বিজেপি-র নেতৃত্বাধীন এনডিএ-র বৈঠকে নরেন্দ্র মোদী নেতা নির্বাচিত হলেন। তিনি এবার রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে সরকার গঠনের দাবি জানাবেন। দুই প্রধান শরিক দলের নেতা নীতীশ কুমার ও চন্দ্রবাবু নাইডুও সেসময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে থাকবেন। ইতিমধ্যেই নাইডু, নীতীশ, পাসোয়ান-সহ সব এনডিএ শরিক সমর্থনের লিখিত চিঠি বিজেপি সভাপতির কাছে জমা দিয়েছেন।
চলতি সপ্তাহেই মোদী তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিতে পারেন। এর আগে জওহরলাল নেহরু পরপর তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। শপথ নেয়ার পর সেই রেকর্ড স্পর্শ করবেন মোদী। এনডিএ বৈঠকে গৃহীত একটি প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ছয় দশক পর দেশের মানুষ আবার পরপর তৃতীয়বারের জন্য একজনকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দিচ্ছেন।
এনডিএ-র কাছে সরকার গঠনের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। ৫৪৩ সদস্যের লোকসভায় সরকার গঠন করতে গেলে ২৭২ জন সাংসদ দরকার। এবার বিজেপি একার ক্ষমতায় সরকার গঠন করতে পারবে না। তারা ২৪০টি আসন পেয়েছে। তাই এবার প্রকৃত অর্থে জোট সরকার গঠন করতে হবে নরেন্দ্র মোদীকে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য তাকে নির্ভর করতে হবে জোটের দলগুলির উপর।
টানা এক দশক পর ভারতে একদলীয় হিন্দুত্ববাদের কর্তৃত্ববাদী শাসনের ইতি হতে চলেছে। বিগত ১৭তম জাতীয় নির্বাচনে কংগ্রেস বিরোধী দল হওয়ার মতো আসন না পাওয়ায় নরেন্দ্র দমোদর মোদি ভারতকে কার্যত হিন্দুত্ববাদী শাসন কায়েম করেন।
মুসলিম-খ্রিষ্টানসহ সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করেন। মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসা বিদ্বেষ এবারের নির্বাচনে মোদি ম্যাজিকে ধস নামিয়েছে।
অন্যদিকে অষ্টাদশ লোকসভায় আনুষ্ঠানিকভাবে ফিরতে চলেছে বিরোধী দলনেতার পদ। তৃতীয় বারের জন্য নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদির হাতেই দেশের ক্ষমতা। শরীকদের সমর্থন নিয়ে তিনিই সরকার গঠন করবেন। তবে ভোটের এ ফলাফল বিজেপির নৈতিক পরাজয়।
ভোটগণনার প্রবণতা বলছে, ২০১৪ এবং ২০১৯-এর মতো এবার আর সংসদের নিম্নকক্ষে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছে না হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল বিজেপি। এবার সরকার গঠনে তাকে শরীক দলগুলোর ওপর নির্ভর করতে হবে। আর ভারতের রাজনীতিতে শরীক দল তথা রাজনৈতিক দল ও নেতাদের ডিগবাজির যে ইতিহাস; তাতে মোদি এবারও সরকার গঠন করলেও নির্বিঘ্নে ক্ষমতায় থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে যে পরিমাণ ভোটের আশা ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দলগুলো করছিল তা অনেকটা পূরণ হয়নি। নির্বাচনের আগেই নরেন্দ্র মোদি ‘৪০০ আসনে’ জয়ী হওয়ার আশা প্রকাশ করেছিলেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই ধাপের ভোটে তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি ক্ষমতাসীন দলটি। দুই ধাপে ভোটারের গড় উপস্থিতি, মুসলিম-বিদ্বেষী বক্তৃতা এবং নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও উঠেছে।
গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এককভাবে ৩০৩ আসনে জয় পেয়েছিল। সেবার বিজেপির নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ ৩৫২ আসনে জয় পায়। তবে ধারণা করা হচ্ছে, এবারের নির্বাচনে বিজেপি জিতলেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। সেক্ষেত্রে এনডিএ জোট শরিকদের ওপর নির্ভর করতে হবে বিজেপিকে।
আমেরিকায় দুই মেয়াদের বেশি কারও প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ নেই। গণতন্ত্রের পীঠস্থান ব্রিটেনে অবশ্য সেরকম কোনও বিধিনিষেধ নেই, তবে সেখানেও দেখা গেছে মার্গারেট থ্যাচার বা টোনি ব্লেয়ারের মতো প্রবাদপ্রতিম নেতানেত্রীরা যখন তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, তাদের জয়ের মার্জিন অনেক কমেছে এবং রাজনৈতিকভাবে তারা অনেক দুর্বল হয়েছেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, তৃতীয় দফার নেতৃত্বের যে ‘গেরো’ – নরেন্দ্র মোদীও তা থেকে অব্যাহতি পেলেন না। অথবা অন্যভাবে বললে, নিজেকে সেই নিয়মের ব্যতিক্রম প্রমাণ করতে ব্যর্থ হলেন।
তবে টানা তৃতীয়বার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি যার রেকর্ড স্পর্শ করবেন, সেই জওহরলাল নেহরুও কিন্তু ১৯৬২তে তার তৃতীয় তথা শেষ নির্বাচনে অনেক কম ব্যবধানে জিতেছিলেন, যদিও তার দল কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে কোনও সমস্যা হয়নি।
সবচেয়ে বড় কথা, গত এক দশক ধরে বিজেপির একার শক্তিতেই বলীয়ান একটি ক্ষমতাবান সরকার চালানোর পর নরেন্দ্র মোদীকে এখন একটি তুলনামূলকভাবে দুর্বল কোয়ালিশন সরকারের নেতৃত্ব দিতে হবে। এতদিন শরিক দলগুলোর ইচ্ছা-অনিচ্ছার পরোয়া না-করলেও এখন সরকারকে টিঁকিয়ে রাখার স্বার্থেই তাকে সঙ্গীদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে।
কিন্তু এরপরও যে প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে, তা হল আত্মবিশ্বাসে টগবগ করতে থাকা একটি ক্ষমতাসীন দল যেখানে চারশো আসনের লক্ষ্যে উদ্দীপিত প্রচার চালাচ্ছিল, সেখানে কীভাবে তারা আড়াইশোরও নিচে আটকে গেল? বিরোধীরা তো অনেকে এটাকে বিজেপির নৈতিক পরাজয় বলেও বর্ণনা করছেন।
ভারতের রাজনৈতিক ভূগোলটা ভাল করে খেয়াল করলেই দেখা যাবে, নির্বাচনি ল্যান্ডস্কেপে উত্তরপ্রদেশই হল গোটা দেশে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য।
দেশে যে কোনও রাজ্যের চেয়ে বেশি – ৮০ টা – সংসদীয় আসন দেয় বলেই সম্ভবত, অতীতেও দেখা গেছে যে দল বা জোট উত্তরপ্রদেশে জিততে ব্যর্থ হয়েছে তাদের দিল্লির ক্ষমতায় আসাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আর এই উত্তরপ্রদেশেই ছিল গত দু’টো নির্বাচনের মতো বিজেপির সব চেয়ে বড় ভরসা – সেখানকার তথাকথিত ‘ডাবল ইঞ্জিন’ মডেলকেও (যার অর্থ কেন্দ্রে মোদীর আর রাজ্যে যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বে একই দলের সরকার) তারা উন্নয়নের সেরা টেমপ্লেট গোটা দেশে হিসেবে তুলে ধরেছিল।
কিন্তু গত দুটো নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশে যথাক্রমে ৭২টি ও ৬৩টি আসন পাওয়ার পর ওই রাজ্যে বিজেপির আসন সংখ্যা এবার ৩৩-এ নেমে এসেছে, যে ফলাফল দলের নেতা-কর্মীরা কেউ আশাই করেননি।
উত্তরপ্রদেশের পরে সবচেয়ে বেশি লোকসভা আসন যে দু’টি রাজ্যে, সেই মহারাষ্ট্র (৪৮) ও পশ্চিমবঙ্গও (৪২) বিজেপিকে দারুণভাবে নিরাশ করেছে। মহারাষ্ট্রে গতবারের তুলনায় তাদের আসন প্রায় অর্ধেকে নেমেছে, আর পশ্চিমবঙ্গে আসন কমেছে এক-তৃতীয়াংশ।
এছাড়া হিন্দি হার্টল্যান্ড বা গোবলয়ের আরও দু’টো রাজ্য, রাজস্থান ও হরিয়ানাতে এবং দক্ষিণ ভারতের কর্নাটকেও বিজেপি প্রচুর আসন হারিয়েছে। সেই জায়গায় ওড়িশা, তেলেঙ্গানা বা অন্ধ্রের মতো নতুন নতুন রাজ্যে বিজেপি ভাল সাফল্য পেলেও তা কিন্তু এই ‘ঘাটতি’টা পুষিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ঠ ছিল না।
বস্তুত এখন দেখা যাচ্ছে, গতবারের তুলনায় শুধু উত্তরপ্রদেশে বিজেপি যে ৩০-টার মতো আসন খুইয়েছে, সেটা ধরে রাখতে পারলেই তারা কিন্তু এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার কাছাকাছি পৌঁছে যেত। উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে বহুকাল ধরেই জাতপাত ও ধর্মীয় বিভাজন প্রাধান্য পেয়ে আসছে।
আপনার মতামত জানানঃ