উত্তর গোলার্ধের বেশির ভাগ দেশে চরম ঠান্ডা আবহাওয়ায় তাপের জন্য গ্যাসের চাহিদা বেড়ে গেছে। এতে এশিয়ান এলএনজির চাহিদা মৌসুমের প্রত্যাশিত চাহিদাকে ছাড়িয়ে গেছে। ফলে এশিয়ান এলএনজির দাম এখন ঊর্ধ্বমুখী। বিশ্বের বৃহত্তম তিনটি এলএনজি রপ্তানিকারক দেশ মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরবরাহের বিঘ্ন এবং উচ্চ পরিবহন খরচ গ্যাসের দামকে আরো প্রভাবিত করছে। দাম নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠান এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল প্যাটস জানিয়েছে, আগামী ফেব্রুয়ারিতে উত্তর-পূর্ব এশিয়ায় প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট (এমবিটিইউ) এলএনজি সরবরাহের গড় মূল্য ধরা হয়েছে ২১ দশমিক ৪৫ মার্কিন ডলার, যা আগের সপ্তাহের তুলনায় ৪৭ শতাংশ বেশি। এ ঊর্ধ্বগতি সামনের দিনগুলোয়ও অব্যাহত থাকবে বলে পূর্বাভাস বাজার পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠানগুলোর। অথচ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে এতদিন এলএনজিকেই সবচেয়ে সাশ্রয়ী ধরে নিয়ে নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। এমতাবস্থায় সমূহ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
সাম্প্রতিক স্পট এলএনজির মূল্যে অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান তাদের দরপত্র বাতিল করেছে। উদীয়মান বাজারগুলো মূলত মূল্য সংবেদনশীল। আসন্ন গ্যাসের অস্থির বাজার তাদের আরো চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তা দেখা গেছে। এলএনজির দাম বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ব্যয়বহুল ও অনিশ্চিত করে তুলবে। ফলে এলএনজিচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে পারে এবং গ্রাহকদের ওপর গ্যাস ও বিদ্যুতের দামের বোঝা আরো বেড়ে যেতে পারে।
জ্বালানি হিসেবে এলএনজি ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের মেগা প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এলএনজিকে মাথায় রেখে মহেশখালী-আনোয়ারা গ্যাস সঞ্চালন সমান্তরাল পাইপলাইন নির্মাণ, আনোয়ারা-ফৌজদারহাট গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ ও চট্টগ্রাম-ফেনী-বাখরাবাদ গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্পও রয়েছে তালিকায়। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ৭ হাজার কোটি টাকার বেশি।
এদিকে, বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনায় ২০৪১ সাল নাগাদ ৬০ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ সক্ষমতার ৩৫ শতাংশই আসার কথা গ্যাস ও এলএনজিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। পাশাপাশি কয়লাভিত্তিক বেশকিছু প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে এলএনজির কথা ভাবা হচ্ছে। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির মূল্যে অস্থিরতা এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিছুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম কয়েক মাস ধরে ওঠানামা করছে। দাম বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা এলএনজি সরবরাহে ভারসাম্যতা রেখেছি। ডিসেম্বরে এলএনজি সরবরাহ কম থাকায় আমরা দেশীয় উৎস থেকে উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়েছি।
তিনি বলেন, এলএনজি সরবরাহ কমালেও গ্যাসভিত্তিক শিল্পে সরবরাহ কমানো হয়নি। বিশেষ করে সার কারখানাগুলোয় সরবরাহ আগের মতোই অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র যেগুলো ডুয়েল ফুয়েলচালিত সেগুলো গ্যাসের পরিবর্তে তেলে চালানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সব স্থাপনায় গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত রাখতে আমরা ভারসাম্য বজায় রাখছি।
প্রাকৃতিক গ্যাসের সংকট বিবেচনায় ২০১৮ সালের ২৫ এপ্রিল থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করে সরকার। সামিট এলএনজি ও যুক্তরাষ্ট্রের এক্সেলারেট এনার্জির স্থাপন করা ভাসমান টার্মিনালের (এফএসআরইউ) মাধ্যমে আমদানীকৃত এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রতিটি এফএসআরইউর সক্ষমতা দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট। আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে প্রতিদিন ৪০০ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
দেশে এলএনজির সরবরাহ তদারককারী প্রতিষ্ঠান আরপিজিসিএল সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে এলএনজি সরবাহের ৭০ শতাংশ সঞ্চালন লাইনে দেয়া হচ্ছে। চাহিদার বাকিটুকু পূরণ করা হচ্ছে গ্যাসের উৎপাদন বাড়িয়ে।
রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, নভেম্বর থেকেই জাতীয় সঞ্চালন লাইনে এলএনজি সরবরাহ কম রাখা হয়েছে। স্পট মার্কেটে দাম বেড়ে যাওয়ায় এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে আগামী মার্চ নাগাদ এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তান ও ভিয়েতনামের মতো উদীয়মান বাজারগুলোতে এলএনজির অসাশ্রয়ী দামের কারণে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের প্রস্তাবিত গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে। এলএনজির অস্থির স্পট বাজারের সঙ্গে যদি চুক্তিভিত্তিক গ্যাসের মূল্য বেড়ে যায়, তবে অনেক বিদ্যুৎ প্রকল্পই আলোর মুখ দেখবে না। এ অনিশ্চয়তা বিদ্যুৎ গ্রাহকদের মধ্যে সঞ্চারিত হবে। ফলে গ্রাহকরা বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির মুখোমুখি হবেন। এশিয়ার দেশগুলোর উচিত এলএনজির চেয়ে সস্তা এবং আরো স্থিতিশীল নবায়নয়োগ্য শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে নজর দেয়া।
ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ) এর বিশ্লেষক ব্রুস রবার্টসনের মতে, সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধি ভবিষ্যতে অস্থিতিশীল গ্যাসের দামের পূর্বাভাস হতে পারে। নতুন গ্যাসের কূপ খনন কম হওয়া, তেল ও গ্যাসশিল্পে আর্থিক অস্থিতিশীলতা এবং শিল্প বিনিয়োগের নিম্ন হারের কারণে উচ্চ মূল্য এবং আরো অস্থিতিশীল বাজারের নতুন যুগে প্রবেশ করবে।
রবার্টসন পূর্বাভাস দিয়েছেন, মার্কিন গ্যাসের বাজারে অস্থিরতার মানে হতে পারে, আসন্ন বছরগুলোতে এশিয়ান এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকা। এশিয়ার দেশগুলোর উচিত এলএনজির চেয়ে সস্তা, আরও স্থিতিশীল নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে নজর দেওয়া।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৩১
আপনার মতামত জানানঃ