বিশাল নীল জলের দুই পাশে থাকা দুই প্রতিবেশী দেশ-তুরস্ক ও গ্রিস। সাম্প্রতিক সময়ে ভূমধ্যসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা দেখা দেয়। ককেসাসসহ আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার নিয়ে তুরস্কের সঙ্গে ফ্রান্সের ব্যাপক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। ইউরোপীয় দেশ দুটির সঙ্গে সেই উত্তেজনা-দ্বন্দ্ব অবসানের আভাস মিলেছে অতি সম্প্রতি। এই বিষয়ে দুই দেশের কূটনৈতিক পর্যায় থেকেই ইতিবাচক মনোভাবের আভাস মিলছে৷ দুই দেশের আলোচনায় পাঁচ বছরের অচলাবস্থার পর সোমবার বৈঠকে বসবে গ্রিস ও তুরস্ক৷ প্রায় পাঁচ বছর পর তাদের আলোচনায় বসাকে স্বাগত জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি।
জার্মানি বলেছে, তারা বেশ কিছুদিন হলো এই বৈঠকের অপেক্ষায় ছিল। এটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক পদক্ষেপ।
জার্মানির ডয়চে ভেলের খবরে বলা হয়, দু’দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দ্বন্দ্ব অবসানের লক্ষ্যে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মেভলুত চাভুসওগ্লূ সরাসরি আলোচনায় বসার জন্য গ্রিসের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তার ধারাবাহিকতায় এ আলোচনা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুসোগলু গত সপ্তাহে বেলজিয়াম সফরে আসেন। তিনি একে আঙ্কারা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে ‘ইতিবাচক পরিবেশ’ বজায় রাখার মিশন হিসেবে অভিহিত করেছেন।
গ্রিসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোস ডেনডিয়াস দেশটির স্থানীয় গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বৈঠক নিয়ে অ্যাথেন্সের দিক থেকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কথা নিশ্চিত করেছেন৷ তার আশা তুরস্কও একই মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসবে৷ অন্যদিকে বিতর্কিত জলসীমানায় গ্যাস অনুসন্ধান থামিয়ে আলোচনার পথটি প্রশস্ত করেছে তুরস্কও৷ এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ইউরোপীয় নেতাদের সামনের দিনে তুরস্ক সফরে যাওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে৷
অবশ্য দুই পক্ষ থেকে যতই রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রকাশ পাক না কেন শরণার্থী, মানবাধিকার, জলসীমানা ও বিভিন্ন জায়গায় সামরিক হস্তক্ষেপসহ বিস্তর দ্বন্দ্ব নিরসনটা একেবারে সহজ হবে না৷ কূটনীতিকরাও মনে করছেন শুধু কথায় নয় সম্পর্কোন্নয়নে তুরস্ককে বিতর্কিত জলসীমা থেকে জরিপ জাহাজ সরিয়ে নেয়াসহ আরো কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে, যে কারণে আঙ্কারার উপর অবরোধ আরোপের ব্যাপারে ইউরোপের কয়কেটি দেশের উপর চাপও রয়েছে৷ এসব বিষয়ে আগামী মার্চে ইউরোপীয় নেতাদের একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে৷
তুরস্ক-গ্রিসের সম্ভাব্য বৈঠকের বিষয়ে ইইউর পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বরেল রয়টার্সকে জানান, তিনি একটি ‘সম্ভাবনার দ্বার’ দেখতে পাচ্ছেন। এ জন্য আঙ্কারাকে বিরোধ এড়িয়ে আলোচনার পথে হাঁটতে হবে।
তবে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের মনোভাব পরিবর্তনের পেছনে অর্থনৈতিক কারণও দেখছেন অনেকে৷ কোভিডের কারণে দেশটির অর্থনীতি মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে৷ তার উপর আন্তর্জাতিকভাবে নানা টানাপোড়েনও সেখানে প্রভাব ফেলছে৷ বাণিজ্যিক কারণেও তাই সবচেয়ে বড় অংশীদার ইউরোপের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক ভালো রাখা দরকার৷ অনেকে মনে করেন সেই প্রেক্ষাপটেই নভেম্বরে বিচার বিভাগ পুনর্গঠনেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এরদোয়ান৷
২০১৬ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশটিতে আইনের শাসন নিয়ে বরাবরই সমালোচনা করে আসছিল ইউরোপ৷ ন্যাটোর সদস্য দুই প্রতিবেশি দেশের মধ্যে সমুদ্রসীমা, জ্বালানির অধিকার, আকাশসীমা ও সমুদ্রের কিছু দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধ রয়েছে। গত বছর আগস্টে তুরস্কের জরিপ করা জাহাজ ওরুচ রইস সাইপ্রাসের পশ্চিমে ভূমধ্যসাগরে তেল ও গ্যাসের সন্ধানে জরিপ শুরু করলে দুইদেশের বিরোধ যুদ্ধে রূপান্তরিত হওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপ্রার্থী তুরস্ক ভূমধ্যসাগরের কিছু অঞ্চলকে নিজেদের সমুদ্রসীমার অংশ দাবি করে ওই অঞ্চলে প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান করছে। ওই অঞ্চলগুলোকে গ্রিস ও সাইপ্রাসের গ্রিক প্রশাসনও নিজেদের অঞ্চল বলে দাবি করে আসছে। তুরস্ক গ্রিস ও গ্রিক সাইপ্রাসের ওই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলছে, আঙ্কারা আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে সকল বিরোধ মেটাতে ইচ্ছুক।
সমুদ্রে জরিপকে কেন্দ্র করে আগস্ট থেকে বিভিন্ন সময়ে তুরস্কের ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়ে আসছে। যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেই বিভিন্ন সময় প্রতিদ্বন্দ্বী সামরিক শক্তির সাথে তুরস্ক ও গ্রিস সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে।এ নিয়ে তুরস্কের সঙ্গে ফ্রান্সের উত্তজনা চরমে পৌঁছায় সম্প্রতি। আঙ্কারার ওপর অবরোধ আরোপ করতে ইইউকে চাপ দেয় প্যারিস-এথেন্সসহ কয়কেটি দেশ। তবে তাদের সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর সুর নরম করে তারা। কয়েকদিন আগে আঙ্কারা-এথেন্সের মধ্যকার উত্তেজনা প্রশমনের ইঙ্গিত মিলেছে। বাকযুদ্ধে জড়ানো তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ নিজেদের মধ্যে চিঠি চালাচালিও করেছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৮২১
আপনার মতামত জানানঃ