ইসলামপন্থী রাজনীতি ও আন্দোলনের ইতিহাস শুধু ধর্মীয় অনুভূতির বিষয় নয়, বরং এটি জটিল সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আজকের বিশ্বে ইসলামিস্টদের আগ্রাসী হয়ে ওঠা একটি বাস্তবতা, যা বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক অঙ্গন, রাষ্ট্রনীতি, নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং সামাজিক জীবনে বড় প্রভাব ফেলছে। কেন ইসলামিস্টরা এত আগ্রাসী হয়ে ওঠে, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে কয়েকটি প্রেক্ষাপট একসঙ্গে বিবেচনা করতে হয়।
বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনীতির উত্থানকে দেখা যায় স্বাধীনতার পর থেকেই। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু সত্তরের দশকের শেষ ভাগে সামরিক শাসনের সময় ইসলামকে রাজনৈতিকভাবে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। আশির দশকে সামরিক সরকার ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে। এর ফলে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ইসলামিস্টদের বৈধতা বেড়ে যায়। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির, এবং পরবর্তী সময়ে হেফাজতে ইসলাম—সবগুলো সংগঠন বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব খাটিয়েছে। ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের ঘটনাই প্রমাণ করে, কীভাবে ইসলামিস্ট গোষ্ঠীগুলো অল্প সময়ের মধ্যে সংগঠিত হয়ে রাজধানী ঢাকার মতো শহরে বিশাল সমাবেশ ঘটাতে সক্ষম হয়।
বাংলাদেশে ইসলামিস্টদের আগ্রাসী হয়ে ওঠার একটি বড় কারণ হচ্ছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনা। দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনেকেই বেকার, হতাশ, এবং সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ইসলামিস্ট গোষ্ঠীগুলো তাদের সামনে এমন এক কল্পচিত্র হাজির করে, যেখানে “ইসলামী শাসন” প্রতিষ্ঠিত হলে সব সমস্যা মিটে যাবে। উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়—২০০৫ সালে একযোগে দেশের ৬৩ জেলায় জেএমবির বোমা হামলা তরুণদের উগ্রপন্থার দিকে টেনে নেওয়ার চরম উদাহরণ। একইভাবে, ২০১৬ সালের গুলশান হলি আর্টিজান হামলায় উচ্চশিক্ষিত তরুণদের জড়িত থাকা প্রমাণ করে যে, শুধু দারিদ্র্য নয়, বরং এক ধরনের মানসিক শূন্যতা ও পরিচয়ের সংকট থেকেও অনেকে ইসলামিস্ট সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে।
এদিকে বিশ্বের প্রেক্ষাপটেও একই প্রবণতা দেখা যায়। আফগানিস্তানে তালেবানদের উত্থান কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে আইএস-এর উত্থান—সব জায়গায় ইসলামিস্ট গোষ্ঠীগুলো নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়েছে আগ্রাসী কায়দায়। ২০০১ সালের যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলা ইসলামিস্ট উগ্রবাদের এক ভয়ংকর দৃষ্টান্ত, যা পুরো বিশ্বের নিরাপত্তা রাজনীতিকে পাল্টে দিয়েছে। এর পর থেকে “ওয়ার অন টেরর” নামে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব যুদ্ধে জড়ায়, যার ফলে আবারও মুসলিম সমাজের মধ্যে “আমরা বনাম তারা” ধারণা দৃঢ় হয়। আফগানিস্তান ও ইরাকে দীর্ঘ যুদ্ধ, পাকিস্তানে ড্রোন হামলা—এসবের ফলে ইসলামিস্টরা আরও আগ্রাসী হয়ে ওঠে, কারণ তারা এসবকে পশ্চিমাদের আগ্রাসন হিসেবে ব্যাখ্যা করে।
তবে আগ্রাসনের মূল চালিকাশক্তি শুধু ধর্ম নয়, বরং ধর্মকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যেমন—সৌদি আরব ইসলামকে ব্যবহার করে ক্ষমতার বৈধতা তৈরি করেছে, আবার ইরান শিয়া মতাদর্শকে রাষ্ট্রের কেন্দ্রে স্থাপন করেছে। এর ফলে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক আগ্রাসন শুধু উগ্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণেও প্রতিফলিত হয়।
বাংলাদেশে ইসলামিস্টদের আগ্রাসনের আরেকটি দিক হলো নারীর অধিকার, শিক্ষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত। ১৯৯০ ও ২০০০ সালের শুরুর দিকে গ্রামে-গঞ্জে ইসলামিস্টরা নারীশিক্ষা ও এনজিও কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। আজও সামাজিক মাধ্যমে নারীদের স্বাধীনতা নিয়ে ইসলামিস্ট গোষ্ঠীগুলোর আক্রমণাত্মক মন্তব্য লক্ষ্য করা যায়। আবার হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি স্পষ্টভাবে নারীর অধিকার খর্ব করার প্রচেষ্টা ছিল।
আগ্রাসী হওয়ার আরেকটি কারণ মনস্তাত্ত্বিক। ইসলামিস্টরা প্রায়ই অতীতের এক গৌরবময় ইসলামী সভ্যতার কথা বলে, যেখানে মুসলিমরা সারা বিশ্বের নেতৃত্ব দিত। তারা বর্তমানের সংকটকে সেই অতীতের বিপরীতে দাঁড় করায়। তরুণরা যখন বর্তমান সমাজে হতাশ হয়, তখন এই কল্পিত গৌরবের ইতিহাস তাদের মনে আগ্রাসী মনোভাব তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যপ্রাচ্যে আইএস-এর প্রচারমাধ্যম “দাবিক” তরুণদের সামনে এমন এক চিত্র হাজির করত, যেখানে তারা অংশ নিলেই “খিলাফত” প্রতিষ্ঠার বীর সৈনিক হবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইসলামিস্টদের আগ্রাসী হওয়া আরেকভাবে বোঝা যায় রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায়। বড় দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংঘাতময় রাজনীতির কারণে ইসলামপন্থী দলগুলোকে বারবার “কিংমেকার” হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এ সুযোগে তারা নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করেছে। ২০০১ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোটে জামায়াতে ইসলামীকে শরিক করার ঘটনা এর বড় উদাহরণ। আবার ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে ইসলামিস্টদের আক্রমণও ছিল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রণোদিত।
বিশ্ব প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক তথ্যও প্রমাণ করে ইসলামিস্ট আগ্রাসনের বিস্তার। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে আফ্রিকায় আল-শাবাব ও বোকো হারামের হামলায় হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। এদিকে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর আফগানিস্তানে নারী শিক্ষা বন্ধ হয়ে গেছে, যা এক ধরনের সামাজিক আগ্রাসনের নমুনা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ২০২৪ সালের গোড়ায় নিরাপত্তা বাহিনী কয়েকটি উগ্র গোষ্ঠীর পরিকল্পিত হামলা ঠেকিয়েছে—এমন খবর পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে।
সব মিলিয়ে দেখা যায়, ইসলামিস্টদের আগ্রাসী হয়ে ওঠার কারণ বহুমাত্রিক। একদিকে আছে ঐতিহাসিক ক্ষোভ, অন্যদিকে রাজনৈতিক কৌশল। আছে সামাজিক বঞ্চনা, আবার আছে মনস্তাত্ত্বিক পরিচয় সংকট। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশ্ব রাজনীতির শক্তির দ্বন্দ্ব। ফলে আগ্রাসন শুধু ধর্মীয় আবেগের ফল নয়, বরং ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তারের হিসাব-নিকাশের অংশ।
বাংলাদেশ ও বিশ্বে এই আগ্রাসন যে সামাজিক স্থিতি ও নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তা স্পষ্ট। ২০১৬ সালের হলি আর্টিজান হামলার পর বাংলাদেশি সমাজ গভীরভাবে নাড়া খেয়েছে। আবার ইউরোপে একের পর এক সন্ত্রাসী হামলা প্রমাণ করেছে, ইসলামিস্ট আগ্রাসন শুধু মুসলিম বিশ্বের ভেতরেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং বৈশ্বিক প্রভাব ফেলছে। একই সময়ে ইসলাম ধর্মের শান্তিপূর্ণ দিক ও অধিকাংশ সাধারণ মুসলমানের জীবনযাত্রার সঙ্গে এই আগ্রাসী প্রবণতার কোনো মিল নেই।
আজকের দিনে সবচেয়ে জরুরি হলো ইসলামিস্ট আগ্রাসনের কারণগুলো গভীরভাবে বোঝা এবং সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পরিসরে এর সমাধানের পথ খোঁজা। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং রাজনৈতিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হলে আগ্রাসন ঠেকানো কঠিন হবে। একই সঙ্গে ধর্মীয় অনুভূতিকে রাজনৈতিকভাবে অপব্যবহার না করার ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। নচেৎ আগ্রাসী ইসলামপন্থা শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বের জন্য এক অব্যাহত হুমকি হয়ে থাকবে।
আপনার মতামত জানানঃ