সম্প্রতি প্রশান্ত মহাসাগরীয় শিলার বিভিন্ন নমুনা থেকে ইঙ্গিত মিলেছে, আড়াইশ কোটি বছর আগেও সক্রিয় ছিল পৃথিবী।
আগ্নেয়গিরির শিলায় আটকে থাকা বিভিন্ন ‘নোবল গ্যাস’ পরীক্ষা করে পৃথিবীর আদি এই রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট লুইস শহরে অবস্থিত ‘ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি’র সহকারী অধ্যাপক রিটা পারাই ও তার স্নাতক ছাত্র জুডি ঝাং।
তাদের এ গবেষণা সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে ‘আর্থ অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্স লেটার্স’ জার্নালে, যেখানে পৃথিবীর অতীতে ‘গভীর ডুব’ দিয়ে তথ্য মিলেছে, পৃথিবীর বিভিন্ন টেকটনিক প্লেট আদতে ভূপৃষ্ঠ থেকে রিসাইকল করা গ্যাস, যেগুলোর অস্তিত্ব ছিল আড়াইশ কোটি বছর আগেও।
উল্লেখ্য, পর্যায় সারণীর গ্রুপ ১৮’র ছয়টি উপাদান হিলিয়াম, নিয়ন, আর্গন, ক্রিপ্টন, জেনন ও রেডনকে ‘নোবল গ্যাস’ বলা হয়ে থাকে, কারণ এগুলো অন্য কোনো মৌলের সঙ্গে বিক্রিয়া করে না।
প্রায় সাড়ে চারশ কোটি বছর আগে পৃথিবীর গঠনপ্রক্রিয়ার ‘টাইম ক্যাপসুল’ হিসাবে কাজ করে বিভিন্ন নোবল গ্যাস, যার ইঙ্গিত মেলে এদের রাসায়নিক নিষ্ক্রিয়তা থেকে। পাথরে এদের উপস্থিতি ও নির্দিষ্ট আইসোটপিক নিদর্শন পৃথিবীর বিবর্তনীয় ইতিহাস সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য দেয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বিজ্ঞানভিত্তিক সাইট নোরিজ।
এদিকে, দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের কুক ও অস্ট্রাল দ্বীপপুঞ্জের আগ্নেয়গিরিতে থাকা বিভিন্ন শিলায় জেনন গ্যাসের খোঁজ পেয়েছে গবেষণা দলটি, যেটি ‘নোবল গ্যাস’ হিসাবে বিরল।
এমন শিলা পৃথিবীর আবরণের অনেক গভীরে গঠিত হয়, যা ভূপৃষ্ঠে উঠে আসে অগ্নুৎপাত থেকে। তাই এগুলোর সঙ্গে পৃথিবীর প্রাচীন ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া নিয়েও নানা গল্প রয়েছে।
‘সাবডাকশন’ এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে টেকটোনিক প্লেট ভূপৃষ্ঠ থেকে পৃথিবীর ‘ম্যান্টেল’ অংশে নেমে যায়। এ গবেষণার বিভিন্ন অনুসন্ধান আগের বিভিন্ন তত্ত্বকেও চ্যালেঞ্জ করেছে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, প্রচলিত ধারণা ছিল, আদিকালের পৃথিবীর তাপমাত্রা এখনকার তুলনায় অনেক বেশি ছিল।
এর থেকে ইঙ্গিত মেলে, সাবডাকশন এমন এক পরিস্থিতিতে ঘটেছে, যার সঙ্গে বর্তমান পৃথিবীর কোনও মিল নেই।
এ গবেষণার উপসংহার হল, জেননের বিভিন্ন উপাদান আটকে রয়েছে পাথরে, যেগুলো উচ্চ তাপমাত্রায় গ্যাস থেকে আলাদা হয়ে যায়।
বিরল গ্যাস হওয়ায় পাথর থেকে জেনন শনাক্ত করা খুবই সূক্ষ্ম কাজ। রিটা এই জেনন খুঁজে পাওয়ার বিষয়টিকে তুলনা করেছেন কোনও বিস্তীর্ণ খড়ের মাঠে মাইক্রোস্কোপিক সুই শনাক্ত করার সঙ্গে, যেখানে প্রতি গ্রাম উপাদান তৈরিতে প্রয়োজন পড়ে প্রায় এক লাখ জেনন পরমাণুর।
বিভিন্ন এমন অধরা গ্যাস ধারণের জন্য গবেষণা দলটিকে অনেক বেশি পরিমাণ ‘অলিভাইন’ খনিজ প্রক্রিয়াকরণ করতে হয়েছিল, যা আগ্নেয়গিরির পাথরে থাকা একটি উপাদান।
তবে, পৃথিবীর গভীর ইতিহাস বোঝার প্রচেষ্টা কেবল এ গবেষণার মধ্যেই থেমে নেই। গত বছরের ডিসেম্বরে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে একটি গবেষণা ক্রুজে সমুদ্রের তল থেকে অতিরিক্ত পাথরের নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন ঝাং।
রিটার পরীক্ষাগারে এইসব নমুনার বিশ্লেষণের পর পৃথিবীর প্রাচীন অতীতের অন্যান্য রহস্যেও আলোকপাত করার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে নোরিজ।
এর আগে অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন ইউনিভার্সিটির গবেষকরা পৃথিবীর ভূত্বকের একটি ৪০০-মিলিয়ন বছরের পুরনো টুকরো আবিষ্কার করেছেন, যা দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের নীচে অবস্থিত। সমুদ্র সৈকতের বালি থেকে নিষ্কাশিত খনিজ পদার্থের একটি ক্ষুদ্র দানায় চুলের চেয়ে পাতলা লেজার নিক্ষেপ করে এটি আবিষ্কৃত হয়েছিল। এই নতুন আবিষ্কার আমাদের গ্রহের বিবর্তন সম্পর্কে তথ্য দেয়, কীভাবে একটি জনবসতিহীন গ্রহ বাসযোগ্য হয়ে উঠল।
প্রধান গবেষক ম্যাক্সিমিলিয়ান ড্রেলনার বলেছেন যে লেজারটি জিরকন খনিজটির পৃথক দানা বাষ্প করতে ব্যবহৃত হয়েছিল। লেজার অ্যাবলেশন স্প্লিট স্ট্রিম-ইনডাক্টিভলি কাপলড প্লাজমা-মাস স্পেকট্রোমেট্রি নামে পরিচিত এই কৌশলটি বিজ্ঞানীদের ভূত্বকের বয়স কত তা খুঁজে বের করতে এবং অন্যান্য ভূত্বকের সাথে তুলনা করতে দেয়। এ থেকে তারা জানতে পারে এই স্তর মূলত কোথায় ধ্বংস করা হয়েছে। এছাড়াও, এটি এলাকার ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসও প্রকাশ করে।
ড্রোলনার বলেছেন যে পৃথিবীর ভূত্বকের এই অংশটির আকার আয়ারল্যান্ডের আকারের সমান। তিনি বলেন যে, আমরা প্রমাণ পেয়েছি যে এই ৪০০-কোটি বছরের পুরনো খণ্ডটি কয়েক কোটি বছর ধরে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার ভূতাত্ত্বিক বিকাশকে প্রভাবিত করছে। এছাড়াও, এটি সেখানে নির্মিত শিলা গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
টেরা নোভা (Terra Nova) জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা অনুসারে , এই গবেষণাটি জানায় যে ৪০০কোটি বছর আগে, পৃথিবীর বিবর্তনে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছিল, যেমন উল্কাপিণ্ডের বর্ষণ হ্রাস পেয়েছিল, ভূত্বক স্থিতিশীল হয়েছিল এবং পৃথিবীতে জীবন প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করেছিল।
আপনার মতামত জানানঃ