সাগরের বুকে এই যে বিশাল তিমিদের দল, মারা গেলে তাদের কী পরিণতি হয়? যারা ভাবছেন, এ তো খুব সহজ ব্যাপার—যেকোনো প্রাণীই মরে গেলে পঁচে যায়; তাঁদের বলি। এত বিশাল সব তিমি পঁচে যাওয়া কি আসলে সহজ কথা? ভুলে গেলে চলবে না, সাগরের পানিতে সোডিয়াম ক্লোরাইড থাকে। কোনো কিছুর পঁচন রোধে এ রাসায়নিক বেশ সিদ্ধহস্ত! কী, দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন?
এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের দুশ্চিন্তাও নিতান্ত কম ছিল না। যেকোনো প্রশ্নের জবাব না পেলে তাঁরা ‘টেনশন’-এ পড়ে যান। তবে সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজায় মূল উপায় একটাই—বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। আর সে জন্য প্রথমেই আসে পর্যবেক্ষণ।
তাহলে বাকি হাড়ের কী হয়? অনেক পর্যবেক্ষণের পর বোঝা গেল, এগুলো সাবাড় করে ‘জম্বি পোকা’রা!
বিজ্ঞানীরা তাই তিমিরা সমুদ্রে যে পথ ধরে চলাফেরা করে, সেদিকে দীর্ঘদিন খেয়াল রেখেছেন। পর্যবেক্ষণ করেছেন। অবশেষে এমন কিছু ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পেয়েছেন, যেগুলো ‘কেমোট্রাফ’ (Chemotroph) পদ্ধতিতে তিমির হাড় থেকে শক্তি সংগ্রহ করে। জারণ প্রক্রিয়ায় জৈব বা অজৈব কোনো কিছু থেকে শক্তি সংগ্রহ করার পদ্ধতিকে বলা হয় কেমোট্রোফ।
যে ব্যাকটেরিয়ারা এ পদ্ধতিতে শক্তি সংগ্রহ করে, দেখা গেল, তারা শুধু তিমির হাড়ের ওপরের দিকের সালফাইড সমৃদ্ধ আবরণের ব্যাপারেই আগ্রহী। তাহলে বাকি হাড়ের কী হয়? অনেক পর্যবেক্ষণের পর বোঝা গেল, এগুলো সাবাড় করে ‘জম্বি পোকা’রা!
ওসেডাক্স (Osedax) নামে একধরনের সমুদ্রপোকা আছে, যাদের বিখ্যাত ডাকনাম এই ‘জম্বি পোকা’। খাঁটি বৈজ্ঞানিকরা অবশ্য একটু আপত্তি করবেন এই নাম নিয়ে। কারণ, ওসেডাক্স আসলে এসব পোকার ‘গণ’-এর নাম। মানুষের গণ যেমন হোমো (Homo), তেমনি এদের গণের নাম ওসেডাক্স। এই গণের অধীনে অনেকগুলো প্রজাতি আছে। যেমন ওসেডাক্স রোসিয়াস (Osedax roseus)। তবে এই গণের সবগুলোই একনামে খ্যাত। সেই নামটিই ‘জম্বি পোকা’।
প্রশ্ন আসে, এরা কি আস্ত তিমিদেরকেই জম্বি বানিয়ে ফেলে? সায়েন্স ফিকশন মুভির গল্প হিসেবে চমৎকার হলেও বাস্তবে ব্যাপারটা আমাদের জন্য খুব সুখকর হতো না কিন্তু! জাহাজে চেপে সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার কথা একেবারে ভুলে যেতে হতো।
না, এরা আসলে তিমিদের জম্বি বানিয়ে ফেলে না। খাদ্য হিসেবে তিমির হাড়ের জন্য বুভুক্ষু হয়ে থাকে বলেই এমন নামকরণ। আসলে লাতিন Osedax শব্দের মানেই হাড়খেকো। তবে নাম শুনে যত জঘন্যই লাগুক, সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের জন্য এরা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
কোনো তিমি মারা গেলে মৃতদেহ যখন সমুদ্রের তলদেশে আছড়ে পড়ে, তখন এই বুভুক্ষু সমুদ্রপোকারা ছুটে আসে। এদের দেহে মূলের মতো একটি অংশ আছে, যেটা ব্যবহার করে এরা তিমির হাড়ের ওপর এসে স্থির হয়, তারপর পানিতে পাখার মতো ফুলকা ছড়িয়ে দিয়ে বসে যায়। দেখে মনে হবে চমৎকার কোনো ফুল ফুটেছে! এই সমুদ্রকীটদের কোনো মুখ বা পাকস্থলী নেই। আছে বিপুল পরিমাণে মিথোজীবী ব্যাকটেরিয়া। এই ব্যাকটেরিয়ারা নিরাপদ আবাসের জন্য ওসেডাক্স, অর্থাৎ জম্বি পোকাদের ওপর নির্ভরশীল।
কাজেই, ওসেডাক্স এদেরকে তিমির দেহে ছড়িয়ে দেয় এবং একধরনের অ্যাসিড ক্ষরণ করে। এই ব্যাকটেরিয়ারা অ্যাসিডের সাহায্যে ধীরে ধীরে ভেঙে গুঁড়ো করে ফেলে তিমির হাড়। ওসেডাক্স এই গুঁড়ো থেকে লিপিড শুষে নেয়।
মিথোজীবীতার দারুণ উদাহরণ এই ওসেডাক্সরা। মিথোজীবীতা এদের দেহে বিবর্তন ঘটিয়েছে, পরিবর্তন এনেছে, যাতে তারা আরও ভালোভাবে ব্যাকটেরিয়াদের সঙ্গে মিলে থাকতে পারে।
মন্টেরি বে অ্যাকুরিয়াম রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (MBARI) মেরিন বায়োলজিস্ট শানা গোফ্রেডি এদের নিয়ে বলেছেন, ‘মিথোজীবীতার দারুণ উদাহরণ এই ওসেডাক্সরা। মিথোজীবীতা এদের দেহে বিবর্তন ঘটিয়েছে, পরিবর্তন এনেছে, যাতে তারা আরও ভালোভাবে ব্যাকটেরিয়াদের সঙ্গে মিলে থাকতে পারে।’
শুরুর দিকে বিচিত্র দৈহিক গঠনের জন্য এদের প্রজাতি নির্ণয় করতে পারছিলেন না বিজ্ঞানীরা। পরে ডিএনএ বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, বিশালদেহী টিউবওয়ার্মদের দূর-আত্মীয় এসব ওসেডাক্স। প্রায় ৪২ মিলিয়ন বা ৪ কোটি ২০ লাখ বছর আগে এদের আবির্ভাব হয়েছে।
মজার কথা হচ্ছে, বেশ কিছু সামুদ্রিক তিমির প্রজাতির আবির্ভাবও হয়েছে সে সময়ই। এ তথ্য থেকে বোঝা যায়, এদের কথা আমরা সম্প্রতি জানতে পারলেও এরা কিন্তু আসলে নতুন কিছু নয়। অনেক আগে থেকেই তারা নিজেদের কাজ ঠিকঠাকভাবে করে যাচ্ছে। সে জন্যই টিকে রয়েছে সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থান।
এভাবেই ওসেডাক্স জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায়, মিথোজীবি ব্যাকটেরিয়ারা পায় নিরাপদ আবাস। আর বিশাল তিমির মৃতদেহ সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানে কোনো রকম সমস্যার সৃষ্টি না করেই বিলীন হয়ে যায় কালের গর্ভে।
আপনার মতামত জানানঃ