
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মঈনুদ্দীন মন্ডলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকল্প ও অনুদান বিতরণে নয়-ছয়, সর্বত্রই অস্বচ্ছতা, সহকারী হিসাবরক্ষক পদে নিয়োগে অনিয়ম, ভুয়া প্রকল্প তৈরি করে লাখ লাখ টাকা তছরুপসহ আরো অজস্র অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি হবার সুবাধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতি আর অনিয়ম করে যাচ্ছেন দেদারছে। তিনি কারও জবাবদিহিতার ধার ধারেন না। পরিষদের চেয়ারম্যান মঈনুদ্দীন মন্ডলের বেহিসাবী কর্মকাণ্ডের কারণে ডুবতে বসেছে এ প্রতিষ্ঠানটি। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছাড়াও পরিষদের সদস্য, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। পরিষদের সদস্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে চেয়াম্যান এক দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট তৈরী করেছেন। চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই সিন্ডিকেট নিজেদের ইচ্ছেমতো অনিয়ম আর দুর্নীতি নামক ঘোড়ায় দাবড়ে বেড়াচ্ছেন। সিন্ডিকেটের বিভিন্ন অনিয়ম আর দুর্নীতিতে জর্জরিত জেলা পরিষদ। এবিষয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
একাধিক অভিযোগ থেকে জানা যায়, গত কয়েক বছরে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মঈনুদ্দীন মন্ডল ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন। তিনি প্রকল্পের বিপুল অংকের টাকা নয়ছয় করেছেন। এ ছাড়াও সরকারি অনুদান বণ্টনে হয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি। তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের রাজমহল সিনেমা হলের কাছে জমি কিনে পাঁচতলা বিশাল বাড়ি বানিয়েছেন। অথচ তার বৈধ আয়ের অন্য কোনো উৎস নেই। তার অনিয়মের সহযোগী হিসাবে সদস্য কামাল উদ্দিনের নামও এসেছে। কামাল উদ্দিন একজন বিএনপি নেতা। সদস্য শাহিদা রেখা জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের নামে অনুদান নিয়ে নিজের বাড়ি করেছেন। নারী সদস্য সান্তনা ও হালিমার বিরুদ্ধেও অনুদানের অর্থ তছরুপের অভিযোগ উঠেছে।
জানা যায়, চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে জেলা পরিষদে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী একটি দুর্নীতিবাজ চক্র। তাদের অন্যতম হলেন সহকারী প্রকৌশলী মোহায়েদুল ইসলাম। তার বিরুদ্ধে জলবায়ু প্রকল্প থেকে শুরু করে সোলার লাইট প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এক লাখ টাকার কাজে তিন হাজার টাকা ঘুষ না দিলে তিনি টাকা ছাড় দেন না। প্রকল্প দেখতে গেলে দিতে হয় পাঁচ হাজার টাকা। অথচ সরকারি অনুদানের প্রকল্পগুলোর অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছে না দুদক।
সরকারিভাবে ই-টেন্টার ব্যবস্থা চালু বাধ্যতামূলক হলেও ভুয়া ও আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে ম্যানুয়াল টেন্ডার করেন। এভাবে পছন্দের লোকেদের কাজ দেন। তবে মোহায়েদুল ইসলাম তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো অস্বীকার করেছেন। জেলা পরিষদের প্রধান সহকারী রমজান আলীর বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক।
রাজশাহী মহানগরীতে ৮০ লাখ টাকা মূল্যে জমি ক্রয় ও কয়েক কোটি টাকা দিয়ে বাড়ি নির্মাণের অভিযোগ করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। ২০১৭ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রধান সহকারী পদের পাশাপাশি রমজান আলী হিসাবরক্ষকের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে অসংখ্য ভুয়া প্রকল্প তৈরি করে বিপুল অর্থ কামিয়েছেন ও অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করেছেন।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদন ছাড়াও দুদকে পাঠানো স্থানীয়দের অভিযোগ থেকে জানা যায়, গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে সহকারী হিসাবরক্ষক পদে মামুন অর রশিদ নামে একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগ কমিটির ছয় সদস্যের অধিকাংশই অনুপস্থিত থাকলেও দুর্নীতির মাধ্যমে ওই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। যাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তার শিক্ষাগত সনদেও রয়েছে গরমিল। দারুল ইহসান নামের বাতিল হওয়া একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি দুদক ছাড়াও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তদন্ত করছে।
রাজশাহী সমন্বিত দুদক কার্যালয়ের উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর হোসেন যুগান্তরকে জানিয়েছেন, তারা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা পরিষদের দাপ্তরিক বহুমাত্রিক অনিয়ম দুর্নীতির অনুসন্ধান করছেন। এর মধ্যে কয়েকজন কর্মকর্তা -কর্মচারীর দুর্নীতি ও সম্পদের বিষয়েও অনুসন্ধান চলমান আছে।
জেলা পরিষদের কার্যক্রমে দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (উপ-সচিব) এনামুল হক বলেন, তিনি গত সেপ্টেম্বরে এখানে যোগ দিয়েছেন। দুদকসহ মন্ত্রণালয় থেকে জেলা পরিষদের বিভিন্ন কর্মকর্তা কর্মচারীর দুর্নীতি ও বিভিন্ন বিষয়ে অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন তৈরি করেছি। শিগগির এগুলো পাঠানো হবে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার সুবাধে তারই ছত্রছায়ায় সদস্য ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ব্যাপক হারে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা মনে করেন, নিজেদের ভাণ্ডার ভরে তোলার জন্যই যেন তারা জেলা পরিষদের সাইনবোর্ডটি ব্যবহার করছেন। দেশের বিভিন্ন জেলা পরিষদের চিত্রটা এমনি বলে জানান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা জানান, দেশের অধিকাংশ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান স্থানীয় প্রভাবশালী সরকার দলীয় নেতা। তাদের বিভিন্ন দুর্নীতি আর অনিয়মের বিরুদ্ধে স্বাভাবিকভাবেই কেউ আওয়াজ তুলতে সাহস পান না। এর আগে কয়েকটা জেলা পরিষদের কর্মচারীরা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা কিংবা মানববন্ধন করলেও চাঁপাইনবাগঞ্জে এর হবার নয়। কেননা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়েই জেলা পরিষদ লুটপাটের আয়োজন করেছেন চেয়ারম্যান। তাদের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুদকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
এসডব্লিউ/ডিজে/কেএইচ/১২৫৫
আপনার মতামত জানানঃ