কোটি কোটি বছর আগে পৃথিবীতে মানুষ বেশি ছিল না। মাঠ আর বনে বসবাসকারী অন্যান্য জীবজন্তুর তুলনায় মানুষকে দুর্বল মনে হতো। হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের হাত থেকে আত্মরক্ষা করার মতো অথবা নিজের খাওয়ার জন্য বন্য পশুপাখি শিকার করার উপযুক্ত শক্ত নখ ও ধারালো দাঁত তার ছিল না। হিম থেকে গা বাঁচানোর জন্য সর্বাঙ্গে যেমন ঘন ও গরম লোম থাকা দরকার, ছিল না তা-ও। ওড়ার ডানা ছিল না, দাবানল বা বসন্তের বন্যা থেকে পালানোর মতো পায়ের জোরও ছিল না। থাকার মধ্যে তার ছিল যৎসামান্য বুদ্ধি-বিবেচনা আর অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের ক্ষমতা।
পৃথিবীর আদিম মানুষের জীবন ছিল কঠিন। ছিল ক্ষুধার তাড়না। সারাদিন নারী ও শিশুরা জোগাড় করত গাছের মূল-কন্দ আর শাকপাতা। পুরুষেরা কেউ কেউ চেষ্টা করত মাছ ধরতে, কেউ-বা ছোট-বড় যা-ই হোক, কোনো না কোনো জন্তু-জানোয়ার ধরতে। মানুষ তখন বাস করত বড় বড় পারিবারিক দল বেঁধে। বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে, দাদা-দাদী, চাচা-চাচী, ফুফু, ভাইপো, ভাইঝি—সবাই সবার আত্মীয়স্বজন, জ্ঞাতিগোষ্ঠী। সন্ধ্যা হতে না হতে সবাই এটা-সেটা খাবারদাবার নিয়ে তাদের বাসস্থানে (গুহায়) এসে জড়ো হতো। সেখানে অগ্নিকুন্ডের ধারে গোল হয়ে বসে ভাগাভাগি করে খাবার খেত।
সারাদিন নারী ও শিশুরা জোগাড় করত গাছের মূল-কন্দ আর শাকপাতা। পুরুষেরা কেউ কেউ চেষ্টা করত মাছ ধরতে, কেউ-বা ছোট-বড় যা-ই হোক, কোনো না কোনো জন্তু-জানোয়ার ধরতে। মানুষ তখন বাস করত বড় বড় পারিবারিক দল বেঁধে।
আদিম মানুষেরা মাঝেমধ্যে ওই সব পাথরের মধ্যে বিশেষ ধরনের কিছু কিছু পাথরের সন্ধান পেত। আদিম মানুষ দীর্ঘকাল কেবল পাথর, কাঠ আর হাড় দিয়েই শ্রম ও শিকারের হাতিয়ার বানাতে পারত। পাথরের ছুরি তৈরি করা সহজ ব্যাপার নয়। হাতিয়ারের উপযুক্ত একটা পাথরের খণ্ড খুঁজে বের করতে কত সময়ই-না নষ্ট হয়। পাথরের খোঁজে নিজেদের এলাকা থেকে দূরে যেতে হতো। অবশ্য এটাও ঠিক যে বড্ড বেশি দূরে তারা যেত না, তাতে পথ হারানোর আশঙ্কা থাকত। যেতে যেতে লোকে গিয়ে পড়ত গিরিখাতের ভেতরে, যেখানে ভেঙে পড়া শিলাখণ্ডগুলো পাহাড়ী নদীর প্রবল স্রোতে গড়াতে গড়াতে গোল গোল নুড়ির আকার পেত। কখনও-বা তারা সাগরতীরে বেলাভূমিতে উপযুক্ত পাথর খুঁজে বেড়াত।
আদিম মানুষেরা মাঝেমধ্যে ওই সব পাথরের মধ্যে বিশেষ ধরনের কিছু কিছু পাথরের সন্ধান পেত। সেই পাথর পিটিয়ে চ্যাপ্টা করা যেত, পেটালে ফাটত না, টুকরো টুকরো হয়ে যেত না। দুটো বড় বড় পাথরের মাঝে ফেলে অনেকক্ষণ ঘা মারতে পারলে ছুরির জন্য পাতলা পাত কিংবা কুড়লের জন্য খানিকটা স্থূল ধরনের কুঁদো (কুড়োলের কাঠের হাতল) হতো। এই হাতিয়ারগুলোকে শান দেওয়া যেত।
তোমরা নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছ, ওগুলো আসলে স্বাভাবিক ধাতুপিণ্ড, যেমন ব্রোঞ্জ, স্বর্ণ ও রৌপ্য রুপে পাওয়া যেত।
চারপাশের সবকিছু বড় বলে মনে হতো। নদী, সরোবর মনে হতো বিশাল বিশাল। তার আরও কারণ এই যে আদিম মানুষের তখনো নৌকা ছিল না। তৃণভূমি, বনজঙ্গল, পাহাড়পর্বত—তাদের পক্ষে পার হওয়া দুঃসাধ্য।
শতাব্দীর পর শতাব্দী, সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ কেটে গেল। ধীর, মন্থর গতিতে বদলাতে লাগল আদিম মানুষের জীবনযাত্রা। বিন্দু বিন্দু করে অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়ে পুরুষানুক্রমে সঞ্চারিত হয়ে চলল। পৃথিবী যে কত বড় হতে পারে, সেই সময় এ নিয়ে কোনো মানুষই মাথা ঘামাত না। চারপাশের সবকিছু বড় বলে মনে হতো। নদী, সরোবর মনে হতো বিশাল বিশাল।
তার আরও কারণ এই যে আদিম মানুষের তখনো নৌকা ছিল না। তৃণভূমি, বনজঙ্গল, পাহাড়পর্বত—তাদের পক্ষে পার হওয়া দুঃসাধ্য। লোকে যানবাহন বলতে কিছু জানত না। শুধু দুই পায়ের ওপর ভরসা। তা-ও আবার পথঘাটের বালাই নেই—কত দূরই-বা যাওয়া যেতে পারে? ভয়াবহ! বনে-জঙ্গলে আর তৃণভূমিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে যত রাজ্যের রক্তপিপাসু জন্তু-জানোয়ার। সরোবরে, সাগর-মহাসাগরে আছে হিংস্র মাছেরা। সবাই অসতর্ক পথিককে গিলে খাওয়ার তালে আছে। গিলে যদি নাও খায়, ভয় তো পাইয়ে দেবেই। লোকে তাই চেষ্টা করত বেশি দূরে না গিয়ে নিজের এলাকার কাছেপিঠে থাকার। তখন পর্যন্ত দূর যাত্রার কথা কেউ চিন্তাই করত না। আর এই কারণেই আদিম মানুষের কাছে তার আস্তানা আর আশপাশে চোখে যতটুকু দেখা যেত, সেটাই ছিল তার গোটা পৃথিবী।
আপনার মতামত জানানঃ