আপনার কাছে প্রশ্ন না-ও মনে হতে পারে। কিন্তু যুগ যুগ ধরে দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের মাথার চুল ছিঁড়েছে এ প্রশ্ন। কিন্তু উত্তর মেলেনি। কোনো সময়ের সঙ্গে ঘটনা আর ঘটনার সঙ্গে সয়ম ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
একটাকে বাদ দিয়ে আরেকটাকে কল্পনা করা যায় না। আরো নির্দিষ্টকরে বললে, গতি আর সময় একে-অপরের পরিপূরক। তাই সময় যেহেতু কোনোভাবেই পেছনের দিকে চলে না, তাই কোনো ঘটনাকেই আপনি পেছন দিকে ঘটতে দেখবেন না।
ধরা যাক, স্টেশন থেকে থেকে একটা ট্রেন ছেড়ে গেল। ট্রেনটা ছাড়ল তিনটা ত্রিশ মিনিটে। আপনি নির্নীমেষ তাকিয়ে রইলনে ট্রেনটার দিকে। ঠিক দশ মিনিটের মাথায় ট্রেনটা বাঁকের ওপাশে হারিয়ে গেল। ঠিক সে সময় আপনার মনে হলো, ট্রেনটা যদি পিছন দিকে ফিরত?
হ্যাঁ, ট্রেন আরেকটা স্টেশনে থেমে ঘুরে আবার আপনার দিকে আসতেই পারত। কিন্তু সেটা ঠিক ঘটনা বা সময়ের পেছনে ফেরার মতো নয়। আপনি চাইছেন ঠিক এমনটা, দেখলেন তিনটা চল্লিশে ট্রেনটা দিগন্তে হারিয়েছে, ঠিক এর পর মুহূর্তেই ট্রেনটা পিছন দিকে চলতে লাগল। মাথা ঘুরিয়ে নয়, পেছতে শুরু করল। আপনি ঘড়ির দিকে তাকালেন। দেখলেন, সময় একটু একটু করে পেছন দিকে চলছে, ৩.৩৯…৩.৩৮…৩.৩৭..এভাবে।
ঠিক দশমিনিট আগে যেখান থেকে ট্রেন স্টেশন ছেড়ে গিয়েছিল, সেখানে এসে থামল। ঘড়িতে তখন ঠিক ৩.৩০ মিনিট।
তারপরও সময় পেছন দিকে বইতে শুরু করল। তখন আগে যাদেরকে নামতে দেখেছিলেন, তাদের সবােইকে দেখবেন পিছিয়ে গিয়ে ট্রেনে উঠছে। যদি এটাকে ওঠা বলা যায়। আপনি এর মধ্যে খেয়াল করেছেন, আপনার আশপাশে যত লোক ছিল তাঁরা সব পেছন দিকে হাঁটছেন। গােড়িঘোড়া চলছে পেছন দিকে।
পুরো ঘটনাপ্রবাহ পেছন দিকে বইতে শুরু করেছে, ঠিক যেমন ভিডিওতে ছবি পেছন দিকে চালালে যেমন হয়, তেমন। কিন্তু এভাবে কী সময়ের পেছন দিকে চলতে পারে? পদার্থবিজ্ঞান বলছে সম্ভব। তাহলে এমনটা কখনো হতে দেখি না কেন?
সময় পেছনে চলার সমস্যা আছে। সবচেয় বড় সমস্যা হচ্ছে এটাকে পর্যবেক্ষণ কে করবে? ধরুন, ট্রেনটা সময়ের উল্টোদিকে এবং নিজের পেছন দিকে চলছে। আপনি তখন খেয়াল করেছেন সময় ওই দশ মিনিটের সব ঘটনাই পেছন দিকে চলেছে। আপনার নিজের সময়ও তখন পেছন দিকে চলবে। কারণ আপনি ওই সিস্টেমের অংশ। তাই সময় যদি পিছিয়েও আসে, আপনি কি সেটা বুঝতে পারবেন?
কারণ নিজেই তখন একটু একটু করে অতীতের দিকে যাচ্ছেন। আপনি সেই মূহূর্তে কী করছিলেন, এখনো তাই করবেন। আপনার মস্তিষ্ক তখন সেই মুহূর্তে কী ভাবছিল, সেটাই ভাবছে। তাই সময় পেছালোও আপনি সে বিষয়ে সচেতন হতে পারবেন না, কারণ আপনি স্বাভাবিক অবস্থায় যেভাবে অতীত মনে রাখতেন, ভবিষ্যৎ সেভাবে মনে রাখতে পারতেন না। পারলে কিন্তু ঝামেলাই হতো। তাহলে হাতের ঘড়ির দিকে খেয়াল করে সময়ের উল্টোযাত্রা বুঝবেন কী করে?
ধরা যাক, ৩টা ৩৫ মিনিটে উলটো দিক থেকে একটা ছেলে ঢিল ছুড়ছিল। ঢিলটা এগিয়ে আসছিল আপনার কপাল লক্ষ্য করে। শেষ মুহূর্তে আপনি মাথাটা সরিয়ে নিয়েছিলেন বলে রক্ষা পেয়েছিলেন বড় ধরনের বিপদের হাত থেকে। কিন্তু সময় যদি পেছনের দিকে চলত, তাহলে আপনার হয়তো ভবিষ্যতও মনে থাকত।
আপনি হয়তো ফেলে আসা ভবিষ্যতের কথা ভাবছেন। কিন্তু সেই মুহূর্তের অতীতে আপনি নিজেকে রক্ষা করায় ব্যস্ত ছিলেন। নিজেকে রক্ষা করার ভাবনা আর ভবিষ্যত ভাবনা, দুটো কি একসঙ্গে ভাববেন?
অবশ্য একটা সমাধান হতে পারে। ভবিষ্যতে যখন যাচ্ছেন, তখন হয়তো ভবিষ্যতের কথাই ভাবছেন, কারণ সেটাই তখন আপনার জন্য বাস্তব। পিছিয়ে যাওয়াটাই তখন স্বাভাবিক।
কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ার সময় কি কোনো ঘটনার, কোনো শব্দের, কোনো স্মৃতির কোনো মানে থাকবে?
একটু ভেবে দেখুন। আপনার হাতের কাপটা পড়ে ভেঙে গেল। কিন্তু ঘটনা যখন উল্টো ঘটছে, তখন ভাঙা জিনিসগুলো ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারটার বেশ অর্থবোধক।
একটা ভাঙা জিনিস জোড়া লেগে আস্ত জিনিসে পরিণত হচ্ছে। এখন কাপটা যখন কারিগর তৈরি করছিল, তখনকার কথা ভাবুন। কারিগর তো কাদা বা গলানো কাঁচ দিয়ে কাপ তৈরি করছিল। একতাল চিনামাটির কাঁদা কিংবা এক বাটি তরল কাচ ঠিক কোনো অর্থ তৈরি করে না, যতক্ষণ না কারিগর সেটাকে আকৃতি দিচ্ছে। তাই একটা কাপ তৈরি হওয়ার পর যদি সময় পিছোতে শুরু করে, ঘটনা যদি পেছন দিকে ঘটতে শুরু করে, তাহলে দেখা যাবে আস্ত কাপটা ধীরে ধীরে অর্থহীন কাঁদা বা গলিত কাচে পরিণত হবে। এক্ষেত্রে সময় পিছিয়ে গেলেও কিন্তু সুবিধা হচ্ছে না।
এবার আসা যাক, ভাষার ও ভাবনার কথায়। ট্রেনটা যখন সামনের দিকে যাচ্ছিল, তখন আপনি যে কথা বলছিলেন, সময় যদি উল্টো দিকে বইতে শুরু করে, তাহলে সেটার কী কোনো অর্থ দাঁড়াবে?
উল্টো দিকে সময় প্রবাহিত হলে, ঘটনা ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক– যা-ই হোক, শব্দ কখনো ইতিবাচক হবে না। এই ব্যাপারটা আপনি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। পাঁচ মিনিটের একটা ভিডিও তৈরি করুন। ধরা যাক, তাতে একজন কথা বলছে। ভিডিওটা যদি উল্টো দিকে চালানো হয়, তাহলে ছবিগুলো দেখতে খুব একটা অর্থহীন মনে না হলেও, শব্দের কোনো মাথামুণ্ডু বুঝবেন না। ধরা যাক, আপনি একটা বাক্য বললেন, ‘আমি ভাত খাই।’
এই বাক্যটুকু যদি উল্টোদিকে চালানো হয়, তাহলে উচ্চারণের ক্রমটা এমন দাঁড়াবে– ‘মিআ তাভ ইাখ’।
আসলে বাক্যটা এতটা অর্থহীন রূপ নেবে যে, উচ্চারণ বা লেখা সম্ভব নয়। কারণ সবচেয়ে শেষের ধ্বনি আগে শুনবেন ক্রমন্বয়ে সবার আগের ধ্বনী শুনবেন সবার পরে। পুরো বাক্যটা এমন খিঁচুড়ি পাঁকিয়ে যাবে যে, সেটার উদ্ধার অসম্ভব।
চিন্তাও যদি এভাবে উল্টে দিকে যায়, তাহলে কী হবে, ভাবাও মুশকিল। এখানে অবশ্য একটা সম্ভাবনাও আছে। সময় যদি, পেছনের দিকে চলে, তাহলে কী ভাবনাও বদলে যাবে? যেহেতু ভবিষ্যৎ দেখেছেন, তাহলে ভবিষ্যতের স্মৃতি মাথায় নিয়েই সময়ের উল্টো দিকে যাত্রা করছেন, তাহলে নিশ্চয়ই ভবিষ্যতও মনে রাখতে পারবেন। তাই যদি হয়, তাহলে আবার বদলে যায় অতীত।
সময় পেছন দিকে চললে অতীতের ঘটনাগুলোই তো উল্টো করে ঘটতে শুরু করবে। অতীত তো পাল্টে যাবে না। তাহলে ভাবনা কেন পাল্টাবে? তারমানে সময় পেছনদিকে চলতে শুরু করে, তাহলে কি আমরা বুঝতে পারব? মনে হয় না পারব। কারণ ‘ভবিষ্যতে গিয়েছিলাম’ এ স্মৃতিই যদি মনে থাকে, তাহলে কখোনো সেটা চেতনায় ধরা পড়ার কথা নয়।
আসলে এ সবই ভাবনার কথা। এসব ব্যাপারে কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের যে আইন, তাতে সময়ের উল্টো দিকে চলতে কোনো বাধা নেই। তারপরও কেন সময়কে হরহামেশা পেছন দিকে চলতে দেখছি না, এ নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো চিন্তিত। তবে পদার্থবিজ্ঞান সবসময় সময়কে পেছনে চলত অনুমতি দেয় না। তাপগতিবিদ্যা একটা বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের পরবর্তী আলোচনা সেটাই হওয়া উচিৎ।
আপনার মতামত জানানঃ