এল সালভাদরের কুখ্যাত সিসোট কারাগারের ভেতরের জীবন যেন জীবন্ত মানুষের কবর। চারদিকের দেয়াল, বিদ্যুতায়িত বেড়া আর কঠোর নিরাপত্তায় ঘেরা এই বন্দিশালা মূলত ভয়ঙ্কর অপরাধী ও গ্যাংস্টারদের জন্য নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে এখানে ঠাঁই পেয়েছেন অনেক নিরীহ মানুষ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত ভেনেজুয়েলীয় অভিবাসীরা। তাদের অভিজ্ঞতার বিবরণ শুনলে মনে হয় তারা যেন এক অমানবিক পরীক্ষাগারে আটকে ছিলেন, যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকার, সম্মান এবং ন্যূনতম মানবিক আচরণ সবকিছুই কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
এই অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তারা এল সালভাদরের ভয়ঙ্কর গ্যাংয়ের সঙ্গে যুক্ত। বেশিরভাগের গায়ে ট্যাটু থাকায় তাদের অপরাধী বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু তারা একে একে বলছেন, কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে তারা জড়িত ছিলেন না। তাদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে হঠাৎ তুলে নিয়ে চোখ বেঁধে বিমানে চাপানো হয়, ধারণা ছিল ভেনেজুয়েলায় ফেরত পাঠানো হবে। কিন্তু বিমান থেকে নামার পর দেখা যায় তারা আনা হয়েছে এল সালভাদরে। সেখানেই শুরু হয় তাদের এক দুঃস্বপ্নময় জীবন।
কারাগারে প্রবেশের পরই তাদের নগ্ন করে মাথার চুল কামিয়ে দেওয়া হয়। পরে তাদের সবাইকে একরঙা সাদা পোশাক, সাদা রবারের জুতো পরানো হয়। ধাতব বিছানায় শোয়ার জন্য দেওয়া হয় কোনো চাদর বা তোশক ছাড়া। খেতে দেওয়া হয় হাত দিয়ে, কোনো চামচ-কাঁটাচামচ ব্যবহার করতে দেওয়া হতো না। ভাত, বিনস, পাস্তা আর টর্টিলার মতো খাবারই ছিল তাদের প্রতিদিনের রেশন। কখনও সামান্য কুকিজ দেওয়া হতো বিশেষ দিনে, তবে তা ছিল খুবই বিরল।
প্রতিটি সেলে ১০ থেকে ১৯ জন করে বন্দি রাখা হতো। সেলের ভেতর ছিল শুধু ধাতব বাঙ্ক, দুটো টয়লেট এবং দুটি পানির ট্যাঙ্ক। টয়লেট ব্যবহারে কোনো গোপনীয়তা ছিল না, সবাই একে অপরকে দেখতে পেত। দুর্গন্ধে সেলগুলো সবসময় ভরে থাকত। বাতাস চলাচলের কোনো ব্যবস্থা ছিল না, প্রচণ্ড গরমে বন্দিদের প্রায় দম বন্ধ হয়ে যেত। প্রহরীরা ইচ্ছাকৃতভাবে রাতে দেয়াল পিটিয়ে শব্দ করত যাতে কেউ ঘুমাতে না পারে। ২৪ ঘণ্টা আলো জ্বালানো থাকত, ফলে অন্ধকারে একটু বিশ্রামের সুযোগও ছিল না।
বন্দিদের বলা হতো এখানে কোনো আইনজীবী নেই, কোনো আদালত নেই, কোনো ফোন কল করার সুযোগ নেই। অর্থাৎ একবার ঢুকে পড়লে এখান থেকে জীবিত বের হওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। প্রহরীরা নিয়মিত বন্দিদের মারধর করত। একেকজনকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অস্বস্তিকর ভঙ্গিতে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো। সামান্য শব্দ করলে বা নিয়ম ভাঙলে কঠোর শাস্তি পেতে হতো। অনেকে অভিযোগ করেছেন, তাদের যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল ‘দ্য আইল্যান্ড’ নামে পরিচিত একটি বিশেষ কুঠুরি। এখানে বন্দিদের নিয়ে গিয়ে অন্ধকার সেলে মারধর করা হতো। কারও মাথায় লাঠি মারা হতো, কারও পাঁজর ভাঙা পর্যন্ত পেটানো হতো। কেউ কেউ রক্ত吐 করতেও শুরু করেছিল। অনেককে একাধিকবার সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একজন বন্দি জানিয়েছেন, তার সমকামী পরিচয়ের কারণে তাকে বিশেষভাবে টার্গেট করা হয়েছিল এবং শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি যৌন সহিংসতারও শিকার হয়েছেন।
মানবিক সহায়তা প্রদানকারী আন্তর্জাতিক রেড ক্রস দুইবার এই কারাগার পরিদর্শন করেছে। তখন সাময়িকভাবে বন্দিদের ভালো খাবার, চাদর, গদি দেওয়া হয়েছিল। এমনকি কিছু বন্দিকে মাঠে বের করে খেলাধুলা বা প্রার্থনায় অংশ নিতে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তা শুধুই ছবি তোলার জন্য। রেড ক্রস চলে যাওয়ার পর আবারও আগের মতো নির্যাতন শুরু হয়। বন্দিরা জানিয়েছেন, তাদের ভেতরের অবস্থা গোপন রাখতেই সব আয়োজন ছিল।
অভিবাসীদের কেউ কেউ প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিলেন। তারা নিজেদের রক্ত দিয়ে সাদা চাদরে লিখেছিলেন—“আমরা অভিবাসী, আমরা সন্ত্রাসী নই। সাহায্য করুন, আমাদের একজন আইনজীবী দরকার।” ওই চাদরগুলো সেলের গরাদের বাইরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রতিবাদের ফলাফল হয়েছিল ভয়ঙ্কর। প্রহরীরা মরিচের গুঁড়া ছুড়ে মেরেছিল, অনেকেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।
এই পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ট্রাম্প প্রশাসন ১৭৯৮ সালের পুরোনো একটি আইন ব্যবহার করে ভেনেজুয়েলীয় অভিবাসীদের প্রত্যর্পণ করেছে। সাধারণত এই আইন কেবল যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আদালত পরে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর কোনো সামরিক আক্রমণ হয়নি, তাই এভাবে মানুষদের নির্বাসিত করা বেআইনি। তবুও কয়েকশ অভিবাসীকে জোরপূর্বক এল সালভাদরে পাঠানো হয়েছিল।
তাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধমূলক রেকর্ড পাওয়া যায়নি। কারও বিরুদ্ধে ছোটখাটো ট্রাফিক আইন ভঙ্গের অভিযোগ ছিল, সেটিও পরে খারিজ হয়ে গিয়েছিল। অথচ ট্যাটুর কারণে বা কেবল সন্দেহের ভিত্তিতে তাদের বিপজ্জনক গ্যাংয়ের সঙ্গে যুক্ত বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। মার্কিন কর্মকর্তারা প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হলেও তাদের আটক ও প্রত্যর্পণ করা হয়।
চার মাসের অমানবিক জীবন কাটিয়ে সম্প্রতি ২৫২ জন ভেনেজুয়েলীয় অভিবাসী মুক্তি পেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে বন্দি থাকা মার্কিন নাগরিকদের বিনিময়ে তারা ছাড়া পান। দেশে ফেরার পর পরিবারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার মুহূর্তগুলো ছিল আবেগঘন। কেউ কাঁদছিলেন, কেউ খুশিতে আত্মীয়স্বজনকে জড়িয়ে ধরছিলেন। অনেকে আবার নতুন চশমা বা জামাকাপড় পেয়ে স্বস্তি পেয়েছেন, কারণ দীর্ঘদিন তারা কোনো মৌলিক সুবিধা পাননি।
কিন্তু মুক্তি পেলেও তাদের মনে ভয় এখনো বেঁচে আছে। একজন বলছিলেন, কোনো চাবির শব্দ শুনলেই মনে হয় আবার যেন প্রহরীরা এসে দরজা খুলে তাকে নিয়ে যাবে। আরেকজন বলছিলেন, শারীরিকভাবে মুক্ত হলেও মানসিকভাবে তারা এখনো সিসোটের ভেতর বন্দি। যেসব অমানবিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তারা গেছেন, সেগুলো রাতদিন তাদের মনে তাড়া করে ফিরছে।
এই অভিজ্ঞতাগুলো কেবল ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, বরং অভিবাসন নীতি ও মানবাধিকারের এক গভীর সংকটকেও সামনে নিয়ে এসেছে। মানুষদের যথাযথ তদন্ত ছাড়া অপরাধী ঘোষণা করা, তাদের কোনো আইনজীবী বা ন্যায়বিচারের সুযোগ না দিয়ে কারাগারে পাঠানো এবং অমানবিক নির্যাতনের শিকার করা—এসবই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের সরাসরি লঙ্ঘন।
সিসোট কারাগার তাই শুধু এল সালভাদরের নয়, বরং পুরো লাতিন আমেরিকার জন্য এক প্রতীকি জায়গা হয়ে উঠেছে। এটি দেখাচ্ছে কীভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, কঠোর অভিবাসন নীতি ও নিরাপত্তার অজুহাতে মানুষের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া যায়। বন্দিদের বর্ণনায় যে চিত্র উঠে এসেছে, তা মানব সভ্যতার জন্য লজ্জাজনক।
যারা ফিরে এসেছেন, তারা এখনো ভয়ের মধ্যে আছেন, কিন্তু একইসঙ্গে দৃঢ় প্রতিজ্ঞও হয়েছেন যে তাদের অভিজ্ঞতা অন্যদের জানাবেন। কেউ তথ্যচিত্র বানাতে চান, কেউ আবার বই লিখতে চান। তারা বিশ্বাস করেন, সত্য প্রকাশ পেলেই হয়তো ভবিষ্যতে আর কাউকে এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে না।
তাদের কথায় পরিষ্কার যে সিসোট ছিল তাদের জন্য এক নরক, যেখানে তারা মানুষ থেকেও নিচে নেমে গিয়েছিলেন। প্রহরীদের চোখে তারা কেবল সংখ্যা, কেবল সন্দেহভাজন অপরাধী। অথচ বাস্তবে তারা ছিল কেবল স্বপ্ন খুঁজতে যাওয়া অভিবাসী, যারা শেষ পর্যন্ত পরিণত হয়েছেন এক রাজনৈতিক খেলার বলি।
আপনার মতামত জানানঃ