তখন মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের সব ধারণা নতুন রূপ নেবে।
আপনার মতামত জানানঃ