কবির হোসেন : দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নিজেদের প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে ভারত-চীনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সবসময়ই বিদ্যমান। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোতেও নাক গলাতে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া দ্বৈরথের মতো ভারত-চীনও নাক টানতে টানতে চলে আসে। কোন দেশের সাথে কার সম্পর্ক কতটা উন্নত, কে কার চেয়ে বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক দিক দিয়ে এগিয়ে আছে, এনিয়ে চলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এমনকি করোনা মহামারিকালীন সময়টুকুতেও কারো অবসর নেই। ভ্যাকসিন দিয়ে রাজনৈতিক সম্পর্ক রক্ষায় দুই দেশই এগিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিয়ে।
টিকা সরবারহ করে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও মজবুত করার লক্ষ্যে ভারত বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে করোনা টিকার কয়েক কোটি ডোজ পাঠাতে পারে ভারত। বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ায় চিনের প্রভাবকে টক্কর দিতে টিকা দিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর ‘মন জয়ে’র লক্ষ্যে নেমেছে ভারত।
ইতিমধ্যেই মালদ্বীপ, ভুটান, বাংলাদেশ এবং নেপালে কোভিশিল্ড টিকা পাঠাতে শুরু করেছে ভারত। মায়ানমার এবং সিসিলিকেও বিনামূল্যে টিকা সরববরাহ করা হবে বলে সূত্রের খবর।
নেপালের সঙ্গে ভারতের টানাপোড়ন সম্পর্ক রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে টিকা সরবরাহে ভারতের ভূমিকায় দু’দেশের সম্পর্ককে মজবুত করার লক্ষ্যে ভারত আগালেও আখেরে তেমন কোনো লাভ হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। কালাপানি সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের দ্বন্দ্ব এখনো পুরনো হয়নি। এদিকে ভারতে নেপাল সরকারের আপত্তিকর ও অগ্রহণযোগ্য সংবাদ পরিবেশন করায় নেপাল দেশটিতে ভারতের প্রায় সবকটা চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছে। এসব সহ সাম্প্রতিককালে ভারতের সাথে নেপালের সম্পর্কের অবনতি আর চীনের সাথে নেপাল সরকারের বিভিন্ন চুক্তিকে সামনে রেখে বিশেষজ্ঞরা নেপালের বরফ ভারত অতটা গলাতে পারবে বলে মনে করেন না।
এদিকে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে বাংলাদেশে টিকা কেনার চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর ভারত ঘোষণা দিয়েছিল যে ভারত প্রতিবেশি দেশগুলোতে টিকা রপ্তানি আপাতত বন্ধ রাখবে। নিজ দেশের চাহিদা মেটানোর পর রপ্তানি করার কথা ভাববে তারা। এতে বাংলাদেশের টিকা প্রাপ্তি বিষয়ে এক জটিলতা দেখা দেয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ রুষ্ট হয়। ভারতের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তাই গুঞ্জন উঠেছিল, ভারত থেকে টিকা পাচ্ছে না সরকার। এরপরেই সবাইকে চমকে দিয়ে ভারত বাংলাদেশকে ২০ লক্ষ টিকা উপহার পাঠায়। একইসাথে ভারত প্রস্তাব দিয়েছে যে, ভারতের প্রতিষ্ঠান ভারত বায়োটেক তাদের উদ্ভাবিত করোনাভাইরাসের টিকার পরীক্ষা চালাতে চায় বাংলাদেশে। এ জন্য তারা সম্প্রতি আবেদনও করেছে। বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের একজন কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এ কথা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের পরিচালক মাহমুদ-উজ-জাহান রয়টার্সকে বলেছেন, ভারত বায়োটেকের কাছ থেকে এ রকম একটি প্রস্তাব তারা পেয়েছেন। তাদের এথিকস কমিটি আবেদনটি পর্যালোচনা করবে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) একটি সূত্রও রয়টার্সকে বলেছে, ভারত বায়োটেকের পক্ষে টিকা পরীক্ষার জন্য আবেদন করেছে। তবে এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে আইসিডিডিআরবি। ভারত বায়োটেকের মুখপাত্রদের তরফ থেকেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের টিকার তৃতীয় ধাপের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ (ট্রায়াল) করতে যাচ্ছে আনুই জিফেই নামের একটি চীনা প্রতিষ্ঠান। টিকার পরীক্ষার পাশাপাশি তারা যৌথ গবেষণা ও উৎপাদনের কারখানাও স্থাপন করতে চায়। এসব বিষয়ে চূড়ান্ত আলোচনার জন্য প্রতিষ্ঠানটির প্রেসিডেন্ট দু-এক দিনের মধ্যে ঢাকায় আসছেন। তবে চীনা এই প্রতিষ্ঠানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে অনুমতি দিয়েছেন বাংলাদেশ।
বিএসএমএমইউর উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়া গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে আনুই জিফেইয়ের সঙ্গে গবেষণায় যুক্ত হওয়ার বিষয়ে সম্মতি জানিয়ে চিঠি দিয়েছি। এখন তাদের প্রতিনিধিদল এসে কীভাবে কাজ করবে এ বিষয়টি বিস্তারিতভাবে ঠিক করবে। আগামী তিন-চার দিনের মধ্যে গবেষণা প্রটোকল (পরীক্ষাবিধি) চূড়ান্ত করা হবে বলে আশা করছি।’
দেশে টিকার পরীক্ষা করতে আসা চীনা প্রতিষ্ঠানটি হলো আনুই জিফেই লংকম বায়োফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড। বেইজিং থেকে গত মঙ্গলবার প্রতিষ্ঠানটির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মুঠোফোনে প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন, টিকা পরীক্ষা সফলভাবে শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশে যে টিকা উৎপাদিত হবে, তার একাংশ মুজিব বর্ষের উপহার হিসেবে পাবে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী।
এদিকে প্রতিবেশি দেশগুলোতে ভারত টিকা উপহার পাঠানোর কার্যক্রম শুরু করলেও তালিকায় নাম নেই পাকিস্তানের। কারণ প্রায় দুবছর হতে চলল ভারতের সঙ্গে সরকারি স্তরে তাদের প্রায় কোনও সম্পর্ক নেই।কিন্তু বাকি সব দেশে নিজস্ব টিকা পাঠিয়ে চীনের তৈরি সিনোভ্যাক বা সিনোফার্মকে পেছনে ফেলাও ভারতের লক্ষ্য, কারণ চীনও কিন্তু তাদের ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেটগুলোকে সারা দুনিয়ায় প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে। এরই লক্ষ্য হিসাবে চীন পাকিস্তানকে পাঁচ লক্ষ টিকা উপহার পাঠাচ্ছে।
মোদী সরকারের ভ্রান্ত নীতির কারণে নিজেদের নেইবারহুড বা প্রতিবেশে ভারত ‘বন্ধু’দের হারিয়ে এক বিপজ্জনক অবস্থানে রয়েছে। ভারতের বর্তমান সরকার ঘরোয়া রাজনীতিতে নিজেদের দৈত্য বলে মনে করে, যাদের কোনও পরামর্শ বা সহযোগিতা লাগেই না আর তাদের পররাষ্ট্রনীতিতেও ঠিক সেটারই প্রতিফলন ঘটছে বলে প্রতিবেশি দেশগুলো ভারত থেকে সরে আসতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। তবে প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে পুনরায় সম্পর্ক স্থাপনে মোদি সরকারের ভ্যাকসিন উপহার পাঠানোতে বরফ তেমন একটা গলবে বলে মনে করেন না তারা।
ভারতের শেষ কংগ্রেসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন সালমান খুরশিদ। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন, “প্রতিবেশী দেশগুলো আজ আমাদের প্রতি কতটা বন্ধুত্বপূর্ণ সেটা তো আর তর্কের বিষয় নয়, চোখের সামনে দেখাই যাচ্ছে। এই জন্যই আমাদের দলনেতা বলেছেন আমরা খুব দ্রুত বন্ধুদের হারাচ্ছি, যদি না এর মধ্যেই পুরোপুরি হারিয়ে থাকি।
তিনি বলেন, আফ্রিকা থেকে এশিয়া, মধ্য এশিয়া-আরব কিংবা নেইবারহুড চিরকাল আমরা সব দেশকে ‘ইক্যুয়াল পার্টনার’ ভেবে এসেছি, শক্তি-সামর্থ্য-অর্থনীতিতে ফারাক থাকলেও কখনও সেটা তাদের মনে করাতে যাইনি। আজ ভারতের বিরাট বাজার, দুনিয়ায় শক্ত অবস্থান ও শক্তিশালী আর্মি, কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা স্বেচ্ছাচারীর মতো আচরণ করতে পারব। মূল সমস্যা হল প্রতিবেশীদের সঙ্গে এই সমতার ভাবনাটাই আমরা ত্যাগ করেছি।
প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলো একে ভারত ছেড়ে যাচ্ছে আর চীন সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে লুফে নিচ্ছে সম্পর্ক। করোনা চলাকালীন সময়েও চীন প্রতিবেশি দেশগুলোতে মাস্ক স্যানিটাইজার সহ করোনা চিকিৎসায় ব্যবহার্য সামগ্রী উপহার পাঠিয়েছিলেন। এখন ভ্যাকসিনও উপহার হিসেবে পাঠাচ্ছেন প্রতিবেশি দেশগুলোতে। এতে প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে চীনের পূর্বেকার সম্পর্ক আরো মজবুত হচ্ছে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।
বিভিন্ন গবেষণায় ইতিমধ্যে জানা গেছে যে, করোনা বিশ্ব অর্থনীতি কিছুটা স্থবির থাকলেও চীন সেটাকে মোকাবিলা করে ইতিমধ্যে অনান্য দেশের তুলনায় গতি পেয়েছে বেশি। অনেক বিশ্লেষকই জানিয়েছেন, বিশ্ব অর্থনীতি স্থবির থাকলেও চীনের অর্থিনীতি ছিল চাঙ্গা। সেন্টার ফর ইকনোমিক্স এ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) নামে যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি বলছে, করোনাভাইরাস মহামারি এবং তার অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া চীনের অনুকুলে কাজ করেছে। বলা চলে, অর্থনীতির ঘোড়-দৌড়ে চীন অনেক এগিয়ে এসেছে। বিভিন্ন গবেষণা আমেরিকার অর্থনীতিকে পেছনে ফেলতে চীনের দশ বছর সময় বেঁধে দিলেও চীন পাঁচ বছরেই কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এক বছর আগেও মনে করা হচ্ছিল যে অর্থনীতির আকারের দিক থেকে চীন ২০৩০এর দশকের প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িযে যাবে। কিন্তু গবেষণা বলছে, এ দশক শেষ হবার আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠবে চীন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, চীনের অর্থনীতির এই ক্রমাগত উন্নয়নে সবেচেয়ে বেশি প্রভাব রাখবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। ইতিমধ্যে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দিক দিয়েও চীন প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে সম্পর্কোন্নয়নে অনেকখানিই এগিয়ে গেছে, সেখানে ভারতের ভ্যাকসিন উপহার দিয়ে নিজেদের মুখ রক্ষা বৈ দ্বন্দ্বের বরফ গলবে বলে মনে করেন না তারা।
এসডব্লিউ/কেএইচ/২১৩০
আপনার মতামত জানানঃ