ভাষার নিজস্ব বলয় রয়েছে। কোনো ভাষার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেখানকার জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ওয়ারিশ। সে সাংস্কৃতিক শেকড় জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক চেতনাকেও প্রভাবিত করে। মানদণ্ড তৈরি করে উচিত ও অনুচিতের। সীমারেখা নির্ধারণ করে দেয় ঠিক ও ভুলের মধ্যে। প্রতিটি স্থান ও সময়ের রাজনীতিতে তাই সেখানকার ভাষা ব্যবহার ও বিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমাজে সরব থাকা শব্দগুলো কেবল অতীতের সঙ্গেই বর্তমানকে যুক্ত করে না, যুক্ত করে বৌদ্ধিক গতিশীলতার সঙ্গেও। দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলমানরা শাসন ক্ষমতা নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানকার ভাষিক পরিবর্তন ছিল বিশেষভাবে নজর দেয়ার মতো। স্থানীয় জীবনাচার ও ইসলামের ভেতরকার ধারণার মধ্যে মিথস্ক্রিয়া মুসলিম রাষ্ট্রচিন্তা ও দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রচিন্তা উভয়ের ইতিহাসেই বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। রাজনৈতিকভাবে এখানে বহুল ব্যবহৃত শব্দের উৎস ছিল মুসলিম ধর্মীয় ঐতিহ্য, পূর্ববর্তী পণ্ডিতদের পুস্তক, সুফিদের চিঠিপত্র ও স্থানীয় রাজনৈতিক চর্চা। ভারতে ইসলামের রাজনৈতিক উত্থান একদিকে স্থানীয় স্বাক্ষর ধরে রেখেছে; অন্যদিকে মুসলিম রাষ্ট্রচিন্তার ধ্রুপদি পরম্পরা। বিষয়টি বিষদভাবে আলোচনা করেছেন ঐতিহাসিক ও তাত্ত্বিক মোজাফফর আলম তার লেখা ‘The Languages Of Political Islam: India 1200-1800’ গ্রন্থে।
প্রথমেই ইসলামের রাজনৈতিক সংস্কৃতি শব্দবন্ধে মনোযোগ দেয়া যেতে পারে। ইতিহাস কোনো একটা সময়ে স্থির না। তরবারি দিয়ে সাম্রাজ্য বিস্তার মুসলিম রাজনীতির শেষ কথা ছিল না। বরং সাংস্কৃতিক আশ্রয় হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করেছে নিজেকে। সংস্কৃতি ছিল মুসলিম রাজনীতির ভেতরের দিক। দক্ষিণ এশিয়ার ত্রয়োদশ-অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইতিহাস অন্তত সেটাই প্রমাণ করে। এ সময়ের মধ্যে ভারতে ইসলাম বোঝাপড়ায় ভাষার বিবর্তন ও বেড়ে ওঠা পরিণত হয়েছে মুখ্য নিয়ামকে।
আরব ভূখণ্ড থেকে ইসলামের উত্থান সপ্তম শতাব্দীতে। তার আগেও আরব ও ভারতীয় বণিকদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল। তাদের মধ্য দিয়েই ভারতের বিভিন্ন অংশে প্রভাব বিস্তৃত হতে থাকে মুসলমানদের। অষ্টম শতাব্দীর গোড়ার দিকে আরবদের সিন্ধু অধিকারের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়। একাদশ শতাব্দী থেকে গজনবী সালতানাতের বিস্তৃতিতে প্রভাবিত হয় উত্তর ভারতের উল্লেখযোগ্য অংশ। দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যেই ইসলামী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দিল্লিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। অল্প কিছুদিনের মধ্যে বাংলায়ও বিস্তৃত হয় রাজনৈতিক শেকড়। পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে ইসলাম ও রাষ্ট্রক্ষমতার মধ্যকার সম্পর্ক নানাভাবে পঠিত ও বিশ্লেষিত হয়েছে। মোগল আমলে দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিম রাষ্ট্রধারণা ও ক্ষমতার চর্চা পৌঁছায় শীর্ষে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসে মোগলরা আঞ্চলিক ও ব্রিটিশ শক্তির কাছে ক্ষমতা হারাতে থাকে। এ সময়ে রাষ্ট্র সম্পর্কে ইসলামী ঐতিহ্যে থাকা পরিভাষাগুলো সবসময় একরকম থাকেনি। বরং তৈরি করেছেন নিজস্ব দ্যোতনা।
ভারত ও বাংলায় ইসলামের রাজনৈতিক উত্থান মূলত তুর্কি-পারসিক দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে। ফলে এখানকার রাষ্ট্রকাঠামোয় ব্যবহৃত পরিভাষায়ও পারসিক প্রভাব বিদ্যমান। তাদের শব্দভাণ্ডারে যতটা না আরব প্রভাব ছিল; তার চেয়ে বেশি ছিল পারসিক ও মধ্য এশীয় প্রভাব। মুসলিম লেখকরা ক্ষমতা, রাষ্ট্র, সরকার, আনুগত্য, বিদ্রোহ, শাসক, শাসিত, বিজয়, পরিচয়, যুদ্ধ, শান্তি ও সন্ধিকে বোঝানোর জন্য বিশেষভাবে আলোচনা করেছেন। তা একদিকে যেমন ঐতিহাসিকদের আলোচনায় ঠাঁই পেয়েছে; অন্যদিকে এসেছে দার্শনিক রচনাবলিতেও। সে অভিধাগুলোই নানা সময়ে নানাভাবে ব্যবহার হয়েছে। খলিফা, আমির ও সুলতান শাসক অর্থে তিনটি অভিধাই ব্যবহার হয়েছে মুসলিম ইতিহাসজুড়ে। খলিফা ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নিয়ন্তা হিসেবে থেকেছেন; অন্যদিকে সুলতান ছিলেন অনেক বেশি ধর্মনিরপেক্ষ। আবার একই শব্দের ব্যঞ্জনাও সমান ছিল না। সুলতান শব্দের কথাই ধরা যাক। মুসলিম শাসনের প্রাথমিক দিনগুলোয় সুলতান শব্দের যে অর্থ দেখা গেছে; অষ্টম শতাব্দীতে তা দেখা যায়নি। দিল্লি ও বাংলার শাসকরা সুলতান তকমা ব্যবহার করলেও পরে মোগলরা নিজেদের জন্য এ শব্দ ব্যবহার করেননি। তারা বরং ব্যবহার করেছেন শাহজাদা ও পাদিশাহর মতো শব্দ। মোগল আমলে লাহোরকে দারুস সুলতান বা সুলতানের আবাসভূমি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ সুলতান শব্দের ব্যবহার পরিবর্তন হয়ে গেছে। এভাবে ইসলামের পরিভাষাও পরিবর্তন হয়েছে। সুলতান ক্রমে একটা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান আকারে প্রকাশিত হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার আবহে আসার পর মুসলমানদের রাজনৈতিক পরিভাষা আগের মতো থাকলেও তার অর্থ একরকম থাকেনি। কিছুটা ভারতীয় ভাবধারা গ্রহণ করেছে, কিছুটা পারসিক। ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্ক প্রশ্নে বিশুদ্ধবাদী ইসলামকে অনেকটাই তাত্ত্বিক মনে করা হয়েছে; যার সঙ্গে বাস্তবের দূরত্ব ঢের। এমন নজির অবশ্য আগেও দেখা গেছে। আরবীয় ইসলাম পারস্যে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই মুসলমানরা ইসলাম-পূর্ব পারসিক শব্দ ও ধারণা গ্রহণ করেছিল। আব্বাসি আমলে ইসলাম ত্যাগকারীকে জিন্দিক বলা হতো, কিন্তু জিন্দিক শব্দের আভিধানিক অর্থ জেন্দাবেস্তাকে অস্বীকারকারী। এদিকে খোদা, নামাজ কিংবা রোজার মতো শব্দগুলোও পারসিক উৎসজাত। জনজীবনের সঙ্গে সম্পর্কের প্রয়োজনেই ভাষিক দূরত্ব কমে এসেছে ব্যবহারের দিক থেকে। অভিধান আচারকে শাসন করেনি, বরং আচার নতুন মাত্রা যোগ করেছে অভিধান। ফলে ভারতে আসার পর ইসলাম যেন নিজস্ব একটা রূপ পরিগ্রহ করেছে।
মুসলিম রাজনীতি ও সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করাটা গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতা ছিল। স্বাভাবিকভাবেই অভিধানে ‘শরিয়াহ’ ছিল নিয়মিত খুঁজে পাওয়া শব্দ। তবে ভারতে সুলতানরা নিজেদের মতো করে শরিয়াহকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। রাজনৈতিক আবহে দাঁড়িয়ে ব্যাখ্যা পুনর্ব্যাখ্যা করেছেন এখানকার পণ্ডিতরাও। সেখানে যে দ্বৈততা ছিল না, এমন না। এমনকি খোদ আকবরের দরবারেও উলামা শ্রেণী ১৫৭৯ সালে নিজেদের মতো করে বুঝতে চেয়েছেন শরিয়াহকে। প্রতিক্ষেত্রে রাষ্ট্র, সরকার পরিচালনা ও পরিচালনায় নতুন নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে শরিয়াহ ধারণায়। অবশ্য আকবরের পর থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত মোগল দরবারে শরিয়াহ খুব বড় রাজনৈতিক বয়ান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থাকেনি।
মোগলরা মধ্য এশিয়ার ওয়ারিশ হিসেবে ‘তুরা ই চেংগিজি’র প্রভাব আগে থেকেই গ্রহণ করেছিল। প্রতিদিনকার রাজনৈতিক জীবনে তার ছাপ ছিল। মধ্য এশিয়ার যাযাবর জীবনের কারণে আরবীয় শরিয়াহ তাদের জন্য প্রায়োগিক বিবেচিত হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই ইসলাম-পূর্ব নীতিপদ্ধতি ও জীবনাচারের সঙ্গে ইসলামের মিথস্ক্রিয়ায় তাদের হাতে জন্ম নিয়েছিল নয়া রাষ্ট্রচেতনা। ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকেই মধ্য এশিয়ার মুসলমানদের ইসলামচিন্তায় নানা প্রশ্ন ছিল। মোঙ্গলদের ক্ষমতা ও প্রভাবের কারণেই সনাতন ইসলামচিন্তা প্রশ্নাতীত থাকেনি। ফলে নতুন করে ব্যাখ্যাত হতে থাকে অনেক বিষয়ই। মোঙ্গল-পরবর্তী সময়ে সুফিরাও যেন আরো বেশি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠলেন। সুফি নেতাদের এখানকার রাজনৈতিক পরিসরে ভূমিকা নিতে দেখা গেল। নিজামুদ্দিন আউলিয়ার ফাওয়ায়িদুল ফাওয়াদ তার বড় দলিল। বাংলায় নুর কুতুবুল আলম, আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানি ও কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী নিজেদের মতো করে অবস্থান নিয়েছেন ক্ষমতা কাঠামোর বাঁক নিয়ন্ত্রণে।
আরব ইসলামকে পেয়েছে নিজ বাসভূমে। ফলে ক্ষমতা প্রশ্নে কিছু বাড়তি সুবিধা পেয়েছে। ইসলাম বিস্তৃতির পর অনারবদের মধ্যে প্রথম যে প্রশ্নের মোকাবেলা করা প্রয়োজন পড়ে, সেটা হলো আরববাদ ও ইসলামকে আলাদা করে শনাক্ত করা। বিশেষ করে মধ্য এশিয়ায় ইসলামকে বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে আরববাদকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে যৌক্তিক টানাপড়েন ছিল। অনারব তথা আজম জনসাধারণ নিজেদের সংস্কৃতি, ভাষা ও সামাজিক ধ্যানধারণাকে নিজেদের মতো করেই পরিশোধন করে নিয়েছিলেন। আরববাদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক দিনগুলোয়ই শুয়াইবিয়া ও মাওয়ালি আন্দোলন হয়। তারা নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয়ের মধ্য ক্ষমতার সঙ্গে বোঝাপড়া করেছেন। এভাবে মোঙ্গল-পরবর্তী ইসলামে বড় অংশজুড়েই ছিল মধ্য এশীয় উপাদান। তারা যখন ভারতে প্রবেশ করে, সে ছাপ সঙ্গে আসে।
ইসলাম ও ভারতীয় মোয়ামেলার মধ্য দিয়ে একটা সংস্কৃতি দাঁড়ায়নি। বরং অনেক বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে। তারা এখানকার মুসলমানদের ক্ষমতার বোঝাপড়া ও তার চর্চাকেই তুলে ধরে। মুসলিম রাজনীতি সে আইডিয়া ও চর্চার মধ্যে পার্থক্যও ছিল। মুসলিম ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক দার্শনিকদের মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছেন জিয়াউদ্দিন বারানি, মীর সায়িদ আলি হামদানি, নাসির উদ্দিন তুসি। আরো অনেকেই লিখেছেন ইতিহাস ও রাজনীতি নিয়ে। তাদের বর্ণনায় নানাভাবে ব্যাখ্যা হয়েছে ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক। মুসলিম রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে আরো আগে ছিলেন আবুল হাসান মাওয়ার্দি, নিজাম উল-মুলক, ইমাম গাজালি ও মুদাব্বির। দীর্ঘদিন ধরে যে শব্দভাণ্ডার গড়ে উঠেছে; সে সিলসিলায় নিজের মতো করে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছেন পরবর্তী পণ্ডিতরা।
প্রসঙ্গক্রমে প্রাথমিক ইসলামের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মতবিরোধকে সামনে আনা যেতে পারে। ফিকহি মাজহাব ও কালামি ধারার মতো নানা মতের উপস্থিতি ইসলামের ভেতরেই বহুমতের উপস্থিতির প্রমাণ দেয়। ফলে শরিয়াহ, খলিফা, সুলতান ও আমিরের মতো বিষয়গুলো নানা পরিস্থিতিতে ভিন্ন হয়েছে। সেখানে ভূমিকা রেখেছেন মুফতি, কাজি, মৌলভি ও সুফিরা। জিয়াউদ্দিন বারানি যথেষ্ট সেকুলার ও প্র্যাকটিক্যাল চিন্তা দেখিয়েছেন তার ‘ফতোয়ায়ে জাহান্দারি’ পুস্তকে। সেদিক থেকে নাসির উদ্দিন তুসির ‘আখলাকে নাসিরি-তে অবশ্য তেমন অবস্থান নেননি। তিনি শরিয়াহকে নতুন করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। চেষ্টা চালিয়েছেন উপস্থিত সমস্যার সমাধানে দলমত ধারণার ঊর্ধ্বে ওঠার।
আখলাকে নাসিরির ‘আখলাক’ ঐতিহ্য ছিল মোঙ্গল-পরবর্তী জীবনাচার প্রভাবিত। রাজনৈতিক সংস্কৃতিক, দর্শন ও নৈতিকতা এখানে আরো বেশি প্রায়োগিক। গঠিত হয়েছে রাজনৈতিক অভিজাতবর্গ। তাদের ওপরে গ্রিক ও পারসিক ধ্যানধারণার তাছির ছিল। বিশেষ করে ইবনে সিনা ও আল ফারাবির লেখা তাদের প্রভাবিত করেছে। মোগল দরবারের ক্ষমতা কাঠামো পাঠ করতে গিয়ে সেখানকার সামরিক ও সরকারি বিভিন্ন পদে রাজপুত, কায়স্থ, ক্ষত্রিয়দের নিয়োগ দেয়া দেখতে পাওয়া যায়। মোগলদের মাতৃপক্ষ মূলত রাজপুতরাই। এটা তাদের রাজনৈতিক বোঝাপড়াকে প্রভাবিত করেছে। এজন্যই দেখা গেছে জিজয়া থাকবে কিনা সেটা ছিল অন্যতম বয়ান-প্রতিবয়ানের বিষয়।
দিল্লি আর আগ্রাকে বলা হতো যথাক্রমে দার আল খলিফা ও মুসতাকদারে খলিফা। অথচ মোগল সম্রাটদের খলিফা বলার রেওয়াজ ছিল না। খলিফা ধারণার রাজনৈতিক বাস্তবতা ততদিনে শেষ। তার মর্যাদা টিকে ছিল নেহাত রূপক হিসেবে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভিন্ন ব্যাখ্যা। যদিও রাষ্ট্রচিন্তকরা ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে। তার পরও তাদের ভাষিক অভিধান ছিল অভিন্ন। বিশেষ করে ইসলাম ও রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ককে তারা পাঠ করতে চেয়েছেন। এক্ষেত্রে নিজাম উল-মুলক তুসি যদিও শরিয়াকে প্রাধান্য দিয়েছেন, কিন্তু তার আলাপে বিচারিক ব্যবস্থা প্রাধান্য পায়নি। বরং তার ভাষ্য অনুসারে, খোদা বিভিন্ন নবী ও সম্প্রদায় প্রেরণ করেছেন তাদের নিজস্ব শরিয়াহর জন্যই। বারানির শরিয়াহ আর তুসির শরিয়াহর সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্রের সম্পর্ক একরকম ছিল না।
মুসলিম শাসন ব্যবস্থাজুড়ে রাজনৈতিক অভিধানের কেন্দ্রে অবস্থান করেছে ন্যায়বিচার প্রশ্ন। মাওয়ার্দি আদালতকে নৈতিক ও ধর্মীয় বিশুদ্ধতা হিসেবে গণ্য করেন। অন্যদিকে ইবনে ইউসুফ একে পাঠ করেন ন্যায়বিচার হিসেবে। আবার নিজাম উল-মুলক তুসির ভাষায় বিরোধী পক্ষকে চুপ করিয়ে রাখা রাজার জন্য ন্যায়বিচারের মধ্যেই পড়ে। সেক্ষেত্রে সুফিদের রাজনীতি বোঝাপড়া কিছুটা ভিন্ন। তারা সরাসরি রাজনীতিতে ব্যাপৃত হতেন না সে অর্থে। বাবা ফরিদ, নিজাম উদ্দিন আউলিয়া, শায়খ আহমদ শিরহিন্দের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক বোঝাপড়া এগিয়ে গেছে। মুসলিম রাজনৈতিক পরিভাষায় অন্যতম ভূমিকা রেখেছে তৈমুরিয় আচার ও নীতিমালা। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইসলাম-পূর্ব পারসিক কানুন। মোগল আমলের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক শব্দভাণ্ডারে ফারসি ভাষা এভাবেই পোক্ত আসন তৈরি করে। প্রশ্ন থাকতে পারে ভারতীয় মুসলিম জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ভাষা হিসেবে কেন আরবির চেয়ে ফারসি প্রভাবশালী হয়ে উঠল। এর প্রধান কারণ ফারসি বড় পরিসরে একটা রাজনৈতিক সুসংহত ভাষা আগে থেকেই তৈরি করে রেখেছিল। পারসিক সাহিত্যিক উৎস বিশাল।
ফারসি ভাষার মধ্য দিয়েই মোগল আমলে সর্বভারতীয় ধারণা বিস্তৃত হয়েছে। ত্রয়োদশ-অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত কেবল ইসলামের ভেতরে না; ইসলামের ভেতরের মতবাদগুলোর মধ্যেও রাজনৈতিক বাহাস তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সে কথা দিল্লির জন্য যতটুকু প্রযোজ্য, ততটুকুই প্রযোজ্য বাংলার জন্য। এখানকার রাজনৈতিক চেতনা গঠন করতে ইসলামী পরিভাষায় প্রবেশ করেছে স্থানীয় ধারণা। ফলে পুনর্নির্মিত হয়েছে ক্ষমতার কাঠামোর সঙ্গে সম্পর্কিত শব্দ। স্থানীয় রাষ্ট্রচিন্তা, মুসলিম পণ্ডিত, কোরআন-হাদিস, সুফির খানকা, শাসক, রাষ্ট্রচিন্তক ও ঐতিহাসিক সবাই যার যার মতো অংশগ্রহণ করেছে সেই ভাবগত অগ্রগতিতে। এভাবে শব্দ একটি হলেও তার অর্থ গতিশীল থেকেছে। নতুন প্রেক্ষাপটে নতুন রাজনৈতিক আবহে নতুন ব্যাখ্যায় ব্যবহার হয়েছে পুরনো শব্দ। ক্ষমতা কাঠামোয় মিলন ঘটেছে ঐতিহ্যবোধ ও প্রগতিচেতনার।
আপনার মতামত জানানঃ