আমি বিদ্যুৎই বটে, তবে আপনি চাইলে আমাকে একটু ভিন্নভাবেও দেখতে পারেন, আমি যেন অনেকটা মানুষের বেশে দীপ্যমান জ্যোতিবিশেষ। আপনি হয়তো উপলব্ধি করতে পারছেন না, তবে আপনি নিজেও কিন্তু এর ব্যতিক্রম নন, মি. স্মিথ, বলেছিলেন, নিকোলা টেসলা।
কল্পনা করুন তো, একটি বাগানের গাছপালা তাদের মালীকে আক্রমণ করছে। খুব অবাস্তব শোনাচ্ছে তাই না? এমন কি হয় নাকি? দেখুন, বিপুল পরিমাণ শক্তির সমন্বয়ে মানুষের শরীর ও মস্তিষ্ক গঠিত হয়, আমার নিজের ক্ষেত্রে এর বড় একটা অংশই কার্যত বৈদ্যুতিক শক্তি। প্রতিটি মানুষের শরীরে এই শক্তি ভিন্ন ভিন্ন রূপে বণ্টিত; মানুষের যে আত্মপরিচয়, যেটিকে আমরা “আমি” বা “আত্মা” বলি, সেটি এই শক্তিরই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। মানুষ বাদে অন্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি কিছুটা ভিন্ন, যেমন যদি উদ্ভিদের কথা ধরি, তাহলে বলব খনিজ পদার্থ এবং পারিপার্শ্বিক অন্য প্রাণীরা মিলে যে পরিবেশটি তৈরি করে, সেটিই উদ্ভিজ্জ আত্মা।
মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ও মৃত্যু, দুইয়েরই কিন্তু প্রকাশ আলোর মাধ্যমেই। কম বয়সে আমার চোখের বর্ণ ছিল কালো, এখন তারা নীল। সময়ের সাথে সাথে মস্তিষ্কে যেমন চাপ বাড়বে, চোখের এ বর্ণও তার শেষ ঠিকানার দিকে এগিয়ে যেতে থাকবে: আকাশ যেমন শ্বেতশুভ্র। আমার জানালায় একদিন সকালে একটি সাদা কবুতর এলো, আমি তাকে খাওয়ালাম। সে যেন আমাকে বলতে চাইল খুব শিগগিরই সে মারা যাচ্ছে। তার চোখ থেকে আলোকরশ্মি ঠিকরে বেরোচ্ছিল। ওরকমটা আমি আর কোনো প্রাণীর চোখেই কখনও দেখিনি।
এমনকি আপনি রেগে গেলে কিংবা বিপজ্জনক কোনো কাজে হাত দিলে প্রচণ্ড আলোর ঝলকানি দেখা যায়। অগ্নিকাণ্ড, কিংবা বজ্রপাতের কথাও নাকি শোনা গেছে। এটাকে একরকম অনুভূতিজাত সতর্ক সংকেত বলতে পারেন হয়তো। আলোকশক্তি কিন্তু সব সময়ই আমাকে ঘিরে ছিল। আপনি কি জানেন আমি কীভাবে ঘূর্ণনশীল চৌম্বক ক্ষেত্র ও ইন্ডাকশন মোটর আবিষ্কার করেছিলাম, যা আমাকে ২৬ বছর বয়সেই খ্যাতি এনে দেয়? বুদাপেস্টে এক গ্রীষ্মের বিকেলে আমি আমার বন্ধুর সাথে সূর্যাস্ত দেখছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন হাজার হাজার আগুনের কুণ্ড দাউদাউ করে জ্বলছে, কী যে উজ্জ্বল সে বর্ণচ্ছটা! আমার ফাউস্টের কথা মনে পড়ে গেল; নিজ মনেই আবৃত্তি করা শুরু করলাম, আর তখনই যেন কুয়াশার ভেতর আমি চৌম্বক ক্ষেত্রের আবেশে ইন্ডাকশন মোটরটাকে ঘুরতে দেখলাম। পুরো ব্যাপারটাই কিন্তু দেখলাম ঐ সূর্যের মধ্যেই!
এছাড়া শব্দের অস্তিত্ব শুধু তো বজ্রপাতে, কিংবা মেঘের গর্জনেই সীমাবদ্ধ নয়। আলোর ঔজ্জ্বল্যে কিংবা বর্ণে তারতম্য ঘটলে সেখানেও শব্দ হয়। প্রতিটি রঙেরই কিন্তু নিজস্ব এক-একটি ধ্বনি রয়েছে, কান পাতলে শোনা যায় তাদের সে ভাষা। ঠিক তেমনি প্রতিটি বজ্রপাতের, এবং মেঘের গর্জনেরও এক-একটি আলাদা নাম-পরিচয় রয়েছে। এদের আমি আমার ভালোবাসার মানুষদের নামে ডাকি।
আকাশের ঐ চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বলতা আর বজ্রধ্বনির মাঝেই মিশে আছে আমার মা, আমার বোন, আমার ভাই ড্যানিয়েল। শুধু আমার পরিবারের মানুষেরাই নন, মেঘেদের প্রবল সে গর্জনের মাঝে আমি খুঁজি কবি ইয়োভান ইয়োভানোভিচ জমাইসহ সার্বিয়ার ইতিহাসের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকেও। যে অগ্নিগর্ভ বাজ রাতভর প্রবল আক্রোশে পৃথিবীতে আছড়ে পড়ে গাছ বা গ্রাম পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে যায়, যে বজ্রপাত পৃথিবীর জন্য আশীর্বাদ হিসেবে বৃষ্টিও নিয়ে আসে, তার প্রত্যেকটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আসিসাইয়া, ইজেকিয়েল, লেওনার্দো, বেথোভেন, গয়া, ফ্যারাডে, পুশকিন– এই নামগুলো। কোনো বজ্রপাতই একরকম নয়; তাদের ঔজ্জ্বল্যে, তীব্রতায়, শক্তিতে, আওয়াজে পার্থক্য রয়েছে। হাজারো বজ্রপাতের ভেতরেও আমি কিন্তু ওদের সবাইকেই আলাদা করে চিনে নিতে পারি।
উইলিয়াম ব্লেক বিশ্বাস করতেন এই মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছে মানুষের কল্পনা বা উদ্ভাবনী শক্তি থেকে, তাই যতদিন পর্যন্ত এই পৃথিবীতে শেষ একজন মানুষও বেঁচে থাকবে, এই সৃষ্টিও টিকে থাকবে ঠিক তদ্দিনই। মানুষের এই কল্পনা প্রবল সৃষ্টিশীল একটি শক্তি, যা আলোকশক্তিরই নামান্তর মাত্র।
আমি আমার কল্পনাকে কোনো এক জায়গায় আটকে রাখতে চাইনি, একই সাথে নিজেকে আবেগ এবং স্বপ্নের বাহুল্যেও ভেসে যেতে দেইনি। যখন যে কাজে হাত দিয়েছি, তাতেই আমি উচ্ছ্বাস খুঁজে নিয়েছি, নিজের উদ্দীপনাকে সব সময় চাঙ্গা রেখেছি। এর হাত ধরেই নতুন নতুন উদ্ভাবনী চিন্তা একের পর এক এসেছে আমার কাছে।
আপনি বলেছেন, এই গোটা সৃষ্টিজগতের বাকি সব সত্তার আমিও অভিন্ন একটি অংশ, আমিও আপনার মতোই আলোবিশেষ। আপনার মুখে কথাটা শুনে বেশ গর্বই বোধ হচ্ছে, কিন্তু আমি আসলে এর কিছুই বুঝিনি।
বোঝাটা কি খুব জরুরি, মি. স্মিথ? শুধু বিশ্বাস করুন। সবকিছুই আলো। প্রতিটি জাতির নিজস্ব এক-একটি আলোকরশ্মি রয়েছে, যেখানে সে জাতিটির ভাগ্য নিহিত, আর এই সবগুলো রশ্মি এক হয় সেই মহা উৎসে গিয়ে, যাকে আমরা সূর্য হিসেবে জানি। জন্মালে তো মরতেই হবে; মৃত্যুর পর মানুষ সেই আলোর সাথেই মিশে একাকার হয়ে যায়। আলোতেই তখন আমাদের অস্তিত্ব। গোপন রহস্যটি হলো, আলোর কণা তাদের প্রাথমিক অবস্থায় ফিরে আসে।
এ তো পুনরুত্থান! আমি বরং বলব এটি পূর্বের শক্তিতে ফিরে যাওয়া। আমি এখন এই মানবশক্তি সংরক্ষণের পথ খুঁজছি। এও সেই আলোরই রূপ। আমি কিন্তু নিজের প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে এ কাজ করছি না, বরং সবার কল্যাণের জন্যই করছি। আমি মনে করি, আমার আবিষ্কারগুলো মানুষের জীবনকে সহজ ও সহনীয় করে তুলেছে, এবং তাদের আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিকতার দিকেও নিয়ে চলেছে।
আপনার মতামত জানানঃ