ঢাকায় বাইজিদের অভ্যুদয়ের আরেকটি বিশেষ কারণ ছিল সমকালীন বাবু সংস্কৃতি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে আঠারো শতকের শেষ ভাগে ঢাকায় এক নব্য ধনিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এই বিত্তশালীরা আখ্যায়িত হতে শুরু করেন ‘বাবু’ নামে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুসলমান জমিদারের স্থলাভিষিক্ত হন তারই হিন্দু গোমস্তা। নব্য জমিদার সম্প্রদায়ের অভ্যুদয় ঘটে।
রাজধানী ঢাকায় বাইজি সংস্কৃতির প্রথম বিস্তার ঘটে মোগল আমলে। বাইজিদের দরবারি নৃত্যের ঐতিহ্য প্রবর্তন করেন ঢাকার সুবাদার ইসলাম খাঁ। সৈয়দ মুহম্মদ তৈফুরের ঢাকাবিষয়ক আকর গ্রন্থ ‘Glimpses of Old Dhaka’ থেকে এ তথ্যের সত্যতা মেলে। তিনি লিখেছেন, ‘Islam Khan had a luxurious court in Dhaka. For the entertainment of the court, he maintained a number of “lulis”, “kanchanis”, “horkanis” and “domnis” (all dancing girls) at a cost of eighty thousand rupees per month.’ ইসলাম খাঁর দরবারি নৃত্য বিষয়ে আরও চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া যায় অজিত কৃষ্ণ বসুর ‘ঢাকার স্মৃতি’ নিবন্ধে।
তিনি লিখেছেন, ‘তাঁর দরবারে ছিল বহুসংখ্যক নৃত্যগীতে সুদক্ষ সুন্দরী নর্তকী। …কিন্তু ইসলাম খাঁ নিজে কোনো আসরে হাজির থাকতেন না। তাই দেখে তাঁর এক বন্ধু তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি নিজে যদি এই নাচ-গান উপভোগ না করেন, তাহলে এত খরচ করে এত গায়িকা-নর্তকী পুষবার দরকার কী? …ইসলাম খাঁ বলেছিলেন, শহরের যত দুশ্চরিত্র লোক এই নাচগানের আকর্ষণে এসে এই মজলিসে সন্ধ্যা আর রাত কাটায় তার ফলে শহরে চুরি-ডাকাতি কম হয়। নৃত্য ও সংগীতকে উপজীব্য করে ইসলাম খাঁর কাঞ্চনীদের (“kanchanis”) উত্তরসূরি বাইজিরা পরবর্তীকালে নওয়াব, জমিদার ও বিত্তশালী সম্প্রদায়ের বিনোদনের উপাদান জুগিয়েছেন। বাইজিরা ঘরোয়া মজলিশে, রংমহলে, বাগানবাড়িতে বা বজরায় নাচ-গান করতেন। ঢাকার নওয়াব নুসরাত জঙ্গ, নওয়াব শামসুদ্দৌলা, নওয়াব কমরদ্দৌলা, নওয়াব আবদুল গনি ও নওয়াব আহসানুল্লাহর সময় বাইজিদের নৃত্যগীতের চর্চা ছিল। যার ফলে কলকাতা ও ভারতের উত্তরাঞ্চল থেকে আসা বাইজিদের অনেকে ঢাকায় থাকতে শুরু করেন। উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে ঢাকার স্থানীয় বাইজিরাও বেড়ে ওঠে, ফলে এখানে বাইজিবাড়ি ও বাইজিপাড়া গড়ে ওঠে। তারা শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করতেন মূলত গান ও নাচের মধ্য দিয়ে। খেয়াল, ঠুমরি, টপ্পাজাতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীত ও গজল গাইতেন।
ঢাকায় বাইজিদের অভ্যুদয়ের আরেকটি বিশেষ কারণ ছিল সমকালীন বাবু সংস্কৃতি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে আঠারো শতকের শেষ ভাগে ঢাকায় এক নব্য ধনিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এই বিত্তশালীরা আখ্যায়িত হতে শুরু করেন ‘বাবু’ নামে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুসলমান জমিদারের স্থলাভিষিক্ত হন তারই হিন্দু গোমস্তা। নব্য জমিদার সম্প্রদায়ের অভ্যুদয় ঘটে।
এই বিত্তশালীদের কথা বলতে গিয়ে জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘রাজনীতিক পরিবর্তনে পুরোনো অবস্থাপন্ন মুসলমান পরিবারগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে যায়। পুরোনো যারা ছিল, দে ফেইল্ড টু একোমোডেট দেমসেলভস উইথ দি নিউ চেঞ্জেস। ফলে যার যা ছিল সব বিক্রি হয়ে যায়।’ মুদ্রা বাজার ও মুদ্রা ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণহীনতা এবং রাজস্ব আইনে আরোপিত বিভিন্ন সংস্কার এই বাবুদের উত্থান তরান্বিত করে। তারা প্রাদেশিক রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করতেন। দেশজুড়ে হুন্ডির ব্যবসা, টাকা বিনিময়, অর্থ লগ্নি (সুদে টাকা খাটানোর ব্যবসা), সামরিক বাহিনীর বেতন প্রদান এবং অভিজাত মোগল কর্মকর্তা, রাজকীয় পরিবারের সদস্য ও সওদাগরদের ব্যবসা করার জন্য তারা প্রয়োজনীয় পুঁজিও সরবরাহ করতেন। বাবুদের মুদ্রা বাণিজ্য ও দালালি ব্যবসার মারপ্যাঁচের কাছে সমসাময়িক অন্যান্য ব্যবসায়ীরা হার মানতে বাধ্য হয়।
ঢাকা জেলা কালেক্টরেটের ১৭৮৭ সালের জরিপ অনুযায়ী ঢাকার বাজারে তখন প্রচলিত ছিল মোট ৭ ধরনের মুদ্রা। তবে এর মধ্যে আর্কট মুদ্রার প্রাধান্য ছিল সবচেয়ে বেশি। পরবর্তী অবস্থানে ছিল ‘সিক্কা’ মুদ্রা। সরকারি রাজস্ব পরিশোধ করা হতো সিক্কায়। আর ব্যবসায়িক লেনদেন হতো আর্কটে। নানা ধরনের মুদ্রার বিনিময় প্রথার এ কৌশলকে কাজে লাগিয়ে শ্রফ, শেঠ ও পোদ্দাররা ঢাকায় বিকশিত হয়। মুদ্রা বিনিময় আর অর্থলগ্নি ব্যবসার লাভ দিয়ে পরবর্তী সময়ে জমিদারি কিনেছিলেন মথুরানাথ পোদ্দার। ব্যবসার শুরুতে আনুমানিক ১৮২০-এর দশকে বাংলাবাজারের রাস্তার ওপর চট পেতে তিনি কড়ি, পাই, আনা, রুপি সাজিয়ে রাখতেন। এক রুপি ভাঙানোর জন্য বাট্টা নিতেন এক পাই। সে সময় পাইয়ের চেয়েও ক্ষুদ্রতম একক ছিল কড়ি (১ রুপি=১৬ আনা=৬৪ পয়সা=১৯২ পাই, ১ পাই=২০ কড়ি)। এক রুপি ঋণের জন্য প্রতিদিন এক পয়সা সুদ নেওয়া হতো। যার অর্থ এক শ রুপি ধার দিলে এক বছরে সুদ পাওয়া যেত পাঁচ শ সত্তর রুপি।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীতি-বাবুদের সৃষ্ট নৈরাজ্যকে আরও বেগবান করেছিল। বাবুরা কোম্পানি থেকে আভিজাত্যের উপাধি স্বরূপ পেয়েছেন বিভিন্ন উপাধি। বাবু সংস্কৃতির নিগঢ়ে শুধু হিন্দু বাবুরাই মোহাবিষ্ট হননি, আহসান মঞ্জিলের অনেক নওয়াবও এ সংস্কৃতির সাধক ছিলেন। ঢাকার সামাজিক পরিবেশে আচার-আচরণের প্রথাগত বিধিনিষেধের গণ্ডি ছিল তাদের অপছন্দ। বাবুদের পৃষ্ঠপোষকতায় আত্মপ্রকাশ করেছিল রক্ষিতা পোষণ, বাইজি নৃত্য, খেমটা নাচ, বেশ্যাগমন, ঘোড়দৌড়ের বাজি, পাশা খেলা, আফিম খাওয়া প্রভৃতি। সাহেবদের খুশি করার জন্য সুদূর লক্ষ্ণৌ থেকে বাইজি আনা হতো আসরে।
১৮৮৮ সালে লর্ড ডাফরিনের ঢাকা সফরের সময় নাচের আয়োজন করতে গিয়ে বিপত্তি বাধে স্থান নির্বাচনে। প্রতিদ্ব›দ্বী ছিল আহসান মঞ্জিল ও রূপলাল হাউস। ইউরোপীয় ক্লাবে অনুষ্ঠিত সভ্যদের ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতে রূপলাল হাউস। লর্ড ডাফরিনকে নাচ দেখাবার জন্য ইংরেজ কোম্পানি দুই দিনের জন্য ২০০ টাকায় ভাড়া নিয়েছিল রূপলাল হাউস। কিন্তু এই বাড়িটি সাজাতে রূপলাল পরিবারের খরচ হয়েছিল ৪৫ হাজার টাকা!
নওয়াবিন বাই।
বাইজি শব্দের বিস্তৃত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখনীতে। তিনি লিখেছেন, বাইজিদের চারটি শ্রেণি ছিল। যার নামের সঙ্গে শুধু ‘বাঈ’ শব্দটি ব্যবহৃত হতো, তিনি শুধু গান করতেন। যার নামের সঙ্গে ‘জান’ শব্দটি ব্যবহৃত হতো, তিনি নাচ ও গান দুটিই করতেন। তৃতীয় জনকে ‘কানীজ’ বলা হতো, যিনি অতিথিদের আপ্যায়ন করতেন এবং মদ পরিবেশ করতেন। আর চতুর্থ জনকে ‘খানাগী’ বলা হতো, যিনি বেশ্যাবৃত্তি করতেন।
হিন্দুস্তানি ‘জি’ যোগ করা হতো, সম্ভ্রম জানানোর উদ্দেশ্যে। বিভিন্নজনের স্মৃতিচারণায় বাইজির সমার্থক হিসাবে ‘তওয়ায়েফ’ শব্দটিও ব্যবহৃত হয়েছে। সত্যেন সেনের তথ্যমতে, বাইজিরা গানের ভাব প্রকাশ করতেন নাচের মুদ্রায়; হাত, মুখ, চোখ, নাক ও ওষ্ঠের সূক্ষ্ণ কম্পনে। নাচ-গানের সঙ্গে ব্যবহার করা হতো দুটি করে বেনারসি সারেঙ্গি, বেনারসি তবলা ও বেনারসি মন্দিরা। পেশওয়াজ, চুড়িদার পাজামা, ওড়না ও পায়ে চিকন ঘুঙুর পরার প্রচলন ছিল বাইজিদের মাঝে। আর তাদের দেখাশোনা করা, বাজনা বাজানো এবং নতুন গ্রাহক জোগাড় করার জন্য থাকত নিজস্ব লোক। বাইজি পরিভাষায় তাদের বলা হত ‘সফরদার’। তাদের ওপর বাইজিরা অনেকাংশে নির্ভরশীল ছিল। সফরদারের পোশাক ছিল পাঞ্জাবি, ভেলভেটের ওয়েস্ট কোট এবং মাথায় ভেলভেটের কিশতি টুপি।
আপনার মতামত জানানঃ