আরসালানতেপে অবস্থিত পূর্ব আনাতোলিয়ায়। ইউফ্রেটিস নদী থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে। আশির দশকে সেখানকার রাজকীয় সমাধি থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক মারচেল্লা ফ্রাঞ্জিপানে আবিষ্কার করেন নয়টি তরবারি।
তামার নির্মিত সে তরবারিগুলো খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০ অব্দের। তরবারির কাঠামো, ধাতুর ব্যবহার ও দেখে সহজেই অনুমান করা যায় সামরিক দিক থেকে তাদের অগ্রগতি। তার সঙ্গে সামনে আসে খোদ তরবারির ইতিহাস।
মানবজাতি ঠিক কখন তরবারি ব্যবহার শুরু করেছে, তা হলফ করে বলা মুশকিল। তবে সভ্যতার ইতিহাসে যখন সংঘাতের শুরু, তখনই নানাভাবে ব্যবহার শুরু হয়েছে অস্ত্রের। কখনো আত্মরক্ষার প্রয়োজনে, কখনো আক্রমণ করতে গিয়ে।
যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আকৃতিতে বদল ঘটেছে সেসব অস্ত্রের। প্রস্তর যুগে পাথর নির্মিত ছুরি পাওয়া যায়। নব্যপ্রস্তর যুগে অস্ত্র পাথর নির্মিত হলেও তা ছিল সরু ও চৌকস। পাথরের পাশাপাশি আদিমানবরা পশুর হাড় দিয়েও বিশেষ ধরনের লম্বা ছুরি তৈরি করত।
আজকের তরবারির পূর্বপুরুষ হিসেবে তাকে চিহ্নিত করা যায়। তাছাড়া কাঠ দিয়ে তৈরি তরবারিসদৃশ আকারে ছোট অস্ত্র ব্যবহারের সাক্ষ্য মেলে প্রাচীন মিসরে। পরবর্তী সময়ে ধাতুর ব্যবহার রপ্ত করে মানুষ আগের পাথর, হাড় কিংবা কাঠের তৈরি চাকুকে আরো লম্বা ও টেকসই করতে সক্ষম হয়েছে।
ব্রোঞ্জকে একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় নিয়ে গলিয়ে ইচ্ছামতো আকৃতি দেয়া হয়েছে, ক্রমে শীতলীকরণে রূপ দেয়া হয়েছে তরবারির। কিন্তু সংকট হচ্ছে ব্রোঞ্জের তরবারি দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। সে সংকট দূর হয় লৌহ যুগে। লোহার ব্যবহার রপ্ত করার মাধ্যমে রীতিমতো বিপ্লব এসেছে তরবারির উৎপাদন ও ব্যবহারে।
সভ্যতার সূতিকাগার মধ্যপ্রাচ্য। আসিরীয় সভ্যতার আমলে যুদ্ধবিদ্যায় ব্যবহার করা হতো তরবারি। আসিরীয় সম্রাট প্রথম আদাদ-নিরারির আমলে খোদাই করা তরবারি বর্তমানে সংরক্ষিত আছে মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্টে। মেসোপটেমিয়া ও মিসরীয় সভ্যতায় যুদ্ধের প্রধান উপকরণ ছিল বর্শা ও ধনুক।
উৎপাদন খরচের কারণে ধাতব তরবারির ব্যবহার ছিল সীমিত। খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের দিকে যুদ্ধ ও সংঘাতের সূত্র ধরে জনপ্রিয়তা পেতে থাকে তরবারি। মিসরীয়রা লোহার তৈরি তরবারির উত্তরাধিকার সম্ভবত পায় ফিনিশীয়দের কাছে। তাদের তরবারি ছিল আকারে ছোট। তৈরি করা হতো তামা ও ব্রোঞ্জ দিয়ে। এছাড়া ব্যবহার হতো খোপেশ। প্রাচীন মিসরীয় অস্ত্রভাণ্ডারের অনন্য উদাহরণ এ খোপেশ। শত্রুর ঢাল ভেদ করে যেন আঘাত করা যায়, তার জন্য মাঝখানে বাঁকানো থাকত প্রাচীন এ তরবারির।
ব্রোঞ্জ ও লৌহ যুগে ইউরোপজুড়ে বেশ কয়েকটি যোদ্ধা জাতি বসবাস করত। জার্মানির মধ্য অঞ্চল থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের দিকে পশ্চিম এশিয়ায় বসতি স্থাপন করে কেল্টরা। সম্ভবত ইউরোপের প্রথম লোহার তরবারি তৈরি হয় তাদের হাত দিয়েই। তবে এ তরবারি যুদ্ধের সময় দ্রুত বেঁকে যেত। তাই যোদ্ধাদের মাঝে মাঝে পায়ের নিচে ফেলে তরবারি সোজা করে নিতে হতো। প্রাচীন গ্রিসে সবচেয়ে পরিচিত তরবারি ছিল জিফোস।
যদিও কোপিস নামের তরবারিও ব্যবহার করা হতো। গ্রিসের পদাতিক বাহিনী ব্যবহার করত এ তরবারি। পরে এটি রোমান অস্ত্র ধারণায়ও প্রভাব ফেলে। আকারে ছোট হওয়ায় প্রতিপক্ষের ঢাল ভাঙার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে কুঠার। গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস দাবি করেছেন, তার সময়ের সিদিয়ানরা লোহার তৈরি তরবারি ব্যবহার করত। ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হাইডাস্পেসের যুদ্ধে আলেকজান্ডার পুরুকে পরাজিত করার সময় দুই পক্ষেই লোহার তৈরি তরবারি ছিল।
ঐতিহাসিক ফিলো তার বই বেলোপয়েসিয়ায় (আর্টিলারি) প্রশংসা করেছেন কেল্ট ও আইবেরীয় অঞ্চলের তরবারির। গ্রিকদের পরাজিত করে রোমানরা যখন আধিপত্য বিস্তার করে, তখন গ্রিকদের তরবারি প্রথম আঘাতে বেঁকে যেত। পরেরবার নতুন করে সোজা করে নিতে হতো। রোমানরা এ দুর্বলতার সুযোগ পুরোপুরি উসুল করে নেয়। আসলে রোমানরা ছিল সমকালের সবচেয়ে চৌকস সামরিক শক্তির অধিকারী।
তাদের পদাতিক সৈন্যের জন্য থাকত ছোট তরবারি, যার নাম গ্লাডিয়াস। তবে অশ্বারোহীদের জন্য তরবারি একটু লম্বা হওয়ার প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করত স্পাথা। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যে স্পাথার ব্যবহার বিস্তৃত হয় গ্লাডিয়াসের বদলে। স্পাথা আকারে গ্লাডিয়াসের তুলনায় লম্বা ও সোজা। বহুল প্রচলিত গ্লাডিয়েটর প্রতিযোগিতার মধ্যেও ব্যবহার করা হতো স্পাথা। রোমানদের থেকে পরবর্তীতে পার্শ্ববর্তী জাতিগুলো প্রভাবিত হয়; তাদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ সম্ভবত ক্যারোলিন যুগের তরবারি ও ভাইকিং তরবারি।
মধ্যযুগে পৃথিবীজুড়েই তরবারির আকৃতিতে বিবর্তন এসেছে। ধাতববিদ্যা উন্নত হওয়ার পাশাপাশি উন্নত হয়েছে তরবারির কাঠামো। নকশায়ও এসেছে আভিজাত্য। প্রজেন্মর পর প্রজন্ম ধরে তরবারি ব্যবহার হয়েছে সম্মানের প্রতীক রূপে। ১০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দাপটের সঙ্গে ইউরোপে টিকে ছিল রোমান স্পাথা; পরে সেটাই বিবর্তন হয়ে তৈরি হয় ভাইকিং সোর্ড।
ভাইকিং সোর্ড আবার বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। ঢালের কাঠামোর পরিবর্তন ব্যাপকভাবে তরবারির কাঠামোকে পরিবর্তন করেছে বিভিন্ন সময়। প্রতিপক্ষের কোন ধরনের ঢালে কীভাবে আঘাত করা সুবিধাজনক, সেদিক বিবেচনা করে তরবারির দৈর্ঘ্য ও বাঁক নির্ধারিত হতো। ঢাল ক্রমে দুর্ভেদ্য হয়ে ওঠার কারণেই ভারী ও একধারী তরবারি ফ্যালকিয়নস জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে চতুর্দশ শতাব্দীর দিকে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে দীর্ঘ তরবারি বা লং সোর্ড ও বাস্টার্ড সোর্ডস।
সাধারণত এক হাতে ব্যবহার করা হতো বাস্টার্ড তরবারি। তবে হাতলটা একটু লম্বা হওয়ায় প্রয়োজনে দুই হাত বসানো যেত। যেহেতু হাতল এক ব্যবহারের শ্রেণীভুক্তও না কিংবা দুই হাতে ব্যবহারের শ্রেণীভুক্তও না; তাই এ রকম নামকরণ। ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত এ তরবারি বেশ আধিপত্য করেছে ইউরোপে।
মুসলিম বিশ্বে তরবারি প্রায়ই একধারী হতো, আর ব্লেড হতো বাঁকানো। আরব উপদ্বীপ, মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় এ ধরনের তরবারি দেখা যেত সবচেয়ে বেশি। পরবর্তী সময়ে ইউরোপে এ ধরনের তরবারি স্কিমিটার্স নামে পরিচিতি অর্জন করে। মুসলিম সামরিক বাহিনীতে অশ্বারোহী বাহিনীর জন্য উপযোগী ছিল তরবারি।
তরবারির গায়ে খোদাই করে লেখা হতো কোরআনের আয়াত কিংবা রাসুলের কোনো বক্তব্য। অঞ্চলভেদে আবার আকৃতি ও নামকরণেও পার্থক্য থাকত। মুসলিম যুগের তরবারির মধ্যে রয়েছে অ্যারাবিয়ান সাইফ, উসমানি কিলিস ও পারসিক শমশের। দূরপ্রাচ্যেও একধারী তরবারির দেখা পাওয়া যায়। জাপানে সামুরাই আমলে ব্যবহার করা হতো একধারী তরবারি। আকারে কিছুটা ছোট তরবারি জাপানে পরিচিত ছিল ওয়াকিজাশি নামে।
চীনে দুই ধরনের তরবারির উত্থান ঘটে ধ্রুপদি আমলে। প্রথমটি জিয়ান ও দ্বিতীয়টি তাও। জিয়ান ছিল লম্বা ও দ্বিধারী তরবারি। অন্যদিকে তাও ছিল বাঁকানো ও একধারী তরবারি। চীনা অশ্বারোহীতে সাধারণত তাও ব্যবহার হতো।
পঞ্চদশ শতাব্দীর দিকেই তরবারি তার সর্বোচ্চ সৌকর্যে পৌঁছায়। যদিও সে সময় গোলাবারুদের মতো বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়। অশ্বারোহী বাহিনীতে তখনো তরবারির আধিপত্য কমেনি। তবে তরবারির রকমফের ঘটেছে বাহিনী অনুপাতে। ইউরোপে ও বিশেষ করে জার্মানিতে ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে দুই হাতলের তরবারি; পরিচিতি লাভ করে জোয়েইহান্ডার নামে।
কয়েক শতক পরেও ইউরোপের রাজাদের অভিষেক অনুষ্ঠানে এমন তরবারির ব্যবহার দেখা যায়। ষোড়শ শতাব্দীর দিকে পদাতিক বাহিনী ব্যবহার করত প্রশস্ত তরবারি। অশ্বারোহী বাহিনী সাধারণত নিচের দিকে আঘাত করত। সেদিকে সক্ষমতা তৈরি করতেই বিবর্তিত হয়েছে তরবারি। সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে ব্লেডের তরবারি ব্যবহার করে অশ্বারোহীরাও।
তবে ডুয়াল কিংবা বেসামরিক যুদ্ধের ক্ষেত্রে বেশি ব্যবহার হয়েছে র্যাপিয়ার সোর্ড। স্পেন ও ইতালিতে এ ধরনের তরবারি প্রসার লাভ করে। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ছোট তরবারিও জনপ্রিয়তা পায় ডুয়েলের জন্য। তরবারি প্রসঙ্গে ভারতকে না রাখাটা অনুচিত হবে। ভারতে মুসলিম শাসনের আগে থেকেই তরবারির প্রচলন ঘটেছিল। সুলতানি আমলে তরবারির ব্যবহার বিস্তৃত হয়। ভারতবর্ষে তরবারি পরিচিত তলোয়ার নামে। মোগল আমলে তরবারি শিল্প অনন্য উচ্চতায় আরোহণ করে। আবুল ফজলের আইন-ই আকবরীতে তরবারি প্রস্তুতির কথা বলা হয়েছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তলোয়ারের মধ্যে আবার আঞ্চলিক প্রভাবও রয়েছে। মালয়েশিয়ান ক্রিস ও শ্রীলংকান কাস্তান তার মধ্যে অন্যতম। জাপানে এখনো সামুরাই তরবারি উৎপাদন হয়।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে তরবারি প্রভাব হারাতে থাকে। তার জায়গা দখল করতে থাকে বন্দুক ও কামানের মতো অস্ত্র। তার পরও কিছুটা প্রভাব রেখেছিল তরবারি। ফরাসি বিপ্লবের সময় (১৭৮৭-৯৯ খ্রিস্টাব্দ) কিংবা নেপোলিয়নের যুদ্ধগুলোয় (১৮০১-১৫ খ্রিস্টাব্দ) ব্যবহার করা হয় তরবারি। ব্রিটিশ জেনারেল জন লি মার্চেন্ট অশ্বারোহী বাহিনীর উপযোগী হালকা তরবারির অগ্রগতি সাধন করেন।
নেপোলিয়নের যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ বাহিনী রাইফেলের ডগায় বেয়নেট ব্যবহার করত। বেয়নেট কখনো আলাদাভাবে আবার কখনো রাইফেলের সামনে রেখে ব্যবহার হতো। সময়ের ব্যবধানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তরবারির ব্যবহার সংকুচিত হতে থাকে। তার পরও ১৮৬১-৬৫ সালে আমেরিকার গৃহযুদ্ধে তরবারি ব্যবহার হয়েছে। সে তরবারিতে ফরাসি প্রভাব বিদ্যমান। যুক্তরাষ্ট্রের তরবারিতে ফরাসি ও ব্রিটিশ প্রভাব ছিল।
যদিও নর্দার্ন ইউনিয়ন ও কনফেডারেট সাউথের মধ্যকার সংঘাতে ব্যবহার হয়েছে কামান ও বন্দুক। স্বাভাবিকভাবেই বন্দুকের সামনে তরবারি অপ্রাসঙ্গিক। কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, এ চিত্র দেখা যায় পৃথিবীর অন্যান্য অংশেও। ঊনবিংশ শতাব্দীতে চীনেও তরবারি পরিণত হয় কেবল উৎসবের অনুষঙ্গ হিসেবে। জাপানের মেইজি (১৮৬৮-১৯১২) আমলেই সেনাবাহিনীকে আধুনিকায়নের জন্য পদক্ষেপ নেয়া হয়। প্রথম দিকে তরবারির উন্নতিসাধন ও পরবর্তী সময়ে সে স্থান দখল করে বন্দুক।
ইউরোপ বা এশিয়ার তুলনায় আফ্রিকার তরবারি আরো বেশি বহুমাত্রিক। তবে ঔপনিবেশিক শক্তির সম্প্রসারণে তা ভেঙে পড়ে। বিশ শতকের প্রথম দিকেই যুদ্ধের উপকরণ হিসেবে তরবারি অপ্রচলিত হয়ে পড়ে। আজকের যোদ্ধারা যুদ্ধে থাকে বন্দুক, বোমা, মিসাইল, কামান ও ড্রোন নিয়ে। তার পরও তরবারি এখনো অনুষ্ঠানে ব্যবহার হয়। শতসহস্র সাম্রাজ্যের ভাগ্য বদলের সাক্ষী তরবারি এখন টিকে আছে কেবল সংস্কৃতি হিসেবে।
আপনার মতামত জানানঃ