দীর্ঘদিন ধরেই শিল্প-কারখানায় উৎপাদন অব্যাহত রাখতে প্রয়োজনীয় চাপে গ্যাসের সরবরাহ না পাওয়ার অভিযোগ তুলছিলেন উদ্যোক্তারা। এখন এ সংকট আরো তীব্র হয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা। তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে আবাসিক খাতেও। রান্নাবান্নার জন্য পর্যাপ্ত গ্যাস পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলোর বাইরে সিএনজিচালিত পরিবহনের ভিড়। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পরও গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না।
বরাবরই দেশে গ্যাসের সরবরাহ হয় চাহিদার তুলনায় কম। তবে শীতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার কমায় এ সময় গ্যাসের সংকট অনুভূত হয় তুলনামূলক কম। কিন্তু এবার শীতের শুরুতেই তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে গ্যাস সংকট।
শিগগিরই এ সমস্যার সমাধান হবে না বলে জানিয়েছেন পেট্রোবাংলা ও গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, ভাসমান একটি এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ থাকায় গ্যাসের সরবরাহ কমেছে। আবার দেশের বৃহৎ সার কারখানাগুলোয়ও সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। এ কারণে রাজধানী ও আশপাশের অঞ্চলগুলোয় গ্যাসের সরবরাহ কমেছে।
দীর্ঘদিন ধরে চাহিদার তুলনায় ঘাটতির মধ্যে রয়েছে দেশের গ্যাস খাত। পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, দেশে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ৪৩০ কোটি ঘনফুট। যদিও স্বাভাবিক সময়ে জাতীয় গ্রিডে মোট সরবরাহ হয় ৩০০ কোটি ঘনফুট। বর্তমানে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির কক্সবাজারের মহেশখালীতে স্থাপিত ভাসমান টার্মিনালটি থেকে সরবরাহ বন্ধ থাকায় তা নেমে এসেছে ২৫৯ কোটি ঘনফুটে।
দেশে মোট গ্যাস সরবরাহের প্রায় ৪০ শতাংশ ব্যবহৃত হয় বিদ্যুতে। এখন তা নেমে এসেছে ৩৪ শতাংশে। এক মাস আগেও বিদ্যুতে দৈনিক গ্যাসের ব্যবহার ছিল ১২০ কোটি ঘনফুটের কাছাকাছি। গতকাল এ খাতে সরবরাহ হয়েছে ৮৮ কোটি ঘনফুট। গত ৫ নভেম্বর দেশের সার কারখানাগুলোয় গ্যাসের দৈনিক সরবরাহ ছিল ১২ কোটি ঘনফুট। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১৫ কোটি ঘনফুট। গতকাল জাতীয় গ্রিড থেকে শিল্প, আবাসিক ও পরিবহনসহ অন্যান্য খাতে মোট গ্যাস সরবরাহ হয়েছে ১৫৬ কোটি ঘনফুট।
সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বিতরণ কোম্পানি তিতাসের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গ্যাসের সংকট হচ্ছে এটা সত্য। এর কারণ দুটি। প্রথমত, দুটি এলএনজি টার্মিনালের একটি অপারেশনে না থাকায় সরবরাহ কমেছে। দ্বিতীয়ত, সার কারখানায় সরবরাহ বাড়ানোয় নারায়ণগঞ্জসহ শিল্প এলাকাগুলোয় তা কিছুটা কমেছে। শিগগিরই এর কোনো সমাধান পাওয়া যাবে না।’
গ্যাসের সরবরাহ কমায় উৎপাদন নিয়ে সংকটে পড়েছে শিল্প-কারখানাগুলো। আশুলিয়া, গাজীপুর, ময়মনসিংহের ভালুকা ও নারায়ণগঞ্জের শিল্প এলাকাগুলোয় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্যাসের চাপ সংকট সারা বছর থাকলেও এখন তা আরো মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এতে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি আর্থিক চাপও বাড়ছে শিল্পোদ্যোক্তাদের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএম) ভাইস প্রেসিডেন্ট ফজলুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গ্যাসের চাপ নিয়ে কারখানা মালিকরা বিরক্ত। এটা অব্যাহতভাবে চলছে। এর কোনো সমাধান কোনো দপ্তর থেকে পাচ্ছি না। অনেক কারখানায় প্রেসার নেমে এসেছে ১-২ পিএসআইতে (গ্যাসের চাপ পরিমাপের একক)। এ দিয়ে তো কারখানা চলতে পারে না। গ্যাসের প্রেসারজনিত সমস্যার কারণে নারায়ণগঞ্জে ৭০ শতাংশ কারখানা বন্ধ।’
শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জে এখন গ্যাস সংকট সবচেয়ে বেশি জটিল আকার ধারণ করেছে। চাহিদামাফিক জ্বালানি সরবরাহ না থাকায় বিপত্তির মধ্যে রয়েছে নগরীর আট শতাধিক কারখানার উদ্যোক্তারা। বিশেষ করে দেড় শতাধিক ডায়িং ফ্যাক্টরিতে তীব্র গ্যাস সংকট চলছে। এসব কারখানা পুরোপুরি গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। বাড়তি দাম দিয়েও গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সেখানকার ব্যবসায়ীরা।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গ্যাস সংকটের বিষয়টি নিয়ে আমরা বিকেএমইএর পক্ষ থেকে পেট্রোবাংলা, জ্বালানি বিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের চিঠি দিয়েছি। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের সঙ্গেও দেখা করেছি। এ খাতে আর্থিক ক্ষতির বিষয়গুলো আমরা জানিয়েছি। কিন্তু আমরা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ পাওয়ার কোনো আশ্বাস পাইনি। আমরা মনে করি, সরকার জ্বালানি খাত নিয়ে ভুল নীতিতে এগোচ্ছে। অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় নিলে শিল্প খাতে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি। কিন্তু সেটি দেখতে পাচ্ছি না। এমনটি চলতে থাকলে শিল্প মালিকরা ব্যবসাবিমুখ হয়ে পড়বেন।’
আবাসিক খাতেও গ্যাস সংকটের তীব্রতা বেড়েছে। গত দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে রাজধানীর গ্রাহকরা দিনের বড় একটি অংশ চুলা জ্বালাতে পারছেন না। বিশেষ করে সকাল ৬টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত সংকটের তীব্রতা থাকে বেশি। এরপর ১-২ ঘণ্টা গ্যাসের চাপ পাওয়া গেলেও কোথাও কোথাও বিকালেও গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। এতে করে পাইপলাইনে সরবরাহকৃত গ্যাস ব্যবহারকারীরা পড়েছেন তীব্র ভোগান্তিতে।
দেশে সরবরাহকৃত গ্যাসের বড় একটি অংশ ব্যবহার হয় ব্যক্তিগত গাড়ি ও যানবাহনে। বর্তমানে সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলোর বাইরে গ্যাসের জন্য সিএনজিচালিত ব্যক্তিগত গাড়ি ও অটোরিকশার দীর্ঘ সারি দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে রাজধানীর মিরপুর ১২, কাজীপাড়া, রামপুরা হাজিপাড়া, মালিবাগ ও কারওয়ান বাজারের সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলোর বাইরে সারাদিনই গ্যাস নিতে অপেক্ষমাণ সিএনজিচালিত যানবাহনের জট দেখা যাচ্ছে। এমনই কয়েকটি বাহনের চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেক সময়ই গ্যাস নিতে গিয়ে দেখা যায় প্রেসার নেই। একেকটি পরিবহনে গ্যাস ভরতে সময় লাগছে আগের চেয়ে অনেক বেশি।
সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলোর উদ্যোক্তা সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সারা দেশে সিএনজি ফিলিং স্টেশন আছে পাঁচ শতাধিক। সিংহভাগ স্টেশনেই গ্যাসের প্রেসার নেই। রেশনিং করে পরিচালনা করা হলেও ঠিকমতো গ্যাস পাওয়া যায় না। এসব ফিলিং স্টেশনের মেশিনে প্রতি ঘণ্টায় ৬০০ কিউবিক মিটার গ্যাস পাওয়ার কথা। সেখানে প্রতি ঘণ্টায় গ্যাস পাওয়া যায় সর্বোচ্চ ১৬০ থেকে ১৭০ কিউবিক মিটার। আর প্রেসার ১৫ পিএসআই পাওয়ার কথা থাকলেও পাওয়া যায় ৬-৭ পিএসআই। আবার কখনো তা ২-৩ পিএসআইয়েও নেমে আসে।
ফিলিং স্টেশনের ব্যবসায় মুনাফার মার্জিন এমনিতেই তুলনামূলক কম। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ব্যবসা থেকে পরিচালন ব্যয় তুলে আনাও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে অনেক উদ্যোক্তাই এখন এ ব্যবসা থেকে বিনিয়োগ গুটিয়ে নিচ্ছেন।
বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভারসন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ফারহান নূর গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সিএনজি ফিলিং স্টেশন ব্যবসায় এখন হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন মালিকরা। সামান্য মার্জিনের এ ব্যবসায় স্টেশনগুলো এখন ঠিকমতো গ্যাস পাচ্ছে না। এগুলো নিয়ে আমরা সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলে বার বার জানিয়েও কোনো সমাধান পাইনি। বর্তমানে তীব্র গ্যাস সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলো। গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে একেবারে সামান্য। কখনো কখনো প্রেসার ২-৩ পিএসআইয়েও নেমে আসছে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার অপারেশন বিভাগের বিদায়ী পরিচালক প্রকৌশলী কামরুজ্জামান খান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম থাকায় গ্যাসের সংকট বরাবরই ছিল। তবে এটি একটা পর্যায়ে রাখা সম্ভব হয়েছিল এলএনজি সরবরাহ ঠিক থাকায়। এখন একটি টার্মিনাল অপারেশনে নেই। যে কারণে গ্যাস সংকট কিছুটা বেড়েছে। এছাড়া শীতের কারণে গ্যাস সরবরাহে পাইপলাইনে কিছুট জটিলতা থাকে, তবে তা খুবই সামান্য। এর বাইরে বর্তমান সংকটের পেছনে অন্য কোনো কারণ নেই।’
আপনার মতামত জানানঃ