আয় ও সম্পদবৈষম্য কমাতে ধনীদের কাছ থেকে বাড়তি কর আদায়ের সুপারিশ করেছে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ-সংক্রান্ত টাস্কফোর্স। তারা দেশে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রগতিশীল করব্যবস্থা চালুর পরামর্শ দিয়েছে, যে ব্যবস্থায় ধনীদের ওপর বেশি কর আরোপ করা হয়।
বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণে গত ১১ সেপ্টেম্বর টাস্কফোর্স গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। গত বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়।
মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি থেকে সুফল ধনীরা বেশি পেয়েছেন উল্লেখ করে টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, নিম্ন আয় ও দরিদ্র মানুষেরা জীবনমানের উন্নতি ঘটাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
প্রতিবেদনে টাস্কফোর্স বলেছে, ব্যক্তির নিজস্ব ও উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদের ওপর সম্পদ কর আরোপে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে। এর উদ্দেশ্য হবে কিছু লোকের হাতে বেশি সম্পদ চলে যাওয়া ঠেকানো, অর্থাৎ সম্পদ কেন্দ্রীভূত হতে দেওয়া যাবে না। ধনীদের কাছ থেকে বাড়তি কর আদায় ও ফাঁকি রোধ করতে সক্ষমতা বাড়ানো দরকার।
টাস্কফোর্স এমন একটা সময়ে ধনীদের ওপর কর বাড়ানোর কথা বলল, যখন দেশে আয়বৈষম্য বিপজ্জনক পর্যায় ছুঁই ছুঁই করছে। আয়বৈষম্য বৃদ্ধির পাশাপাশি মোট জাতীয় আয়ে ধনীদের হিস্যা বাড়ছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি থেকে সুফল ধনীরা বেশি পেয়েছেন উল্লেখ করে টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, নিম্ন আয় ও দরিদ্র মানুষেরা জীবনমানের উন্নতি ঘটাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
বৈষম্য কমাতে প্রগতিশীল করব্যবস্থাসহ বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়। জানতে চাইলে টাস্কফোর্সের প্রধান ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদ প্রথম আলোকে বলেন, অনেক দিন ধরেই প্রগতিশীল করব্যবস্থা চালুর কথা বলা হচ্ছে; কিন্তু সাফল্য আসেনি। মানুষের মধ্যে বৈষম্য দূর করতে প্রগতিশীল করব্যবস্থা চালুর বিষয়টি জোরালো করা দরকার। তবে এ করব্যবস্থা স্বল্প মেয়াদে চালু করা সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, সাধারণত মানুষ করজালে আসতে চায় না। তাই সহজে কর আদায় করা যায়, এমন খাতে সরকার কর বসিয়ে দেয়। ভ্যাটের মতো কর ধনী-গরিব সবাইকে সমান হারে দিতে হয়। তাই বৈষম্যহীন করব্যবস্থা চালু করা কঠিন হয়ে যায়।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে। কিন্তু বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে আয় ও সম্পদবৈষম্য বেড়েছে। আরও বেড়েছে সুযোগের বৈষম্য। ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সূচনাও হয় সরকারি চাকরিতে কোটাবৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে।
সাধারণত গিনি (কেউ কেউ জিনি বলেন) সহগ দিয়ে একটি দেশে আয়বৈষম্য কেমন, তা বিশ্লেষণ করা হয়। ১৯১২ সালে ইতালির সংখ্যাতত্ত্ববিদ কোরাদো গিনি বা জিনির উদ্ভাবিত পদ্ধতি অনুযায়ী, দেশে সবার আয় সমান হলে গিনি সূচক হবে শূন্য। আর সব আয় একজনের হাতে গেলে সূচকটি হবে ১। ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে গিনি সহগ সূচকের মান ছিল শূন্য দশমিক ৩৫৮, যা ২০২২ সালে দাঁড়ায় দশমিক ৪৯৯। এটা শূন্য দশমিক ৫০০ হলেই কোনো দেশকে বিপজ্জনক আয়বৈষম্যের দেশ হিসেবে গণ্য করা হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানার আয় ও ব্যয় জরিপ-২০২২ অনুসারে, দেশের সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষের হাতে দেশের মোট আয়ের ৪১ শতাংশ। অন্যদিকে সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের মাত্র ১ দশমিক ৩১ শতাংশ। ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরের ধনীদের হিস্যা এখনকার চেয়ে কম ছিল, গরিবের বেশি ছিল। তখন সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষের হাতে ছিল মোট আয়ের ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ। আর সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশের আয় ছিল দেশের মোট আয়ের ২ দশমিক ৮ শতাংশ।
জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বশেষ সাড়ে ১৫ বছরে বৈষম্য বাড়তে বাড়তে বিপজ্জনক পর্যায়ের কাছাকাছি চলে গেছে। তখনকার সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হতো, দেশের উন্নতির প্রথম পর্যায়ে বৈষম্য বাড়ে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার জাপান ও কোরিয়ার উদাহরণকে এড়িয়ে যেত। এই দুই দেশে বৈষম্য নিয়ন্ত্রণে রেখে উন্নয়ন হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বৈষম্য কমাতে তেমন কোনো পদক্ষেপও ছিল না।
ফলে আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফামের বৈষম্য কমানোর প্রতিশ্রুতি (কমিটমেন্ট টু রিডিউসিং ইনইকুয়ালিটি-সিআরআই) সূচকে (২০২৪) ১৬৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১২৪তম স্থান পায়, যা ২০২২ সালে ছিল ১০৭তম।
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষি থেকে শিল্প ও সেবা খাতে রূপান্তর ঘটছে। এতে সম্পদ শহরে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। গ্রাম বঞ্চিত থাকছে। পোশাক খাতে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হলেও দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের মজুরিবৈষম্য বেশি। মানসম্মত শিক্ষায় সুযোগ সীমিত। শিক্ষার মানে বৈষম্য আয়বৈষম্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। কারণ, যাঁরা মানসম্মত শিক্ষা পান, তাঁরা আয় বেশি করেন।
টাস্কফোর্স আয়বৈষম্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট), আমদানি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, আবগারি শুল্ক ও নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কের মতো পরোক্ষ কর থেকে বেশি রাজস্ব আদায় এবং অপ্রতুল সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিকে দায়ী করেছে। তারা বলেছে, তেল, সাবান, শ্যাম্পুর মতো নিত্যব্যবহার্য পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট বসানো হলে তা ধনী-গরিব সবাইকে সমান হারে দিতে হয়। কিন্তু গরিব মানুষের ওপর বেশি চাপ পড়ে। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ধরনের করের ওপর সরকার বেশি নির্ভরশীল। তাই তা সমাজের দরিদ্র শ্রেণির ওপর বেশি আঘাত করে।
আয়কর আদায়ে বাংলাদেশ পিছিয়ে। এনবিআর সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে এখন ১ কোটি ১১ লাখের মতো কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) আছেন। তাঁদের মধ্যে ৪০ লাখের মতো করদাতা বছর শেষে রিটার্ন জমা দেন। সেই হিসাবে, দেশের মাত্র ২ শতাংশ মানুষ নিয়মিত আয়কর জালে আছেন।
সম্পদের ওপর সারচার্জ আরোপের ব্যবস্থা আছে। ব্যক্তির নিট সম্পদের পরিমাণ ৪ কোটি টাকা বা তার বেশি হলে আয়ের ওপর ১০ শতাংশ বেশি আয়কর দিতে হয়। সম্পদ আরও বেশি হলে কর বেশি। তবে আদায় কম। কারণ, ধনীরা সম্পদের মূল্য কম দেখান অথবা ফাঁকি দেন। যুগ যুগ আগে যে দামে জমি বা বাড়ি কেনা হয়েছে, সেই দাম দেখিয়ে কর নথি জমা দেওয়া হয়। এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, তাদের আওতাভুক্ত ৭০০ জন ধনী ব্যক্তির মধ্যে সম্পদ কর আদায় হয় মাত্র ১৮২ জনের কাছ থেকে।
অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ-সংক্রান্ত টাস্কফোর্স শুধু আয়বৈষম্যের কথা বলেনি। সমাজে কাঠামোগত বৈষম্যের কথাও বলেছে। অন্যায্য নিয়মকানুনের কারণে আবাসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থানে বৈষম্য বেড়েছে বলে মনে করে ওই টাস্কফোর্স। তারা আরও বলছে, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে অসমতা থাকায় বিভিন্ন শ্রেণিগোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে।
আয়বৈষম্য ও সম্পদের অসমতা দূর করতে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে টাস্কফোর্স। প্রগতিশীল করব্যবস্থা ও সম্পদের পুনর্বণ্টন ছাড়া বাকি সুপারিশগুলো হলো মানসম্পন্ন শিক্ষা ও দক্ষতার উন্নয়ন; আর্থিক অন্তর্ভুক্তির সম্প্রসারণ; সামাজিক সুরক্ষা বাড়ানো; শ্রমবাজারের সংস্কার; আঞ্চলিক উন্নয়নকে অগ্রাধিকার; সুশাসন নিশ্চিত করা; লিঙ্গবৈষম্য দূর করা; প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে জোর দেওয়া; জনসচেতনতা বৃদ্ধি।
জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে যাঁদের সম্পদ বেশি, তাঁরা কার্যত কর কম দেন। বিপরীতে যাঁদের সম্পদ কম, তাঁদের ওপর করের বোঝা বেশি। এই বৈপরীত্যের কারণে বৈষম্য বাড়ছে। ধনীদের কাছ থেকে বাড়তি কর আদায়ের সুযোগ আছে এবং আদায় করা উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে সে চিন্তা দেখা যায় না। তারা বরং আইএমএফের শর্ত মানতে গিয়ে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ