১৯৭২ সাল। ভ্যাটিক্যানের এক যাজকের দাবি ঘিরে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল গোটা বিশ্বে। তাঁর দাবি ছিল, অতীতে ও ভবিষ্যতে সফর করা সম্ভব এমন একটি যন্ত্র তিনি আবিষ্কার করে ফেলেছেন। সেই সময় টাইম মেশিনের ধারণা উঠে এসেছে শুধুমাত্র কল্পনায়, কল্পবিজ্ঞানের গল্পের পাতায়। এই মেশিনটির বাস্তবতা কি সম্ভব? প্রশ্নের ঝড় উঠেছিল বিশ্বের বিজ্ঞানীদের মধ্যে।
১৯৫০ সাল থেকেই ভ্যাটিকানের ফাদার পেলেগ্রিনো আর্নেটি একটি ‘টাইম মেশিন’ বা সময়যান তৈরির চেষ্টা করেন। তাঁর এই কাজে সহায়তা করেন বিখ্যাত নোবেলজয়ী পদার্থবিদ এনরিকো ফার্মি ও রকেট বিজ্ঞানের জনক বলে পরিচিত অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার জার্মানির ভেয়ার্নহার ফন ব্রাউন-সহ ১২ জন বিজ্ঞানী।
১৯৭২ সালে সংবাদপত্রে ফলাও করে ছাপা হয় আর্নেটির ক্রোনোভাইজ়র যন্ত্রের কথা। এটিকে একটি সময়যান বা ‘টাইম মেশিন’ বলে দাবি করেন ফাদার আর্নেটি। ভ্যাটিক্যানের পুরোহিত হলেও তিনি ছিলেন এক জন খ্যাতনামী পদার্থবিদও। এই যন্ত্রের মাধ্যমে অতীতচারণ করে যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা চাক্ষুষ করেন, এমন বিতর্কিত দাবি তুলেছিলেন তিনি।
তিনি এই যনত্রের মাধ্যমে আরও বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছিলেন বলেও দাবি করেছিলেন। তার মধ্যে ছিল যিশুর শেষ নৈশভোজ বা বিখ্যাত ‘লাস্ট সাপার’। সেই ঘটনারও সাক্ষী হয়েছিলেন এবং একটি ছবি তুলেছিলেন যা তিনি স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে রেখে দিয়েছেন বলে দাবি তোলেন আর্নেটি।
সেই ঘটনার কথা শুনে ভ্যাটিক্যানের অনেকেই এই দাবিকে ভুয়ো বলে মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু সন্দেহ বাড়তে থাকে যখন হঠাৎ করে ১৯৮৮ সালে সময়ভ্রমণ বা সময়যান সংক্রান্ত সমস্ত গবেষণার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন ভ্যাটিক্যান কর্তৃপক্ষ। কেউ যদি কখনও এই ধরনের কোনও যন্ত্র ব্যবহার করেন, তা হলে তাঁকে বহিষ্কার করা হবে, এই মর্মে আদেশ জারি করে ভ্যাটিক্যান।
এর পর থেকেই আর্নেটি ও তাঁর ক্রোনোভাইজ়র যন্ত্রটি লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়।
পিটার ক্রাসা নামে এক জন ইতিহাসবিদ ক্রোনোভাইজ়র এবং এটি তৈরির কিছু রহস্য ব্যাখ্যা করে একটি বই লিখেছিলেন। এই বইয়ের নাম ছিল ‘ফাদার আর্নেটি’জ ক্রোনোভাইজ়র: দ্য ক্রিয়েশন অ্যান্ড ডিজ়অ্যাপিয়ারেন্স অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস ফার্স্ট টাইম মেশিন’।
কী ভাবে কাজ করত সেই যন্ত্র? এই যন্ত্রে ধরা পড়ত তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ। যন্ত্রটির মাথায় বসানো ছিল দু’টি অ্যান্টেনা। দাবি করা হয়, সেই অ্যান্টেনার মাধ্যমে অতীতের রেকর্ড করা শব্দ ও তরঙ্গ গ্রহণ করে সেই তথ্যকে দৃশ্য-শ্রাব্য আকারে টিভির পর্দায় ফুটিয়ে তোলা হত।
তবে এই যন্ত্রকে সময়যান বলা যুক্তিযুক্ত কি না সে নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। কারণ এই একই কাজ করে আয়নাও। আয়নায় আমরা নিজেদের যে প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই তা আমাদেরই কয়েক মিলি সেকেন্ড পুরনো ছবি। কারণ চোখ থেকে আয়না ও আয়না থেকে চোখে আসতে যে সামান্য সময় লাগে তাতে আমরা নিজেদের অতীতকেই দেখতে পাই।
তা হলে আদতে কী এই যন্ত্র? আদৌ কি সম্ভব সময়ভ্রমণ? নাকি এটা নিছকই কল্পনাপ্রবণ মানুষদের মনের আলো আঁধারি গোলকধাঁধা।
বাংলা থেকে শুরু করে ইংরেজি এবং নানা বিদেশি ভাষায়, সময়ভ্রমণ বা সময়যানকে কেন্দ্র করে গল্প, উপন্যাসের ছড়াছড়ি। কল্পবিজ্ঞানের লেখক এইচ জি ওয়েলসের ‘দ্য টাইম মেশিন’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৯৫ সালে।
হলিউডের সিনেমাতেও সময়ভ্রমণের উদাহরণ ভুরিভুরি। অনেক বিজ্ঞানী সারা জীবন সময়যান তৈরির ব্যর্থ চেষ্টায় কাটিয়ে দিয়েছেন। আবার এমন কথাও প্রচলিত রয়েছে যে, অনেক বিজ্ঞানীই নাকি সময়যান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
সময়ভ্রমণ বা সময়যান তৈরির ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের যে তত্ত্বকে প্রামাণ্য বলে ধরা হয় তা হল আইনস্টাইনের থিয়োরি অফ রিলেটিভিটি। আইনস্টাইনের বক্তব্য অনুযায়ী, সময় মোটেই ধ্রুবক নয়, তা আপেক্ষিক। সময়ের বয়ে যাওয়াও ধ্রুবক নয়। সময়ের গতি বাড়তে বা কমতে পারে। গতি দ্রুত হলে সময় ধীরে বইবে।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এই ধরনের সূক্ষ্ম পরিমাপ একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। কেবল আলোর গতি বা তার কাছাকাছি গতিতে ছুটতে পারলেই সময়যান ছাড়া সময়ভ্রমণ সম্ভব। অথবা খুব তীব্র মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে সময় কাটাতে হবে, যা এখনও মানুষের নাগালে আসেনি।
পৃথিবী থেকে ৪০৮ কিমি উচ্চতায় থাকা আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষেণাকেন্দ্রটি ২৭ হাজার ৫৮০ কিমি বেগে ঘুরছে। সেখানে থাকা নভোচারীরা পৃথিবীতে বসবাসকারীদের তুলনায় আগে বিভিন্ন ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে পারেন। তবে সেই সময়ের পরিমাপ নগণ্য।
কল্পনা জগতের বাইরে এসে সত্যিকার ‘টাইম মেশিন’ তৈরির দাবি জানিয়েছিলেন আমেরিকার কানেকটিকাট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী রন ম্যাল্লেট। আলবার্ট আইনস্টাইন তার আপেক্ষিকতার তত্ত্ব নিয়ে আসার পর থেকে পদার্থবিজ্ঞানীরা সময়ভ্রমণকে তাত্ত্বিক ভাবে সম্ভব বলে মনে করেন।
সময়ভ্রমণ নিয়ে আরও এক বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিঙের অন্য তত্ত্ব রয়েছে। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, যদি সত্যিই সময়ভ্রমণ করা যেত, তা হলে ভবিষ্যৎ থেকে কাউকে বর্তমান সময়ে ফিরিয়ে আনা যায়নি কেন?
বর্তমান থেকে অতীতে বা ভবিষ্যতে যাতায়াত করার জন্য সময়যানের ধারণা পৃথিবীর বুকে বহু যুগ ধরে রয়েছে। সময়ের আগে বা পিছনে যাওয়ার জন্য সময়যানের ধারণা বহু বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক এবং ইতিহাসবিদদের লেখনীতেও বার বার উঠে এসেছে। সময়ভ্রমণের প্রতি আমাদের এক অদ্ভুত মুগ্ধতা রয়েছে। সিনেমার টানটান চিত্রনাট্য যেন সেই কল্পজগত সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ