মেফ্লাই [এক ধরনের পতঙ্গ] মাত্র একদিন বাঁচে। আবার গ্যালাপাগোসের কচ্ছপ ১৭০ বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচতে পারে। অন্যদিকে গ্রিনল্যান্ড হাঙর ৪০০ বছরেরও বেশি সময় বেঁচে থাকার বিশ্ব রেকর্ড করেছে।
‘হোয়াই উই ডাই: দ্য নিউ সায়েন্স অব এজিং অ্যান্ড দ্য কোয়েস্ট ফর ইমমোরালিটি’ শীর্ষক বইয়ের লেখক, রসায়নে নোবেলজয়ী আণবিক জীববিজ্ঞানী ভেঙ্কি রামকৃষ্ণান গত সপ্তাহে তার হার্ভার্ড সায়েন্স বুক টক-এর সূচনা করেছেন।
সেখানে আমাদের প্রকৃতিতে বিদ্যমান বিভিন্ন প্রাণীর বৈচিত্র্যময় জীবনকাল নিয়ে আলোচনা করেছেন এ বিজ্ঞানী। আমরা যতদূর জানি মৃত্যু অমোঘ। তবে এমন কোনো শারীরিক বা রাসায়নিক নিয়ম নেই, যা দেখে বলা সম্ভব নির্দিষ্ট কোন সময়ে কোন প্রাণের মৃত্যু ঘটবে। আর তাই মৃত্যুকে ঘিরে দার্শনিক বিভিন্ন ধারণার উৎপত্তি হয়েছে।
এ বিশাল অনিশ্চয়তা পেছনের ‘কারণ’ উদ্ঘাটন, দীর্ঘায়ু অর্জনের পথ অন্বেষণ এবং বার্ধক্যকে ধীর বা থামানোর প্রচেষ্টা মানুষকে [গবেষণার পেছনে] কোটি কোটি ডলার ব্যয়ে উৎসাহিত করেছে।
আমরা কেন মারা যাই? বার্ধক্য ও অমরত্ব নিয়ে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীর সাক্ষাৎকার
রামকৃষ্ণানের বইটি বার্ধক্য ও মৃত্যুর বর্তমান বৈজ্ঞানিক ধারণার একটি নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ। এমআইটি টেকনোলজি রিভিউ-এর একজন লেখক অ্যান্টোনিও রেগালাদোর সঙ্গে কথোপকথনের সময় রামকৃষ্ণান বলেন, ‘প্রশ্ন হলো আমরা কি বয়স বাড়ার প্রক্রিয়াটিকে আটকে দিতে পারি এবং সে কাজটা কোনো নিরাপদ ও কার্যকর উপায়ে করতে পারি কি না।’
তাত্ত্বিকভাবেভাবে ধরে নেই বিজ্ঞানের মাধ্যমে অমরত্ব লাভ বা খুব দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকা সম্ভব হলো, তাহলেও কি আমাদের সে পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত? রামকৃষ্ণান এ প্রশ্নটিকে অন্যান্য নৈতিক মূল্যবোধের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
রামকৃষ্ণান বলেন, প্রকৃতপক্ষে অমরত্ব হাসিলের চেষ্টায় আমরা বড় সাফল্যের খুব কাছাকাছি রয়েছি। তিনি জানান, এত দ্রুত এ বিষয়টির অগ্রগতি হচ্ছে যে, একটি বইয়ে কেবল এ বিশাল কর্মযজ্ঞের সামান্য অংশই তুলে ধরা যাবে।
এরপর তিনি বার্ধক্যসংক্রান্ত কয়েকটি প্রধান গবেষণার ফলাফলের কথা সংক্ষেপে জানান। তিনি বলেন, এ ধরনের গবেষণার বেশিরভাগই শুরু হয়েছে অপ্রত্যাশিত জায়গায়।
যেমন রাপামাইসিন-এর কথাই ধরুন। ১৯৬০-এর দশকে ইস্টার আইল্যান্ডের একটি ব্যাকটেরিয়া থেকে এ উপাদানটি প্রথম আবিষ্কৃত হয়। এতে অ্যান্টিফাঙ্গাল, ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট এবং অ্যান্টিক্যান্সার উপাদান পাওয়া গেছে।
রাপামাইসিন টিওআর পাথওয়েকে নিয়ন্ত্রণ করে। এটি কোষের ভেতরে আণবিক সংকেত পাঠানোর একটি বৃহৎ পদ্ধতি।
বয়স্কদের শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন এবং রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত সেলুলার সিগন্যালিংকে নিয়ন্ত্রণ করে বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ঠেকানোর সম্ভাবনা থাকায় রাপামাইসিন নতুন করে বিজ্ঞানীদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।
মানুষ যেভাবে নিজেকে দ্বিতীয় জীবন দিয়েছে
আরেকটি উপায় হলো ইঁদুরের মতো ক্যালরি গ্রহণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অ্যান্টি-এজিং প্রভাব মোকাবিলা করা।
এছাড়া আরেকটি পদ্ধতি হলো সেলুলার রিপ্রোগ্রামিং। এর অর্থ, সম্পূর্ণরূপে বিকশিত কোষগুলো অপসারণ করে, দেহের বিকাশ ঘড়িকে কার্যত পিছিয়ে দেওয়া।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে বিখ্যাত মৌলিক পরীক্ষাটি করেছিলেন কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ও নোবেল পুরস্কার বিজয়ী শিনিয়া ইয়ামানাকা।
তিনি দেখিয়েছেন, মাত্র চারটি ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর একটি প্রাপ্তবয়স্ক কোষকে পুরোপুরি প্লুরিপোটেন্ট স্টেম সেলে ফিরিয়ে দিতে পারে। যার মাধ্যমে ইনডিউসড প্লুরিপোটেন্ট স্টেম সেল সৃষ্টি করা যায়।
রামকৃষ্ণান ইংল্যান্ডের এমআরসি ল্যাবরেটরি অব মলিকিউলার বায়োলজির একজন বিজ্ঞানী। ২০০৯ সালে রাইবোসোমের গঠন উন্মোচনের জন্য রসায়নে নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন তিনি।
এ বিজ্ঞানী বলেছেন, বইটি লেখার জন্য তিনি নিজেকে যোগ্য বলে মনে করেছেন, কারণ বার্ধক্য সংক্রান্ত গবেষণা করায় তার ‘কোনো স্বার্থ নেই’।
একজন আণবিক জীববিজ্ঞানী হিসেবে তিনি শুধু কোষগুলো কীভাবে প্রোটিন তৈরি করে তা নিয়ে মৌলিক গবেষণা করেছেন।
বইটির জন্য গবেষণার সময় তিনি সেসব বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকার নেননি, যারা বাণিজ্যিকভাবে বয়স ধরে রাখার বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করছে এমন উদ্যোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কারণ তার সঙ্গে তাদের স্বার্থের সংঘাত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল বলে মনে করেন তিনি।
সাম্প্রতিক দশকগুলোতে সারাবিশ্বে বিপুল পরিমাণ অ্যান্টি-এজিং সংক্রান্ত গবেষণা হয়েছে। সরকারি সংস্থা এবং বেসরকারি কোম্পানিগুলো এর পেছনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে।
২০২৭ সালের মধ্যে ভোক্তা বাজারে অ্যান্টি-এজিং পণ্যগুলোর বিক্রি ৯৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
রামকৃষ্ণান বলছেন, দীর্ঘায়ু লাভের প্রতিশ্রুতি দেওয়া কোম্পানিগুলোর মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত দাবি দিন দিন বাড়ছে। তিনি একটি উদাহরণ দিয়েছেন: অ্যামাজনে এক ধরনের সাপ্লিমেন্ট পাওয়া যাচ্ছে; এর বিক্রেতারা দাবি করছেন এগুলো মানুষের টেলোমিয়ার বা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পাওয়া জেনেটিক সেগমেন্টগুলোকে দীর্ঘায়িত করতে সাহায্য করবে।
তিনি বলেন, ‘অবশ্যই এগুলো এফডিএ [মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন] অনুমোদিত নয়। কোনো ক্লিনিকাল ট্রায়াল হয়নি এবং তাদের এসব দাবির ভিত্তি কী তা-ও স্পষ্ট নয়।’ কিন্তু তারপরও কিছু মানুষ এগুলো কিনছেন।
আপনার মতামত জানানঃ