দেশে বিদ্যুৎ, শিল্প, আবাসিকসহ অন্যান্য খাতে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা প্রায় চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। বিপরীতে গড়ে সরবরাহ হচ্ছে তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। গ্যাসের স্থানীয় উত্তোলন হ্রাসের প্রেক্ষাপটে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানি বাড়লেও তাতে চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। এতে বিভিন্ন খাতে গ্যাসের সরবরাহ হচ্ছে রেশনিংয়ের মাধ্যমে। পেট্রোবাংলাসহ দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার পূর্বাভাস অনুযায়ী, দেশে গ্যাসের রেশনিং চালু রাখতে হবে আরো অন্তত দুই-তিন বছর।
চলতি ২০২৪ পঞ্জিকাবর্ষের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) বৈশ্বিক গ্যাস বাজারের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি এক পূর্বাভাস প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ)। ফ্রান্সভিত্তিক আন্তঃসরকারি সংস্থাটির প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০২৩ সালের প্রথম ১০ মাসে গ্যাসের চাহিদা কমেছে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১ শতাংশ। যদিও এ সময় এলএনজি আমদানি বেড়েছে ২০ শতাংশের কাছাকাছি। তবে এ আমদানি স্থানীয় উত্তোলন হ্রাসজনিত ঘাটতি পূরণে যথেষ্ট নয়। অপর্যাপ্ত সরবরাহে বিভিন্ন খাতে গ্যাসের রেশনিং করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এতে বিদ্যুৎ খাতকেও ক্রমাগত লোডশেডিং মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অর্থ ও অবকাঠামোর ঘাটতির কারণে এলএনজির আমদানি বাড়িয়েও এ ঘাটতি পূরণ সম্ভব নয়। চাহিদা ও সরবরাহের পার্থক্য ক্রমেই বেড়ে চলায় গত বছরের প্রথমার্ধে বিভিন্ন খাতে গ্যাস রেশনিং করতে হয়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভুগেছে বিদ্যুৎ ও শিল্প উৎপাদন খাত। দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট উৎপাদন সক্ষমতা দৈনিক সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট। যদিও এ সময় তা ছয় হাজার মেগাওয়াটের বেশি চালানো যায়নি। বিদ্যুতে গত বছর ১ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা থাকলেও গড় সরবরাহ ছিল ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট।
যদিও পেট্রোবাংলা বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের সরবরাহ ছিল ১ হাজার ৬৬ মিলিয়ন ঘনফুট। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বড় অংশ বসে থাকায় বিদ্যুৎ চাহিদা ও উৎপাদনে অন্তত আড়াই থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে। ওই সময় বিতরণ কোম্পানিগুলো ঘোষণা দিয়েই অব্যাহতভাবে কয়েক মাস লোডশেডিং করেছে।
বিদ্যুতের পাশাপাশি শিল্প খাতেও গ্যাসের সংকট চলছে দুই বছর ধরে। তবে সাম্প্রতিক সময় চট্টগ্রাম, গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার শিল্প এলাকার টেক্সটাইল মিলগুলোয় এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি হয়। এমনকি নারায়ণগঞ্জের বিসিক ও তার আশপাশের এলাকায় দুই সপ্তাহের জন্য গ্যাস সরবরাহ বন্ধও হয়ে যায়।
ব্যবসায়ীদের দাবি, গ্যাস সরবরাহ না থাকায় মিলগুলোর উৎপাদন শূন্যের কোঠায় নেমেছে। মাঝেমধ্যে গ্যাস সরবরাহ থাকলেও চাপের ওঠানামায় মিলের যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। এর কারণে রফতানিমুখী পোশাক শিল্পে প্রয়োজনীয় সুতা ও কাপড় সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। গ্যাস না থাকা সত্ত্বেও মিলগুলোকে ন্যূনতম গ্যাস বিল বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের লক্ষ্যে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করেছে সরকার। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরবরাহ ব্যবস্থার কোনো উন্নতি হয়েছে বলে আমরা জানি না। বিটিএমএর সদস্য মিলের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক টেক্সটাইল মিল ক্যাপটিভ পাওয়ার জেনারেশনের মাধ্যমে উৎপাদন পরিচালনা করে থাকে। এর মধ্যে ফ্যাব্রিক প্রসেসিংয়ের জন্য বয়লারেও গ্যাসের প্রয়োজন হয়। অথচ সমিতির সদস্য মিলগুলো দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস সংকটের কারণে সুষ্ঠুভাবে মিল পরিচালনা করতে পারছে না।’
গ্যাস সংকটের কারণে দীর্ঘদিন ধরেই রেশনিংয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সিএনজি খাত। সার ও আবাসিক খাতেও তা চলছে একপ্রকার অঘোষিতভাবে। অর্থাৎ এসব খাতেও চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করতে পারছে না পেট্রোবাংলা।
দেশে গ্যাসের প্রকৃত চাহিদা আসলে কত সেটির বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে সরকারি সংস্থাগুলো থেকে তথ্য জানা যায়নি। তবে পেট্রোবাংলার ভাষ্যমতে, দেশে দৈনিক প্রায় চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। আর তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ থাকলে বিদ্যুৎ, শিল্প, আবাসিক, সার ও শিল্পে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক থাকে। পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, চাহিদা ও সরবরাহে এখন গ্যাসের ঘাটতি দৈনিক এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এ পরিমাণ ঘাটতি গ্যাস স্থানীয়ভাবে যেমন জোগান দেয়ার সুযোগ নেই, তেমনি নেই আমদানি করার মতো অর্থ।
পেট্রোবাংলার নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গ্যাসের স্থানীয় সরবরাহ ও আমদানি এলএনজি দিয়ে তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেয়া সম্ভব। বড় পরিসরে গ্যাসের জোগান বাড়াতে হলে ২০২৬ সাল পর্যন্ত সময় প্রয়োজন। কারণ ওই সময়ে নতুন চুক্তির আওতায় দেশে এলএনজি আসবে এবং সেই সময়ে টার্মিনালগুলো প্রস্তুত হয়ে যাবে। তখন গ্যাস সরবরাহ সংকট কমে আসবে।’
জ্বালানি বিভাগের উইং হাইড্রোকার্বন ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয়ভাবে গত পাঁচ অর্থবছরে গ্যাস উত্তোলন কমেছে প্রায় ২০০ বিসিএফ। অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যেখানে স্থানীয় গ্যাসের উত্তোলন ছিল ৯৬৫ বিসিএফ, সেখানে তা কমে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৮০৬ বিসিএফে।
স্থানীয়ভাবে গ্যাসের উত্তোলন কমায় স্থানীয় গ্যাসের সঙ্গে ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে গ্রিডে এলএনজি সরবরাহ দেয়া হচ্ছে। ওই অর্থবছরে জাতীয় গ্রিডে এলএনজি সরবরাহ ছিল ১১৬ বিসিএফ। গত অর্থবছর পর্যন্ত তা দাঁড়িয়েছে ২০৩ বিসিএফে। অর্থাৎ গত পাঁচ অর্থবছরে জাতীয় গ্রিডে এলএনজি সরবরাহ বেড়েছে ৭৫ শতাংশ। একই সময়ে স্থানীয়ভাবে উত্তোলিত গ্যাসের সরবরাহ কমেছে ১৬ শতাংশের বেশি।
দেশে স্থানীয়ভাবে উত্তোলিত গ্যাসের চাহিদা ক্রমেই বাড়লেও গত ১০ বছরে এখানে বড় কোনো মজুদ আবিষ্কার করা যায়নি। ২০১১ সালের পর দেশে গ্যাসের প্রকৃত মজুদ সংক্রান্ত কোনো অনুসন্ধানভিত্তিক তথ্যও প্রকাশ হয়নি। ওই সময় এক সমীক্ষার ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোভিত্তিক কনসালট্যান্সি ফার্ম গুস্তাভসন অ্যাসোসিয়েটস জানিয়েছিল, মজুদ পাওয়ার সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ, দেশের এমন খনিগুলোয় গ্যাসের সম্ভাব্য মজুদ আছে ৩৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। এরপর আর কোনো সংস্থা বাংলাদেশের গ্যাস মজুদ নিয়ে কোনো কাজ করেনি।
হাইড্রোকার্বন ইউনিট বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুদ পাওয়া গেছে ২৯ দশমিক ৯৩ টিসিএফ। এর মধ্যে গত বছরের জুন পর্যন্ত ২০ দশমিক ৩৫ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। চলতি মাস পর্যন্ত উত্তোলন হয়েছে আরো অন্তত ৬০০ বিসিএফ। সে হিসেবে বাকি গ্যাস দিয়ে চলবে প্রায় ১০ বছর।
গ্যাসের উত্তোলন বাড়াতে সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬টি কূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছে। যদিও চলতি বছর পর্যন্ত মাত্র নয়টি কূপ খনন করা সম্ভব হয়েছে। এর মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে খুব বেশি গ্যাসও যুক্ত হয়নি। এছাড়া বিদেশী কোম্পানিকে সাগরে গ্যাস অনুসন্ধান চালাতে আহ্বানের জন্য সদ্য অনুমোদন পেয়েছে পেট্রোবাংলা। আর এলএনজি আমদানিতে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি সই হয়েছে তিনটি। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নের পরও আগামী কয়েক বছরে গ্যাস রেশনিংয়ের বাইরে আর কোনো সমাধান দেখছেন না জ্বালানিসংশ্লিষ্টরা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহে যে ঘাটতি রয়েছে, তা পূরণ করার মতো সক্ষমতা এখন পেট্রোবাংলার নেই। ফলে রেশনিং করেই গ্যাসের সরবরাহ ঠিক রাখতে হবে। পেট্রোবাংলার ২০৩০ সাল পর্যন্ত গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহে যে প্রক্ষেপণ রয়েছে, সেখানে গ্যাসের ঘাটতির পরিমাণ অনেক বড়। ২০২৬ সাল নাগাদ এলএনজি আমদানি হবে, সেটি দিয়েই গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার পরিকল্পনা সংস্থাটির। কিন্তু আদতে এটা পূরণ করা চ্যালেঞ্জিং। গ্যাসের চাহিদা-সরবরাহের ঘাটতি কমাতে হলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া তাৎক্ষণিক বিকল্প কোনো পথ নেই। কিন্তু সেটি করা হলেও গ্যাসের মজুদ দ্রুত ফুরিয়ে আসবে।’
আবার স্পট মার্কেটের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ানোকেও সমাধান হিসেবে দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা। শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশেও এখন স্পট এলএনজির চাহিদা বাড়ছে। এর ধারাবাহিকতায় এলএনজির বাজার আবারো যেকোনো সময় ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন বাজার পর্যবেক্ষকরা।
আইইএসহ আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজার সংস্থাগুলোর বিভিন্ন পর্যবেক্ষণেও উঠে এসেছে, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় গ্যাসের স্থানীয় উত্তোলন এখন কমছে। দাম কম হওয়ার সুবাদে দেশগুলো এখন স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বাড়াচ্ছে। বাড়তি এ চাহিদা যেকোনো সময় জ্বালানি পণ্যটির বাজার মূল্যকেও আবারো ঊর্ধ্বমুখী করে তুলতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ