
মানব ইতিহাসের গভীর অতীতে ফিরে তাকালে আমরা দেখি, আমাদের প্রাচীন আত্মীয়রা কেবলমাত্র টিকে থাকার জন্য প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং তারা পরিকল্পনা করে সম্পদ ব্যবহার ও সংগ্রহের কৌশলও আয়ত্ত করেছিল। নিয়ায়াঙ্গা নামক এক পুরাতাত্ত্বিক স্থানে পাওয়া ৪০১টি পাথরের হাতিয়ার সেই প্রমাণকে স্পষ্ট করে তুলেছে। প্রায় ৩০ লাখ থেকে ২৬ লাখ বছর আগের এই হাতিয়ারগুলো শুধু প্রাথমিক যন্ত্রই নয়, বরং প্রমাণ করে যে তখনকার প্রাইমেটরাও দীর্ঘ পরিকল্পনা করে কাজ করত।
এই হাতিয়ারগুলোর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক দিক হলো এগুলোর উৎস। বেশির ভাগ পাথরই পাওয়া গেছে নিয়ায়াঙ্গা থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত অঞ্চল থেকে। অর্থাৎ, হাতিয়ার তৈরির জন্য কেবল স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য উপাদান ব্যবহার না করে দূর থেকে কাঁচামাল আনার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। আধুনিক মানুষের উদ্ভবের প্রায় ৬ লাখ বছর আগেই এ ধরনের আচরণ প্রমাণ করে যে প্রাচীন প্রাইমেটদের মধ্যেও পরিকল্পনাশক্তি ও দূরদর্শিতা বিকশিত হয়েছিল।
গবেষকেরা মনে করেন, এই হাতিয়ারগুলো তৈরি হয়েছিল ওল্ডোওয়ান নামের প্রাচীন কৌশলে। এই কৌশলে একটি পাথরের সাহায্যে আরেকটি পাথর ধাপে ধাপে ভেঙে ধারালো প্রান্ত তৈরি করা হতো। এটি সহজ শোনালেও এর পেছনে ছিল সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ও ধৈর্য। গবেষণা বলছে, খাবার সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করার প্রয়োজনেই এই হাতিয়ার ব্যবহৃত হতো। এর মানে হলো, তারা শুধু টিকে থাকার লড়াই করছিল না, বরং খাবার প্রাপ্তির জন্য পরিবেশকে নিজেদের মতো করে কাজে লাগানোর চিন্তা করেছিল।
অন্যদিকে, শিম্পাঞ্জিদের সঙ্গে তুলনা করলে পার্থক্যটি স্পষ্ট হয়। শিম্পাঞ্জিরাও পাথর ব্যবহার করে বাদাম ভাঙতে পারে, তবে তারা সর্বোচ্চ ২ কিলোমিটার পর্যন্ত পাথর বহন করতে সক্ষম। সেটিও একটানা নয়; বরং ধাপে ধাপে ছোট দূরত্বে। কিন্তু নিয়ায়াঙ্গার এই প্রাচীন প্রাইমেটরা প্রায় ১০ কিলোমিটার দূর থেকে পাথর সংগ্রহ করেছে, যা একেবারেই ভিন্নতর আচরণের ইঙ্গিত দেয়।
প্রায় ৩৩ লাখ বছর আগেই মানুষের আদি আত্মীয়েরা হাতিয়ার তৈরি করেছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে সেই সময়ের পাথর স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা হতো বা সর্বোচ্চ ৩ কিলোমিটার দূর থেকে পাওয়া যেত। কিন্তু নিয়ায়াঙ্গার আবিষ্কার প্রমাণ করে, পরিকল্পনা করে দূর থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করার প্রবণতা আরও আগেই শুরু হয়েছিল।
গবেষক রিক পটস বলেছেন, ওল্ডোওয়ান সংস্কৃতির প্রকৃত উদ্ভাবন ছিল সম্পদ বহনের কৌশল। খাবারের উৎসে পাথর নিয়ে যাওয়ার জ্ঞান ও উদ্দেশ্য তাদের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল। এটি ইঙ্গিত দেয় যে তারা নিজেদের চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে মানসিক মানচিত্র তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল।
প্রায় ২০ লাখ বছর আগে হোমো ইরেকটাস মানব পূর্বপুরুষেরা তাদের জীবনধারায় বড় পরিবর্তন আনতে শুরু করে। তাদের মস্তিষ্ক বড় হয়, শরীরের গঠন বদলায়, তারা আফ্রিকার বাইরে অভিবাসন শুরু করে এবং রান্না করে মাংস খাওয়ার প্রথা চালু হয়। এ সময় থেকেই তারা পাথর বেছে নেওয়া ও দূর থেকে সংগ্রহ করার অভ্যাস গড়ে তোলে। তবে নিয়ায়াঙ্গার এই হাতিয়ারগুলো হোমো ইরেকটাস যুগেরও অনেক আগের, যা আমাদের বলে দেয়—প্রাচীন প্রাইমেটরাও এই ক্ষমতা অর্জন করেছিল।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, নিয়ায়াঙ্গায় পাওয়া হাতিয়ারগুলো কারা তৈরি করেছিল? এখনো কোনো ফসিলের সঙ্গে সরাসরি হাতিয়ার পাওয়া যায়নি বলে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কিছু জীবাশ্ম থেকে ধারণা করা হচ্ছে, এগুলো প্যারানথ্রোপাস নামের এক প্রজাতির কাজ। গবেষক এমা ফিনস্টোন বলেন, হাতিয়ার হাতে প্রজাতির ফসিল না পাওয়া পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়।
এই আবিষ্কার মানব ইতিহাসে এক নতুন আলো ফেলেছে। এটি আমাদের জানায়, অভিযোজনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রাচীন প্রাইমেটরা টুল বা যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল ছিল। মানুষের বিবর্তনের শুরু থেকেই টুল ব্যবহারের এই ধারা আজকের প্রযুক্তিনির্ভর যুগেও আমাদের জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।
এই ঘটনাটি মানবজাতির বুদ্ধিবৃত্তিক যাত্রার এক প্রাচীনতম প্রমাণ হিসেবে কাজ করছে। দীর্ঘ পরিকল্পনা, সম্পদের উৎস সম্পর্কে সচেতনতা, এবং প্রয়োজনীয় উপাদান দূর থেকে আনার ক্ষমতা—এসবই মানুষের সাংস্কৃতিক ও মানসিক বিকাশের মূলভিত্তি। তাই নিয়ায়াঙ্গার এই আবিষ্কার কেবল প্রাগৈতিহাসিক যুগের একটি তথ্য নয়, বরং মানুষের দীর্ঘ অভিযোজন ইতিহাসের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
আপনার মতামত জানানঃ