উম্মুল ওয়ারা সুইটি : আবারও অশান্ত হয়ে উঠছে পাহাড়। চিরসজীব সবুজ পাহাড়ের জনপদে খুনোখুনি, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড, অপহরণসহ নানা অপকর্ম এখন প্রতিদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এলাকার বাসিন্দারা এখন দিনের আলোতেই আতঙ্কে জীবন যাপন করছেন। দুই বছর ধরে পাহাড়ে বেশি অস্থিরতা বিরাজ করছে। পার্বত্য জেলাগুলোর দুর্গম উপজেলাগুলোয় এখন অস্ত্রের মহড়া চলছে। ভয়ে কেউ মুখ খুলছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পক্ষেও এসব দুর্গম এলাকায় যাওয়া সম্ভব নয়।
আমাদের রাঙ্গামাটি, বান্দরবার ও খাগড়াছড়ি প্রতিনিধির কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ২০১৯ সালের ২ জানুয়ারি থেকে পার্বত্য এলাকায় গত ২২ মাসে ৩৩ নারী-পুরুষ খুন হয়েছে। গত ২৫ মার্চ থেকে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত খুন হয়েছে ১৬ জন। স্থানীয়রা বলেছেন, পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একের পর এক নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটছে।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাঙ্গামাটির নানিয়ারচরে সেনাবাহিনীর একটি টহল দলের ওপর সশস্ত্র হামলায় এক সেনাসদস্য আহত হওয়ার পর পাল্টা হামলায় হামলাকারীদের দুজন নিহত হওয়ার পর পাহাড়ে থমথমে পরিস্থিতি চলছে। নিহত দুজনই ইউপিডিএফের কর্মী। ঘটনাস্থল থেকে একটি একে-২২ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষক, মানবাধিকার ও পাহাড়ের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বলছেন, পাহাড় অশান্ত হওয়ার প্রধান কারণ হলো কর্র্তৃত্ববাদ। পাহাড়ের নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া এখন চারটি গ্রুপ। আর এদের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বিভিন্ন মহলের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়। এই চারটি দলের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলতেই থাকে। যত দিন যাচ্ছে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হলে পাহাড় শান্ত হবে না।
তিন জেলার ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা বলছেন, পাহাড় অশান্ত রাখার জন্য বড় ভূমিকা রাখছে শান্তিচুক্তিবিরোধী চক্র। আদিবাসীর সহজ সরল জীবনে হঠাৎ আশির দশকে বাঙালি জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনও এর জন্য দায়ী। আবার ১৯৯৮ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৩ বছরেও আলোর মুখ না দেখায় পাহাড়ের বাসিন্দাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। আর এই হতাশা থেকে ক্ষোভ জন্ম নিয়েছে। দীর্ঘ দুই যুগের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে নিজেদের মধ্যে অস্তিত্বসংকটে ভুগতে শুরু করেছে পাহাড়ের নতুন প্রজন্ম। ফলে তাদের মধ্যে বিভক্তি ও অসন্তোষ বাড়তে বাড়তে এক দুই করে চার দলে ভাগ হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, তারা পাহাড়ে শান্তি চান। আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর নেতাদের মধ্যে নিজেদের স্বার্থ নিয়েই কোন্দল চলে। আবার দল চালাতে অর্থ সংগ্রহের নামে চাঁদাবাজি এবং অস্ত্রসহ নানা অপকর্ম চলে।
স্থানীয়দের অভিমত, রাঙ্গামাটির বিভিন্ন উপজেলা দুর্গম হওয়ায় সেখানে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের অভয়ারণ্যে রূপ নিয়েছে। জোর করে দলে টানতে ভয়ভীতি পর্যন্ত দেখানো হয়। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাঙ্গামাটির নানিয়ারচরে সেনাবাহিনীর একটি টহল দলের ওপর সশস্ত্র হামলায় এক সেনাসদস্য আহত হওয়ার পর পাল্টা হামলায় হামলাকারীদের দুজন নিহত হয়েছে। নিহত দুজনই ইউপিডিএফের কর্মী। ঘটনাস্থল থেকে একটি একে-২২ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
আঞ্চলিক পরিষদের একজন নেতা বলেন, ১৯৭৬ সালে বরকল উপজেলায় টহল পুলিশের ওপর হামলার মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে এ সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন ইউপিডিএফ। পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করার অপতৎপরতা রুখতে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই সেই সময় সরকার সমতল থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভূমিহীন ও দরিদ্র বাঙালিকে পুনর্বাসন করে পার্বত্য অঞ্চলে। এরপর থেকে নতুন করে যুক্ত হয় ভূমিবিরোধ। দুই দশক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সই হয়। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমার সঙ্গে এই চুক্তি সই হয়। খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে প্রায় ২ হাজার সশস্ত্র বিদ্রোহী শান্তিবাহিনীর সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে সরকারের কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন সন্তু লারমা।
তবে ওই চুক্তির বিরোধিতা করে খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামেই কালো পতাকা প্রদর্শন করে জনসংহতি সমিতির সহযোগী ছাত্রসংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের একটি অংশ। চুক্তির বিরোধিতা করে সন্তু লারমার সংগঠন থেকে বের হয়ে প্রসীত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) গঠিত হয় ১৯৯৮ সালের ২৬ জুন। যদিও তখন ইউপিডিএফের সদস্যরা দীর্ঘ ১০ বছর তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি। কিন্তু শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষোভ বাড়তে থাকে। ২০১০ সালে সন্তু লারমার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন ও আদিবাসীদের বিভিন্ন অধিকারের দাবিতে সুধাসিন্ধু খীসা ও তারিন্দ্র লাল চাকমার (পেলে) নেতৃত্বে জন্ম হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) নামে পাহাড়ে আরেক নতুন সংগঠন। এরপর সর্বশেষ ২০১৭ সালের নভেম্বরে খাগড়াছড়িতে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ভেঙে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামের নতুন সংগঠন জন্ম নেয়। এ নিয়ে এখন পাহাড়ে চারটি আঞ্চলিক দলের তৎপরতা রয়েছে।
ইতিহাসবিদ ও গবেষক অধ্যাপক ড. মেজবাহ কামাল বলেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়াই পাহাড় অশান্ত হওয়ার প্রধান কারণ। রাষ্ট্র যদি শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় পাহাড়ে দ্রুত শান্তি ফিরে আসবে। পাহাড়ে অস্থিরতার জন্য এসব দল তৈরি করা হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী পাহাড়ের মানুষদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিতের পক্ষে মত দিয়ে এই গবেষক বলেন, এটা একটা রাজনৈতিক সমস্যা। তাই রাষ্ট্রকেই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। কিন্তু সেটি না করে বিভিন্ন গ্রুপকে উসকে দেওয়া হচ্ছে। পরিস্থিতি এখনই সামাল দেওয়া উচিত। আমরা এর রাজনৈতিক সমাধান চাই।
প্রসীত বিকাশ নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের সংগঠক অংগ্য মারমা বলেন, মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীগুলোকে ধ্বংস করার জন্য প্রত্যক্ষ মদদে এ ধরনের পরিকল্পিত হত্যাকা- ঘটছে। পাহাড়ের জনগণের স্বার্থে সব দল এক সঙ্গে কাজ করার ঘোষণা দেওয়ার পরও কারও কারও ইন্ধনে হত্যাকান্ড বন্ধ হচ্ছে না। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক সমস্যা। আর এই সমস্যাটি রাজনৈতিকভাবে সমাধানের মাধ্যমে অর্থাৎ চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ছাড়াও পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে এই অঞ্চলের শান্তি স্থাপন সম্ভব হবে। সরকার চাইলেই এই সংঘাত বন্ধ হতে পারে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ান বলেন, পাহাড়ে শান্তি স্থাপনের জন্য চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আইন যদি তার নিজস্ব গতিতে চলতে পারে তাহলে এখানে শান্তি আসতে বাধ্য। তিনি বলেন, প্রাণহানির ঘটনা কমাতে হলে রাষ্ট্রকে ও শান্তিচুক্তির পক্ষে বিপক্ষে যেসব দল রয়েছে তাদের সমস্যা সমাধানে আন্তরিক হতে হবে, তাহলেই পাহাড়ে শান্তি স্থাপন হবে বলে আমি মনে করি। অধ্যাপক বাঞ্ছিতা চাকমা বলেন, পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে হলে সব পক্ষকে আন্তরিক হতে হবে। আন্তরিকতায় কোনো ধরনের ফাঁকফোকর থাকা যাবে না। তাহলেই পাহাড়ে অবশ্যই শান্তি ফিরবে।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সুনীল কান্তি দে বলেন, পাহাড়ের হত্যাকান্ড একটি রাজনৈতিক সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানে শান্তিচুক্তির সম্পাদনকারী উভয় পক্ষের মধ্যে আস্থা স্থাপন করতে পারলেই পাহাড়ে শান্তি ফিরবে বলে আমি মনে করি।
প্রসীত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের সমালোচনা করে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)-এর সভাপতি শ্যামল কান্তি চাকমা বলেন, তারা তখন চুক্তির বিরোধিতা না করলে হয়তো পাহাড়ে আজ চারটি আঞ্চলিক সংগঠন হতো না। পাহাড়ে রক্তপাত বন্ধ হোক এটা আমরা সব সময় চাই। কিন্তু সন্তু লারমার জেএসএস ও প্রসীত খীসার ইউপিডিএফের কারণে এটি বন্ধ হচ্ছে না। তারা মুখে হানাহানি বন্ধের কথা বললেও সাধারণ পাহাড়িরা তাদের কথা বিশ্বাস করে না। তারা উভয়ে বিশ্বাসঘাতক।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) দলের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সুধাকর ত্রিপুরা বলেন, ‘পাহাড়ে কোনো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আমাদের দল জড়িত ছিল না। চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আমরা গণতান্ত্রিক আন্দোলন করে যাচ্ছি। চুক্তি বাস্তবায়ন হলে যাদের বেশি ক্ষতি হবে তারাই চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা তৈরি করছে। আমরাও চাই পাহাড়ে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজমান থাকুক। সবাই নিরাপদে শান্তিতে বসবাস করুক।’
শান্তিচুক্তির পর পাহাড়ে লাশের তথ্য পর্যালোচনা ও গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, চুক্তির পর চার সংগঠন সৃষ্টির মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত তিন পার্বত্য জেলায় ঘটছে খুনের ঘটনা। মূলত আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এসব ঘটনা ঘটে থাকে। যে এলাকা যার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, সে এলাকার চাঁদাও যাবে সেই সংগঠনের তহবিলে। এতে সংগঠনকে আরও বেশি স্বাচ্ছন্দ্যে চালানো সম্ভব হয়। এজন্য চাঁদার স্পট ঠিক রাখতেই সেসব স্থানে চলে খুনোখুনির ঘটনা। এছাড়া এক সময়ে চার সংগঠনের মধ্যে সন্তু লারমা নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি ও প্রসীত বিকাশ নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে জড়িত থাকলেও এখন তাদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো। ফলে আগের মতো, এতে দুই সংগঠনের মধ্যে খুনোখুনির ঘটনাও তেমন একটা নেই। জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) সঙ্গে ইউপিডিএফের সখ্য থাকলেও এই দুটি সংগঠন বর্তমানে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। আবার জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) সঙ্গে সখ্য রয়েছে নতুন সৃষ্টি হওয়া ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক)। সেই হিসেবে বর্তমানে সন্তু লারমা নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি ও প্রসীত বিকাশ খীসা নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ একদিকে এবং জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) অন্যদিকে অবস্থান করছে। আর হত্যাকান্ড ঘটছেই মূলত এই চার সংগঠনের এলাকা নিয়ন্ত্রণ নিয়েই।
আপনার মতামত জানানঃ