অস্ট্রেলিয়ার সাম্প্রতিক এক গবেষণা আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান জগতে আলোচনার ঝড় তুলেছে। কারণ এই গবেষণায় উঠে এসেছে এমন এক তথ্য, যা প্রচলিত জীববিজ্ঞানের ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। দক্ষিণ-পূর্ব কুইন্সল্যান্ড অঞ্চলে প্রায় পাঁচশোটি বন্য পাখির উপর করা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তাদের প্রজনন অঙ্গ এবং জেনেটিক লিঙ্গের মধ্যে বিস্ময়কর অমিল রয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ঘটনা হলো—একটি জেনেটিকভাবে পুরুষ কুকাবুরাকে (Laughing Kookaburra) ডিম পাড়তে দেখা গেছে। বিষয়টি এতটাই অস্বাভাবিক যে, গবেষকরা বারবার পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছেন, এটি কোনো ভুল নয় বরং বাস্তব ঘটনা।
গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন ইউনিভার্সিটি অব দ্য সানশাইন কোস্টের সহযোগী অধ্যাপক এবং আচরণবিজ্ঞানী ড. ডমিনিক পটভিন। গত আগস্টে সম্মানজনক সাময়িকী বায়োলজি লেটারস-এ এটি প্রকাশিত হয়। গবেষক দলটি মূলত এমন সব পাখিকে নিয়ে কাজ করেন, যারা আঘাতপ্রাপ্ত বা অসুস্থ অবস্থায় বন্যপ্রাণী হাসপাতালে এসেছিল এবং পরে মৃত্যুবরণ করলে তাদের ডিএনএ পরীক্ষা ও শারীরবৃত্তীয় বিশ্লেষণ করা হয়।
ফলাফলে দেখা যায়, প্রায় ৬ শতাংশ পাখির জেনেটিক লিঙ্গ এবং দেহের প্রজনন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অমিল আছে। কেউ জেনেটিকভাবে পুরুষ হলেও স্ত্রী প্রজনন অঙ্গ বহন করছে, আবার কেউ জেনেটিকভাবে নারী হলেও পুরুষ বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছে। কিছু ক্ষেত্রে একসাথে অণ্ডকোষ ও ডিম্বাশয়ের মতো গঠন পাওয়া গেছে। ড. পটভিনের ভাষায়—“আমাদের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার ছিল, যেসব পাখির লিঙ্গ বদল হয়েছিল তাদের ৯২ শতাংশই আসলে জেনেটিকভাবে নারী, কিন্তু তাদের প্রজনন অঙ্গ ছিল পুরুষের মতো।”
সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী উদাহরণটি ছিল কুকাবুরা পাখি। পিসিআর পরীক্ষায় নিশ্চিত হয়, এটি জেনেটিকভাবে পুরুষ (পাখির ক্ষেত্রে ZZ ক্রোমোজোম), কিন্তু এর দেহে ফুলে থাকা ওভিডাক্ট ও বড় আকারের ফোলিকল পাওয়া গেছে, যা স্পষ্টভাবে সাম্প্রতিক ডিম উৎপাদনের প্রমাণ দেয়। অর্থাৎ এটি ডিম পেড়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, পাখিদের জগতে এটি প্রায় নজিরবিহীন।
প্রকৃতপক্ষে লিঙ্গ পরিবর্তন বা সেক্স রিভার্সাল প্রাণিজগতে নতুন কিছু নয়। মাছ, সরীসৃপ কিংবা উভচর প্রাণীর মধ্যে এ ঘটনা বহুলভাবে প্রমাণিত। তবে পাখিদের ক্ষেত্রে বিষয়টি এতদিন বিরল বলে মনে করা হতো। গবেষণা বলছে, ধারণার চেয়ে অনেক বেশি নমনীয় তাদের লিঙ্গ নির্ধারণ প্রক্রিয়া। এমনকি প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থাতেও তা পরিবর্তিত হতে পারে।
গবেষণার ফল শুধু বৈজ্ঞানিক কৌতূহল বাড়ায়নি, বরং সংরক্ষণবিদদের জন্যও গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। কারণ এখন পর্যন্ত পাখির লিঙ্গ নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা সাধারণত ডিএনএ পরীক্ষা, পালকের রং কিংবা আচরণের উপর নির্ভর করতেন। কিন্তু যদি ৬ শতাংশ ক্ষেত্রেই তা ভুল হওয়ার ঝুঁকি থাকে, তবে বিপন্ন প্রজাতির সংরক্ষণে বড় ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। সঠিক পুরুষ-নারী অনুপাতের হিসাব না থাকলে প্রজনন হার কমে যেতে পারে, ফলে জনসংখ্যার ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে।
প্রশ্ন হলো, কী কারণে এই লিঙ্গ পরিবর্তন ঘটছে? গবেষণা এখনো নির্দিষ্ট কারণ চিহ্নিত করতে পারেনি। তবে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, পরিবেশগত কিছু উপাদান দায়ী হতে পারে। বিশেষ করে এন্ডোক্রাইন ডিসরাপ্টর নামের কিছু রাসায়নিক পদার্থ, যেগুলো হরমোনের স্বাভাবিক কার্যক্রম নষ্ট করে। এই ধরনের রাসায়নিক আধুনিক নগরায়িত এলাকায় বেশি থাকে, যেখানে কৃষিজ কীটনাশক, শিল্প বর্জ্য বা প্লাস্টিকজাত পদার্থ পরিবেশে মিশে যায়। উল্লেখযোগ্যভাবে, যে পুরুষ কুকাবুরাটি ডিম পেড়েছিল সেটিও পাওয়া গিয়েছিল আধা-নগরায়িত এলাকায়।
এই বিষয়টি শুধু পাখিদের ক্ষেত্রেই নয়, বরং মানুষের জন্যও একটি সতর্কবার্তা। কারণ একই ধরনের রাসায়নিক মানুষের শরীরেও হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। ফলে লিঙ্গ নির্ধারণ, প্রজনন ক্ষমতা ও সামগ্রিক স্বাস্থ্যে এর প্রভাব পড়তে পারে।
অবশ্য গবেষকরা এটাও স্বীকার করেছেন যে, তাদের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে আহত বা অসুস্থ পাখির মধ্যে থেকে। সুতরাং সাধারণ সুস্থ বন্য পাখিদের মধ্যেও একই হারে এ ধরনের ঘটনা ঘটে কি না, তা জানতে আরও বিস্তৃত গবেষণা প্রয়োজন। তবুও এই গবেষণা প্রথমবারের মতো শক্ত প্রমাণ দিল যে, প্রাপ্তবয়স্ক পাখিদের লিঙ্গ পরিবর্তন সম্ভব এবং এটি অপ্রত্যাশিত হলেও অস্বাভাবিক নয়।
এই আবিষ্কার ভবিষ্যতের জীববিজ্ঞান গবেষণায় নতুন দিগন্ত খুলে দিল। সংরক্ষণকাজে এখন হয়তো নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। কেবল জেনেটিক বা বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর না করে শারীরবৃত্তীয় দিক থেকেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হতে পারে। অন্যদিকে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং রাসায়নিক পদার্থের প্রভাব নিয়ে আরও গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।
সব মিলিয়ে এই ঘটনাটি আবারও মনে করিয়ে দিল—প্রকৃতি সবসময় আমাদের কল্পনার চেয়েও জটিল এবং বিস্ময়কর। আমরা হয়তো ভেবেছিলাম, পাখিদের লিঙ্গ নির্ধারণ কঠোরভাবে স্থির ও অপরিবর্তনীয়। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, জীবন ও জীববিজ্ঞানের জগৎ অনেক বেশি নমনীয়, যেখানে নিয়ম ভাঙা এবং নতুন ব্যাখ্যা খুঁজে নেওয়ার সুযোগ সবসময় থাকে।
একটি জেনেটিক পুরুষ কুকাবুরার ডিম পাড়া কেবল একটি কৌতূহলজনক সংবাদ নয়, বরং আমাদের বিজ্ঞানচিন্তাকে নতুনভাবে ভাবতে শেখাচ্ছে। এটি প্রমাণ করে, প্রকৃতির কাছে এখনও অসংখ্য অজানা রহস্য রয়ে গেছে, যা ভবিষ্যতের গবেষণার হাত ধরেই উন্মোচিত হবে।
আপনার মতামত জানানঃ