প্রথমবারের মতো মানুষের উভকামী (বাইসেক্সুয়াল) আচরণের সঙ্গে সম্পর্কিত জিনগত বৈচিত্র্যকে চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। কোনো ব্যক্তি উভকামী আচরণ করবেন কিনা তার ওপর জিনের প্রভাব ৪০ শতাংশ এবং পরিবেশের প্রভাব ৬০ শতাংশ বলে নতুন একটি গবেষণায় দাবি করা হয়েছে। গত বুধবার সায়েন্স অ্যাডভান্সেস জার্নালে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়।
প্রসঙ্গত বলে রাখি উভকামিতা বলতে উভয় লিঙ্গ অর্থাৎ পুরুষ ও নারী উভয়ের প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করাকে বোঝায়। উভকামিতা পরিভাষাটি নারী ও পুরুষ উভয়ের প্রতি যৌন বা রোমান্টিক অনুভূতি নির্দেশক মানব আকর্ষণকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয় এবং এই ধারণাটি বিপরীতকামিতা ও সমকামিতার সঙ্গে উভকামিতা যৌন অভিমুখিতার প্রধান তিনটি বর্গের অন্যতম, যা সমান্তরাল যৌনপ্রবৃত্তির অংশ।
উভকামী যৌন পরিচয়ে উভয় লিঙ্গের প্রতি সমান যৌন আকর্ষণের প্রয়োজন পড়ে না; সাধারণভাবে যাদের এক লিঙ্গের চেয়েও বেশি অপর কোন লিঙ্গের প্রতি অস্পষ্ট কিন্তু অনন্য নয় এমন যৌন পছন্দনীয়তা রয়েছে তারাও নিজেদেরকে উভকামী হিসেবে চিহ্নিত করে। মানবসভ্যতার বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় এবং প্রাণীরাজ্যের অন্যত্রও লিখিত ইতিহাসের সমগ্র সময়কাল জুড়ে উভকামিতার উপস্থিতি লক্ষিত হয়। তবে হেটেরোসেক্সুয়ালিটি ও হোমোসেক্সুয়ালিটি শব্দ দুটির মত বাইসেক্সুয়ালিটি শব্দটিও মূলত ঊনবিংশ শতাব্দীতে উৎপন্ন হয়।
মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড বিশ্বাস করতেন যে “পৃথিবীর সব মানুষই আসলে উভকামী… এবং তাদের লিবিডো থাকে দুই লিঙ্গের পরিসীমায় বিন্যস্ত …।” ১৯৪০ সালে স্যান্ডর রাডো এবং তাকে দেখে আরও অনেক মনোবিশ্লেষক ফ্রয়েডের জন্মগত উভকামিতার বিশ্বাসটি প্রত্যাখ্যান করেন। রাডো দাবি করেন যে, মানুষর মধ্যে কোন জৈবিক উভকামিতা নেই।
মধ্য-বিংশ শতাব্দীতে আলফ্রেড কিন্সে মানব যৌনতা সংক্রান্ত যে সমীক্ষাটি চালান, সেই সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে অনেক ব্যক্তিই বিপরীতকামী বা সমকামী শ্রেণীবিভাজনের আওতাভুক্ত নন; বরং তাদের যৌন অবস্থান এই দুই শ্রেণীর মাঝামাঝি কোথাও। কিন্সে স্কেল অনুসারে যৌন আকর্ষণ ও আচরণ স্কেলটিতে ০ (একান্ত বিপরীতকামী) থেকে ৬ (একান্ত সমকামী) সাতটি দাগ বিদ্যমান। কিন্সের গবেষণা অনুযায়ী, অধিকাংশ মানুষই এই স্কেলে ১ থেকে ৫ (অর্থাৎ, বিপরীতকামী থেকে সমকামী) দাগের মধ্যে পড়েন। কিন্সের পদ্ধতি সমালোচিত হলেও মানব যৌনতার অনবচ্ছেদ ব্যবস্থায় এটির ব্যাপক প্রয়োগ ঘটানো হয়ে থাকে।
তবে, উভকামীরা অনেক সময়ই শুধু প্রথাগত সমাজ নয়, সমকামী এবং বিষমকামী – দু দল থেকেই বঞ্চনার স্বীকার হয়। বিষমকামী তো বটেই এমনকি সমকামী মানুষদেরও এমন ধারণাই বদ্ধমূল যে, বিপরীতকামিতার বাইরে ‘সমান্তরাল যৌনপ্রবৃত্তি’ বা বিপরীতকামী-সমকামী অনবচ্ছেদ বলতে কেবল সমকামিতাকেই বোঝায়। ব্যাঙ্গালোরের ‘পিপলস ইউনিয়ন অব সিভিল লিবার্টি’র ক্ষেত্র-সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে সমকামীরা উভকামীদের শুধু প্রত্যাখ্যানই করে না, ঘৃণাও করে।
বর্তমান গবেষণা প্রসঙ্গে ফিরি। গবেষকেরা বলছেন, যখন কোনো হেটেরোসেক্সুয়াল ব্যক্তি বা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করা ব্যক্তি সুপ্তভাবে বাইসেক্সুয়াল জিন বহন করেন তখন তিনি ব্যক্তি জীবনে কেমন ঝুঁকি নিতে পছন্দ করেন এবং তাঁর সন্তান নেওয়ার প্রবণতা কেমন অনেকটাই তার ওপর। ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত অন্তত ৪ লাখ ৫০ হাজার মানুষের দেওয়ার তথ্যের ওপর ভিত্তি করে গবেষণাটি করা হয়। ২০১৯ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণার ওপর ভিত্তি করে নতুন গবেষণাটি করা হয়।
মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিয়ানঝি জর্জ ঝ্যাংসহ একদল গবেষক এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি এএফপিকে বলেন, গবেষণাটি দীর্ঘস্থায়ী একটি বিবর্তনীয় ধাঁধার উত্তর দিতে সাহায্য করেছে। সেটি হলো, কেন একই লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণের জন্য দায়ী জিনগত বৈশিষ্ট্যকে দূর করা যায় না।
এর আগে, ২০১৯ সালে পরিচালিত গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখতে পান—জেনেটিক বৈচিত্র্য ব্যক্তির সমলিঙ্গ আচরণে জড়িত। তবে পরিবেশগত কারণগুলো আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেই গবেষণার ভিত্তিতেই মানুষের উভকামী আচরণে জিন নাকি পরিবেশ কোনটির প্রভাব বেশি তা বোঝার চেষ্টা করেন গবেষকেরা।
অংশগ্রহণকারীদের সম্পূর্ণ ডিএনএ বা জিনোমের পাশাপাশি তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঝ্যাং ও সহকারী গবেষক সিলিয়াং সং একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছান। তাঁরা বলেন, সমকামী ও উভকামী আচরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো আলাদা আলাদা। এর অর্থ হলো তাদের আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। ঝ্যাং আরও বলেন, প্রকৃতি অনেক জটিল। একটি মাত্র জিন একাধিক বৈশিষ্ট্যকে প্রভাবিত করতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ