বাংলাদেশের সন্তান হলেও সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা তিনি। এক যুগের বেশি সময় ধরে সিঙ্গাপুরে থাকছেন। তবে বাংলাদেশে রয়েছে তার বিস্তৃত ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড। বিদ্যুৎ, বন্দর, ফাইবার অপটিকস ও আবাসন খাতের ব্যবসা। তাদের সম্পদের পরিমাণ ১২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তিনি বিদ্যুৎ খাতের মাফিয়া, বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে ‘কুইক রেন্টাল’ নামে পরিচিত বহুল বিতর্কিত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী শিল্পগোষ্ঠী সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজিজ খান; যিনি সিঙ্গাপুরের ৪১তম শীর্ষ ধনী। ৫০ বছরের ব্যবসায়ী জীবনে আজিজ খানের সম্পদের উল্লম্ফন ঘটেছে গত এক দশকে।
বিশাল এ শিল্পগ্রুপের মালিকের বিরুদ্ধে কর ফাঁকি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা- সিআইসি। সামিট গ্রুপের আব্দুল আজিজ খানের লেনদেনের তথ্য চেয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চিঠি পাঠিয়েছে সংস্থাটি। পাশাপাশি এসব শিল্প উদ্যোক্তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অর্থাৎ পরিবারের সদস্য এবং কোম্পানির লেনদেনের তথ্যও চাওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে দেখা গেছে, বিগত সরকারের আমলে যেসব খাতে সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে তার মধ্যে বিদ্যুৎ খাত অন্যতম। এর নেতৃত্বে ছিল সামিট গ্রুপ। কোনো ধরনের প্রতিযোগিতা ছাড়া রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়া, বিশেষ আইনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারসহ টেন্ডার ছাড়া জ্বালানি অবকাঠামো খাতে বড় বড় প্রকল্পের অনুমোদন বাগিয়ে নেয় সামিট। তার ভাই মোহাম্মদ ফারুক খান বিগত সরকারের বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী ছিলেন। আর এই সুযোগকে তিনি পুরোপুরি অর্থপাচারের কাজে ব্যবহার করেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, দেশের জ্বালানি আমদানির ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে কমিশন বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন আজিজ খান। অন্যদিকে, দেশের একমাত্র এলএনজি টার্মিনালের মালিক যেহেতু সামিট, তাই গ্যাসের দেশীয় উৎপাদন না বাড়িয়ে এলএনজি আমদানি বাড়ানোর জন্যও এই প্রতিষ্ঠানটির দায় রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিশেষ আইন-২০১০ পাস করা হয়। এতে যেসব সুবিধা রাখা হয় তার পুরোটাই ভোগ করেছে সামিট পাওয়ার। কুইক রেন্টাল চালুসহ বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া যার মধ্যে অন্যতম। এমনকি সে সময় এই সব আইনের বিরোধিতা যারা করেছিল তাদের চাকরিচ্যুত এবং পদাবনতি করা হয়েছে। এক কথায় সামিট পাওয়ারকে সুবিধা দিতেই বিদ্যুৎ আইন সংশোধন করা হয় বলে মন্তব্য করেন সেই সময়ের কয়েকজন কর্মকর্তা।
সিঙ্গাপুরে শীর্ষ ধনীদের তালিকায় ২০১৮ সালেই নাম লিখিয়েছেন সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান। কয়েক বছর ধরেই সে দেশে তার সম্পদের পরিমাণ বাড়ছে। যদিও দেশে অনেকটা উল্টো পথেই হাঁটে সামিট পাওয়ার। কোম্পানিটির মুনাফায় নেমেছে ধস। মুনাফা কমেছে, পাশাপাশি দায়দেনা অনেক বেড়ে গেছে সামিট পাওয়ারের। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলে গেছে কোম্পানিটির ডেট-ইকুইটি অনুপাত।
মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসের গত বছরের প্রকাশিত রিপোর্টে আজিজ খান স্বীকৃতি পেয়েছেন সিঙ্গাপুরের ৪১তম ধনী ব্যক্তির। ফোর্বসের হিসাব অনুযায়ী, মুহাম্মদ আজিজ খানের মোট সম্পদ রয়েছে ১১২ কোটি ডলারের। ফোর্বসের ২০২২ সালের সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনীর তালিকায় তার অবস্থান ছিল ৪২ নম্বরে। সে সময় তার সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয় ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২১ সালে আজিজ খানের সম্পদের পরিমাণ ছিল ৯৯ কোটি ডলারের। পরের বছরই তা ১০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়।
২০১৮ সালে তার সম্পদের পরিমাণ ছিল ৯১ কোটি ডলারের। ২০১৯ সালে এটি কমে ৮৫ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। তবে ২০২০ সালে সম্পদ বেড়ে ৯৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার হয়। দেখা যাচ্ছে, চার বছর ধরেই ফোর্বসের হিসাবে তার সম্পদ বাড়ছে। ২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো আজিজ খান সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন। সে বছর তিনি ছিলেন ৩৪ নম্বরে।
সামিটের অধীন বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতের যত ব্যবসা বা প্রতিষ্ঠান আছে, সেগুলোর হোল্ডিং কোম্পানি সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল। সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত। সে জন্য বাংলাদেশে ব্যবসা করলেও এ কোম্পানির সম্পদের হিসাব করা হয় সিঙ্গাপুরে। ফলে প্রতিষ্ঠানটির আয়ের বড় অংশই দেশের কাজে আসেনি এবং এ বিদেশি নিবন্ধন থাকার কারণে টাকা পাচারের সুযোগও পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ১০ বছরে চাহিদার তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি করে বিগত সরকার। যার মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশই বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্র। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে মোটা অঙ্কের ঋণের ব্যবস্থাও করে সাবেক সরকার। এমনকি বেসরকারি এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি সরবরাহের দায়িত্ব নেয় জ্বালানি বিভাগ। কিন্তু ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ বড় অঙ্কের টাকা দিতে হতো তাদের। শুধু তাই নয়, এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে যে ঋণ নেয়া হয়েছে তার গ্যারান্টার থাকত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এমন সব জনবিরোধী আইন করে সামিটসহ সাবেক সরকারের অধীনস্ত কর্তা-ব্যক্তিদের বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে দেয়া হয় বিশেষ সুবিধা।
সর্বশেষ দেশে প্রকট জ্বালানি সংকটকালেও বিশেষ করে গ্যাস সংকটের মধ্যে গত বছর নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ঘাটে সামিটকে প্রায় ৬০০ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয় সরকার। আশপাশের সব শিল্পকারখানা যখন গ্যাসের অভাবে বন্ধ তখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে সামিটকে এই গ্যাস সরবরাহ করা হয়।
এছাড়া এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহের জন্য কুমিল্লা থেকে মেঘনা ঘাট পর্যন্ত পাইপ লাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। দেখা গেছে, সামিট গ্রুপের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল ক্রেতা প্রধানত সরকার। ফলে সরাসরি ভোক্তা পর্যায়ে কোনো দায় তাদের ছিল না। কেবল সরকারকে খুশি করেই ব্যবসা বাড়াতে সক্ষম হয়েছে তারা।
অন্যদিকে, এসব প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ সুবিধা দিতে গিয়ে দেশের বিদ্যুৎ খাতের একক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বিপিডিবিকে এখন আর্থিক সংকটে সামিটের মতো বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর (আইপিপি) পাওনা পরিশোধ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
মূলত ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সামিট তার ব্যবসা বাড়াতে থাকে বাংলাদেশে। বিশেষ করে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র (আইপিপি) ও এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের ক্ষেত্রে সামিটের প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে বেশি। নানা মাত্রায় দেয়া হয়েছে কর ও শুল্ক সুবিধা। এর ধারাবাহিকতায় গত একযুগেরও বেশি সময় ধরে একক আধিপত্য চলে সামিট গ্রুপের।
প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশি বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মোট স্থাপিত সক্ষমতার প্রায় ২১ শতাংশই সামিটের। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা রয়েছে ২০টি। যার সক্ষমতা প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট। দেখা গেছে, চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র বানানোর অনুমতি দিয়েছে সরকার। ফলে গত ১৫ বছর বেশির ভাগ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
গত বছরের জুলাইয়ে বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিদ্যুৎ বিভাগের উপস্থাপিত তথ্যে উঠে আসে, পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জয়েন্ট ভেঞ্চারটিকে হিসাবে না নিলে দেশে আইপিপিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে সামিট গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত কেবল সামিট গ্রুপকে ৪ হাজার ৪০৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে পরিশোধ করা হয়েছে- যা এ সময়ের মধ্যে পরিশোধিত মোট ক্যাপাসিটি চার্জের প্রায় ১২ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আঞ্চলিক ফাইবার অপটিকস কেবলের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতকে যুক্ত করেছে সামিট গ্রুপের প্রতিষ্ঠান সামিট কমিউনিকেশনস লিমিটেড। এছাড়া বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরের মধ্যে সাবমেরিন কেবল স্থাপনের বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন। কোম্পানিটির সাবসিডিয়ারি সামিট টাওয়ার্স লিমিটেডের মাধ্যমে দেশের টেলিকম খাতের টাওয়ার শেয়ারিং ব্যবসায়ও নাম লিখিয়েছে সামিট গ্রুপ। সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেডের (এসএপিএল) মাধ্যমে বন্দর ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে সামিট গ্রুপ। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি হয়ে উঠেছে দেশের সবচেয়ে বড় অফ-ডক (অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল) ফ্যাসিলিটিগুলোর অন্যতম। ভারতের পাটনায়ও একটি বন্দর উন্নয়নের কাজ পেয়েছে সামিট- যা এখন নির্মাণাধীন।
আবাসন খাতের ব্যবসার সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট রয়েছে সামিট গ্রুপ। ঢাকায় ৩২ লাখ বর্গফুট স্পেস নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে গ্রুপটি। পাঁচ তারকা ও চার তারকা হোটেল নির্মাণের কাজও করেছে তারা। এ ছাড়া বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে হাই-টেক পার্ক স্থাপনের কাজ করেছে সামিট টেকনোপলিস লিমিটেড। ২০১৬ সালে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে এবং অন্যান্য বিনিয়োগকারীকে নিয়ে সিঙ্গাপুরভিত্তিক সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করে।
পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে বিদ্যুৎ প্রকল্প উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জেনারেল ইলেকট্রিক (জিই) চুক্তি করে সামিট। এছাড়া ফিনল্যান্ডভিত্তিক ওয়ার্টসিলার সঙ্গে বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার বাজারে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে সামিট। বর্তমানে জেরা, জিই, মিৎসুবিশি ও তাইয়ো ইন্স্যুরেন্স সামিটের ইক্যুইটি হোল্ডার্স হিসেবে রয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ