পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার প্রাচীন আদিনা মসজিদে গত রবিবার হঠাৎ করেই পুজোর আয়োজন করেন হিন্দু সাধু হিরণ্ময় গোস্বামী। সেই ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেছে। কয়েক বছর ধরেই হিন্দুত্ববাদীদের একাংশ দাবী করতে শুরু করেছে যে আদিনা মসজিদ আসলে আদিনাথ মন্দির ভেঙ্গে তৈরি হয়েছিল। যদিও কোনও ঐতিহাসিকের লেখাতেই এই তত্ত্ব পাওয়া যায় না।
প্রত্মতাত্ত্বিক নির্দশন হিসাবে সংরক্ষিত এই মসজিদে নামাজ পড়া হয় না। হিন্দু সাধুর পুজো করার পর থেকে সামাজিক মাধ্যমে গত তিন দিন ধরে আলোচনায় উঠে এসেছে আদিনা মসজিদের নাম।
যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে গেছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে যে বাঙালী সাধু হিরণ্ময় গোস্বামী আদিনা মসজিদ চত্বরে হিন্দু রীতি মেনে পুজো করছেন এবং এক ব্যক্তি তাকে বাধা দিচ্ছেন, দুই তরফে তুমুল কথা কাটাকাটি হচ্ছে।
বাধা দেয়া ওই ব্যক্তিকে পরে চিহ্নিত করা হয়েছে পুলিশের একজন কর্মী হিসাবে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, একদিকে মি. গোস্বামী বলছেন যে “কোথায় লেখা আছে যে এখানে প্রণাম করা যাবে না”, অন্যদিকে ওই সাদা পোশাকে থাকা ওই পুলিশ কর্মী তাকে বলছেন যে এখানে পুজো দেওয়া যায় না। মি. গোস্বামী সামাজিক মাধ্যমে যথেষ্ট পরিচিত।
‘সনাতনী সম্পদ’
বেনারস নিবাসী বাঙালী এই সাধু বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “ভাগবত পাঠ করতে মালদায় এসেছিলাম। যে স্থান আমাদের কোনও পীঠস্থান, সেটা আমাদের বড় আদরের, আমাদের বন্দনীয়। গৌরেশ্বরের একটা বড় পীঠস্থান হচ্ছেন আদিনাথ। সেটা আমাদের আরাধ্য পীঠ। সেই সূত্রেই আমাদের আগমন।“
তবে এর সাথে একমত নন ভারতের পুরাতত্ত্ব বিভাগ । আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়া বা ভারতের পুরাতত্ত্ব বিভাগ বলছে আদিনা মসজিদ তাদের সংরক্ষিত সৌধ। দপ্তরের এক পুরাতাত্ত্বিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, “আমাদের সৌধগুলির দুটি ভাগ আছে – একটা লিভিং আরেকটা নন-লিভিং। আদিনা মসজিদ একটি নন-লিভিং সৌধ এবং আইন অনুযায়ী এখানে কোনও ধরনের পুজো-অর্চনা, নামাজ পড়া যায় না। কোনও ধর্মীয় রীতি নীতিই এখানে পালন করা যায় না।“
ওই কর্মকর্তার কথায়, একটি সৌধ যখন এএসআই সংরক্ষিত সৌধের তালিকায় যুক্ত হয়, সেই সময়ে সেখানে যদি কোনও ধর্মীয় আচার পালন চলতে থাকে, সেটা চলতে দেওয়ার কথা আইনেই আছে। এগুলিকে বলে ‘লিভিং’।
আর যে সৌধ সংরক্ষণের তালিকায় যুক্ত করার সময়ে সেখানে কোনও ধর্মীয় রীতি নীতি পালন করা হত না, সেগুলিকে বলা হয় ‘নন-লিভিং’। আদিনা মসজিদ দ্বিতীয় এই তালিকায় আছে, কারণ যখন এএসআই এটিকে সংরক্ষিত সৌধের তালিকায় যুক্ত করেছিল, সেখানে নামাজ পড়া বা ধর্মীয় কোন অনুষ্ঠান হত না।
সেই হিসাবে নতুন করে নামাজ পড়া বা সেখানে পুজো দেওয়া আইন বিরুদ্ধ। পুরাতত্ত্ব বিভাগের এই আইন ভেঙ্গে কেন তাহলে পুজো করলেন মি. গোস্বামী?
এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এটা সনাতনী সম্পদ। তবে সনাতনী যে চিহ্নাদি এখানে রয়েছে, সেগুলো মিটিয়ে দেওয়ার একটা বিপুল চেষ্টা চলছে। আমাদের একটাই উদ্দেশ্য, যাতে আমরা এই সনাতনী সম্পদকে পুনরুদ্ধার করতে পারি।“
হিরণ্ময় গোস্বামী যেটাকে ‘সনাতনী সম্পদ’ বলছেন, অর্থাৎ আদিনা মসজিদ আসলে আদিনাথ মন্দির ভেঙ্গে তৈরি করা হয়েছিল বলে জানাচ্ছেন, সে সম্পর্কে কোনও ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না।
‘কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি পাই নি’
হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির গবেষক ও লেখক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য বলছিলেন, “নব্বইয়ের দশকে একটা বই লেখেন অরুণ শৌরি সহ আরও কয়েকজন। বইটার নাম ছিল হিন্দু টেম্পলস হোয়াট হ্যাপেণ্ড টু দেম, অর্থাৎ হিন্দু মন্দিরগুলির কী হয়েছিল, তা নিয়ে একটা প্রাথমিক সমীক্ষা। সারা দেশে কোন কোন মসজিদ পুরনো মন্দির ভেঙ্গে তৈরি করা হয়েছিল, তার একটা প্রাথমিক তালিকা দেওয়া হয় বইটিতে। ওই বইতেই প্রথম লেখা হয় যে আদিনাথ মন্দির ভেঙ্গে আদিনা মসজিদ বানানো হয়েছিল। কিন্তু আমি বহু খুঁজেও এর কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি পাই নি।“
আদিনা মসজিদের নির্মাণ শেষ হয় ১৩৭৪ সালে। সেই সময়ে সেটাই ছিল উপমহাদেশের বৃহত্তম মসজিদ। ভারতের পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রথম মহাপরিচালক আলেকজান্ডার কানিংহাম আদিনা মসজিদ নিয়ে লিখেছেন, এটিকে “বাঙালীরা বিশ্বের অত্যাশ্চর্যের অন্যতম বলে মনে করে।“
তার ‘রিপোর্ট অফ আ ট্যুর ইন বিহার অ্যাণ্ড বেঙ্গল ইন ১৮৭৯-৮০’ বইতে লিখেছেন পাণ্ডুয়ার (বর্তমানের মালদা জেলার অংশ) অসংখ্য নির্মাণ এবং ভাস্কর্যগুলির মাধ্যমে প্রায় সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে সেখানে অতীতে হিন্দুদের অবস্থান ছিল। কিছু এদিক ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, কিছু আদিনা মসজিদ, একলাখি মসজিদ আর নূর কুতব আলমের সমাধিতে ব্যবহৃত হয়েছে।
গবেষক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য বলছেন, কানিংহাম কোথাও এটা লেখেন নি পান্ডুয়া ধ্বংস করা হয়েছিল। যদিও তিনি এটা লিখেছেন যে গৌড়, পান্ডুয়া আর আশেপাশের এলাকার প্রাচীন ইসলামী স্থাপত্যগুলিতে তারও পূর্বেকার নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করার প্রচলন ছিলই। তার কথায়,এতে এটা প্রমাণ হয় না যে মন্দির ভেঙ্গে সেখানে মসজিদ গড়া হয়েছিল।
মন্দির-মসজিদ বিতর্ক
উত্তর প্রদেশে অযোধ্যা, কাশী আর মথুরায় মন্দির-মসজিদ বিতর্ক বহু বছর ধরেই চলেছে। অযোধ্যায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে প্রকাণ্ড রাম মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কাশীর জ্ঞানবাপী মসজিদ আর মথুরার শাহী ইদ্গাহ নিয়েও বিতর্ক আর মামলা মোকদ্দমা চলছে।
দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের দুটি ইসলামী স্থাপত্য নিয়েও একই কায়দায় ‘হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ বানানো হয়েছিল’ বলে দাবী তোলা হচ্ছে।
হুগলী জেলার ত্রিবেণীতে জাফর খাঁ গাজির দরগাহ্ এবং মালদার আদিনা মসজিদ নিয়ে এই দাবী করা হচ্ছে কয়েক বছর ধরে। ত্রিবেণীতে গত দুবছর ধরে শুরু করা হয়েছে একটি কুম্ভ মেলা। বলা হচ্ছে যে সেটি নাকি সাতশো বছর আগে চালু ছিল, তারপরে মুসলমান শাসনামলে তা বন্ধ হয়ে যায়। যেখানে কুম্ভ মেলা শুরু হয়েছে, তার পাশেই জাফর খাঁ গাজির দরগাহ্।
এই কুম্ভ মেলার ঐতিহাসিক প্রমাণ হিসাবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষকের পিএইচডি থিসিসে মাত্র কয়েকটি শব্দ পরিবর্তন করে দিয়ে এক জাল নথি সামনে আনা হয়েছিল।
যদিও হিন্দুত্ববাদী যেসব সংগঠন ওই কুম্ভ মেলা চালু করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তারা দাবী করেন যে তাদের কাছে অন্য নানা প্রমাণ আছে যে সাতশো বছর আগে কুম্ভ মেলা হত সেখানে।
আবার এখন আদিনা মসজিদ নিয়ে বিতর্ক নতুন করে মাথা চাড়া দিল। স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্যের কথায়, “এই দুটি ইসলামি স্থাপত্য নিয়ে মোটামুটি একই সময়ে বিতর্ক তোলা হচ্ছে। দুটিকে আলাদা করে দেখলে চলবে না।“
‘ভোটের আগে বিশৃঙ্খলার চেষ্টা’
পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের নেতা মুহম্মদ কামরুজ্জামান বলছেন যে আদিনা মসজিদে নামাজ পড়া না হলেও সেটি প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার নিদর্শন।
“নামাজ পড়া না হলেও ঐতিহাসিকভাবে তো এটা সত্য যে সেটি একটি মসজিদ। সেখানে কেন পুজো করতে হবে, তাও বেনারস থেকে এসে? বাংলার মানুষ কি পুজো করে না? উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঘটনা এটা বোঝাই যাচ্ছে,” বলছিলেন মুহম্মদ কামরুজ্জামান।
তার কথায়, “যে কোনও জায়গায় মনে হল আর পুজো করা হল, এটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রচেষ্টা। হিন্দুত্ববাদীরা সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরি করার একটা চেষ্টা চালাচ্ছে লোকসভা নির্বাচনের আগে। এটা চরম অন্যায়। প্রশাসনের উচিত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।“
আপনার মতামত জানানঃ