হাজার হাজার বছর আগে যে ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসগুলো মানুষকে সংক্রমিত করেছিল সেগুলোর ডিএনএ এখনও তাদের কঙ্কালে আটকে আছে। তাদের কাছ থেকে নতুন কী তথ্য পাওয়া যেতে পারে, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা।
ষোল শতকে বর্তমানে মেক্সিকো নামে পরিচিত অঞ্চলটিতে হঠাৎ করেই জনসংখ্যা অত্যন্ত হ্রাস পায়। ইউরোপীয়রা অঞ্চলটি দখল করার পর সেখানে রোগ ছড়িয়ে পড়ে আর তার ফলে লক্ষ লক্ষ আদিবাসী মারা যায়।
সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত সবাই ধারণা করতো ইউরোপীয়রা তাদের সাথে করে ইউরোপ থেকে রোগটি নিয়ে এসেছিল – তবে এর জন্য কোন জীবাণু দায়ী ছিল তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
বিজ্ঞানীদের একটি দল এখন সেই সময়ে প্রাদুর্ভাবের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের দাঁত থেকে প্রাচীন ভাইরাল ডিএনএ বের করেছে। এই কঙ্কালগুলো নিউ মেক্সিকোতে ঔপনিবেশিক যুগের হাসপাতাল এবং গির্জার নিচে সমাহিত ছিল।
ডিএনএ পরীক্ষায় দেখা গেছে, আক্রান্তরা হেপাটাইটিস বি ভাইরাস এবং হিউম্যান বি ১৯ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিল, যাতে মূলত প্রাণীরা আক্রান্ত হয়।
গবেষকরা আরও দেখেছেন- ইউরোপ থেকে নয়, বরং ভাইরাসগুলো সম্ভবত আফ্রিকা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল।
“ভাইরাসগুলোর উৎস আফ্রিকান বলে মনে হচ্ছে আর আমরা যে তিনটি দেহ বিশ্লেষণ করছি তারাও জিনগতভাবে আফ্রিকান ছিল”, বলেন ইউনিভার্সিডাড ন্যাসিওনাল অটোনোমা ডি মেক্সিকোর ইন্টারন্যাশনাল ল্যাবরেটরি ফর হিউম্যান জিনোম রিসার্চের সহকারী অধ্যাপক মারিয়া সি আভিলা আরকোস।
সেই সময়ে ইউরোপীয় ব্যবসায়ী এবং উপনিবেশবাদীরা আফ্রিকানদের জোরপূর্বক দাস বানিয়ে হাজার হাজার মাইল দূরের অ্যামেরিকা মহাদেশে নিয়ে গিয়েছিল। জাহাজের মানবেতর অবস্থার কারণে সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
“এই মানুষগুলোকে অপহরণ করে একবারে অমানবিক অবস্থায় ঠাসাঠাসি করে অস্বাস্থ্যকর জাহাজে নেয়া হয়েছিল,” বলেন আভিলা আরকোস।
“আমেরিকার আদিবাসীরা এর আগে কখনও এই ভাইরাসের সংস্পর্শে আসেনি। ফলে এর সংক্রমণে তারা ঝুঁকিতে পড়ে। এটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়”।
শতাব্দী পুরনো কঙ্কাল থেকে ডিএনএর মাধ্যমে প্রাচীন যুগের রোগের কারণ অনুসন্ধান নিয়ে কাজের ক্ষেত্র প্যালিওমাইক্রোবায়োলজির জগতে এটি এক নতুন আবিষ্কার। এই ডিএনএ পুনর্গঠন করে বিজ্ঞানীরা ব্যক্তির মৃত্যুর শত শত বা হাজার বছর পরও একটি রোগ বা অবস্থা নির্ণয় করতে পারেন। আমরা কীভাবে আমাদের অতীতকে দেখি এবং বুঝি তাতে এই কৌশল বদল আনছে।
গুটিবসন্তের কথাই ধরা যাক। এই বিধ্বংসী রোগে কেবল ২০ শতকেই আনুমানিক ৩০ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। তবে গুটিবসন্ত সৃষ্টি করা ভ্যারিওলা ভাইরাসের উৎপত্তির বিষয়টি সবসময়ই অস্পষ্ট ছিল।
প্রাচীন বিবরণ থেকে ইতিহাসবিদরা ধারণা করেছিল গুটিবসন্ত প্রায় ১০ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের পুরনো। কিন্তু এর কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ছিল না।
লিথুয়ানিয়ান একটি মমি থেকে প্রাপ্ত ডিএনএতে দেখা গেছে এতে আক্রান্ত হওয়া সবচেয়ে পুরনো ঘটনাটি ছিল ১৭ শতকের।
তবে ২০২০ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বারবারা মুহলেমান নামের একজন পিএইচডি শিক্ষার্থী এবং তার সহকর্মীরা ৬০০ খ্রিস্টাব্দের ভাইকিং কঙ্কালের দাঁত থেকে ভেরিওলা ভাইরাস বের করার পর সময়টি আরও পিছিয়ে ধরা হয়।
ডেনমার্ক, নরওয়ে, রাশিয়া এবং যুক্তরাজ্যের ১১টি সমাধিস্থল থেকে এই পাওয়া কঙ্কাল নিয়ে এই গবেষণা করা হয়েছিল।
বাণিজ্যের দীর্ঘ ইতিহাস থাকা সুইডেনের পূর্ব উপকূলের ওল্যান্ড নামের একটি দ্বীপের একাধিক কঙ্কালেও গুটিবসন্ত পাওয়া গেছে।
এতে দেখা গেছে গুটিবসন্তের প্রথম নিশ্চিত হওয়ার ঘটনাটি এক হাজার বছর আগের। গবেষণাটি সুস্পষ্ট প্রমাণ দেয় যে ইউরোপ এবং এর বাইরে ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করা ভাইকিংরা তাদের সাথে করে গুটিবসন্তও নিয়ে গিয়েছিল।
আর এর মধ্যে প্রাচীন-ডিএনএ পরীক্ষাও প্লেগের উৎপত্তির বিষয়ে আলোকপাত করেছে। ১০১টি কঙ্কালের দাঁত থেকে মাইক্রোবিয়াল ডিএনএ নিয়ে ২০১৫ সালে এক গবেষণায় করা হয়।
এতে দেখা যায় প্লেগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া ওয়াই.পেস্টিস প্রথম নথিভূক্ত প্লেগ মহামারীর অন্তত তিন হাজার বছর আগে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল।
গবেষকরা সাতটি কঙ্কালের ডিএনএতে ওয়াই.পেস্টিস ব্যাকটেরিয়া খুঁজে পেয়েছেন, যার মধ্যে সবচেয়ে পুরনো জন মারা গেছে ৫ হাজার ৭৮৩ বছর আগে।
যদিও আধুনিক প্লেগ সাধারণত সংক্রামিত মাছি বহনকারী ইঁদুরের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, গবেষণায় দেখা গেছে খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার অব্দ পর্যন্ত প্লেগ ব্যাকটেরিয়া মাছিকে সংক্রমিত করার জন্য প্রয়োজনীয় মিউটেশন অর্জন করেনি।
এর আগে এটি সম্ভবত মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে কম গুরুতর নিউমোনিক প্লেগ হয়।
মাছিকে সংক্রমিত করার ক্ষমতা একবার অর্জন করার পর এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, আর এর ফলে বুবোনিক প্লেগের (ব্ল্যাক ডেথ) প্রাদুর্ভাব ঘটে। ১৪ শটকের এই মহামারী ইউরোপের অর্ধেক মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।
আমাদের আরেকটি গুরুতর রোগ- সিফিলিসকে দেখার দৃষ্টভঙ্গি বদলে দিয়েছে প্রাচীন ডিএনএ। আগে ধারণা করা হতো, ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকায় তার প্রথম সমুদ্রযাত্রা থেকে ফিরে আসার ঠিক পরে ১৪৯৫ সালে ইতালি থেকেই ইউরোপে প্রথম সিফিলিসের প্রাদুর্ভাব ঘটে।
যৌন সংক্রমিত রোগটি সেই সময়ে নেপলস রাজ্য জয়ের পরিকল্পনা করা ফ্রান্সের রাজা অষ্টম চার্লসের পদাতিক সৈন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
পরে আক্রান্ত ব্যক্তিকে দুর্বল করে দেয়া এই রোগটি দ্রুতই ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।
কলম্বাস আর তার কর্মীরা প্রথম সমুদ্রযাত্রা থেকে ফিরে আসার ঠিক পরে এই প্রাদুর্ভাব ঘটায় বেশিরভাগ ইতিহাসবিদরা ধারণা করেছিলেন সিফিলিস ইউরোপে সেই সময়ে পরিচিত ‘নতুন বিশ্ব’ থেকে ছড়িয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে ভিন্ন তত্ত্বের দিকে ঝুঁকছে বিশ্ব।
ইউনিভার্সিটি অফ বাযল এবং ইউনিভার্সিটি অফ জুরিখের প্রত্নতাত্ত্বিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক ভেরেনা শুয়েনম্যানের নেতৃত্বে ২০২০ সালে একটি দল সিফিলিসের ক্ষতের বৈশিষ্ট্যযুক্ত নয়টি কঙ্কাল থেকে ডিএনএ বের করে।
দেহাবশেষগুলো ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া এবং নেদারল্যান্ডসের সমাধিস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল।
গবেষকরাট্রেপোনেমা প্যালিডামের জীবাণুর অন্তত তিনটি পৃথক ধরন শনাক্ত করেন- যা সিফিলিস, ইয়াও-এর মতো রোগ সৃষ্টি করে এবং এটি এখন শুধু ক্রান্তীয় অঞ্চলে পাওয়া যায়।
কঙ্কাল এবং কফিনের কার্বনের মাত্রা থেকে জানা যায় তারা ১৫ শতকের প্রথম থেকে শেষের সময়ে মারা গিয়েছিল। আর কলম্বাস তার প্রথম সমুদ্রযাত্রা থেকে ফিরে আসার আগেই সিফিলিস ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল।
সিফিলিস ব্যাকটেরিয়ার মিউটেশন হারের উপর ভিত্তি করে করা গণনায়ও দেখা যায় এই রোগের উৎপত্তি কলম্বাস আসার আগে হয়েছে।
“আমরা জানি যে জীবাণুর বিস্তার বাণিজ্য পথের সঙ্গে সংযুক্ত,” বলেন শুয়েনম্যান।
“সিফিলিস, প্লেগ এবং কুষ্ঠ রোগের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই- যখনই মানুষ ভ্রমণ এবং বাণিজ্য বিনিময় শুরু করেছে, তারা জীবাণুদেরও ভ্রমণের সুযোগ করে দিয়েছে”।
অন্যদিকে, এর মানে হল কেবল মাইক্রোবিয়াল ডিএনএ প্রাচীন মহামারীর ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের অনেক কিছু জানাতে পারে। ডিএনএ নিজে কোন সমস্যা না।
যদিও সময়ের সাথে সাথে ডিএনএর গুণাগুণ হ্রাস পায়, তারপরও গবেষকরা দশ লাখ বছর আগে বেঁচে থাকা একটি ম্যামথের জিনোম সিকুয়েন্স তৈরি করেছেন।
তবে সম্ভবত প্রায় ১২ হাজার বছর আগে যখন মানুষ কৃষি ও কৃষিকাজ শুরু করেছিল তখনও মানুষ মহামারী সৃষ্টি করার মতো পর্যাপ্ত সংস্পর্শে আসত না।
“আসলে রোগগুলো ছড়িয়ে পড়ার জন্য আপনার নির্দিষ্ট পরিমাণ মানুষের প্রয়োজন, তাই আমরা প্রথম শহরগুলোর দিকে এই রোগগুলো দেখতে পাই। যখন মানুষ বসতি স্থাপন শুরু করেছিল তখনই মহামারী আঘাত হানে,” বলেন শুয়েনম্যান।
প্রাচীন মাইক্রোবিয়াল ডিএনএর জন্য এক দুর্দান্ত জায়গা হল দাঁতের গোঁড়ায় জমে থাকা ক্ষুদ্র কণা বা ফলক। সঠিকভাবে ব্রাশ না করলে এই আঠালো অংশটি দাঁতের উপর ব্যাকটেরিয়া তৈরি করে দাঁতের ক্ষয় এবং মাড়ির রোগ সৃষ্টি করে।
অবশেষে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটি শক্ত হয়ে মুখের মধ্যে থাকা প্রাচীন ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসের ডিএনএকে ভেতরে আটকে রাখে।
এই মাইক্রোবিয়াল জিনোম ডিকোডিং বিজ্ঞানীদেরকে আমাদের পূর্বপুরুষদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে তথ্যের ভান্ডারে পৌঁছানোর সুযোগ করে দিচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ ইউরোপে মধ্যযুগে কুষ্ঠরোগের চিকিৎসার ইতিহাসকে একত্র করার জন্য বহুজাতিক চিকিৎসা প্রকল্প মানব দাঁতের ফলক ব্যবহার করছে।
রোমের স্যাপিয়েঞ্জা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইমানুয়েলা ক্রিস্টিয়ানির নেতৃত্বে একটি দল ইংল্যান্ডের পিটারবোরোতে সেন্ট লিওনার্ডস এবং ফ্রান্সের সেন্ট-থমাস ডি’আইজিয়ারের মধ্যযুগীয় সমাধিস্থল থেকে খনন করা দাঁতের পাথরি পরীক্ষা করেছে।
দলটি কিছু কঙ্কালে আদার চিহ্ন খুঁজে পেয়েছে যা থেকে বোঝা যায় এটি দিয়ে দাঁতের রোগ চিকিৎসার চেষ্টা করা হয়েছিল।
উদাহরণস্বরূপ, ১১ শতকের একজন বিখ্যাত চিকিৎসক কনস্টানটাইন দ্য আফ্রিকান কুষ্ঠরোগের কারণে হওয়া পেটের ব্যথা উপশমে আদা এবং অন্যান্য মুখে খাওয়ার ভেষজ চিকিৎসা প্রস্তুত করার বিষয়ে লিখে গেছেন।
কিছু রোগীর মধ্যে পারদও পাওয়া গেছে, যা ত্বকের সমস্যা ঢেকে রাখতে এবং ব্যথা উপশমকারী মলম হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
এর থেকে এটিও বোঝা যায় যে ভুক্তভোগীদের কেবল বিচ্ছিন্ন রাখার পরিবর্তে তাদের যত্নও নেওয়া হতো।
দাঁতের ডিএনএ সিকুয়েন্সের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি মারা যাওয়ার সময় তার কী কী সংক্রামক রোগ হয়েছিল সেটা ছাড়াও আরও অনেক কিছু বলা সম্ভব।
ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি একজন ব্যক্তির মুখের মাইক্রোবায়োম অর্থাৎ মুখের ভেতর ও চারপাশে থাকা ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের বিশাল এবং বৈচিত্র্যময় ঝাঁক কেমন ছিল তা প্রকাশ করতে পারে।
এই তথ্য আবার প্রাচীনকালে অসংক্রামক রোগ বা এনসিডি’র ব্যাপকতা সম্পর্কে আমাদের জানাতে পারে।
এনসিডি হলো একটি দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা যা কেবল একটি নির্দিষ্ট সংক্রমণের ফলে হয় না। এগুলোর মধ্যে রয়েছে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এবং আলঝেইমার।
পেনসিলভানিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈবিক নৃবিজ্ঞানী অ্যাবিগেল গ্যাঙ্কজ বলেন, “কয়েক দশক আগের গবেষণায় দেখা গেছে কীভাবে মৌখিক স্বাস্থ্য এবং মাইক্রোবায়োম এই অবস্থাগুলোর সাথে সম্পর্কিত”।
একটি সাম্প্রতিক নিবন্ধে গ্যাঙ্কজ যুক্তি দেন মুখের মাইক্রোবায়োম এবং এনসিডির মধ্যে সংযোগ এতটাই সুপ্রতিষ্ঠিত যে প্রাচীন মানবগোষ্ঠী এগুলোর মধ্যে দিয়ে গেছে কি না তা অনুমান করতে হয়তো আমরা প্রাচীন মাইক্রোবিয়াল ডিএনএ ব্যবহার করতে পারি।
যদিও এগুলোকে প্রায়শই অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের কারণে আধুনিক রোগ হিসেবে ধরা হয়, তবে পূর্বপুরুষের মধ্যে তা কতটা প্রচলিত ছিল সে সম্পর্কে আমাদের কোনও ধারণা নেই।
কারণ এনসিডি সিংহভাগ কঙ্কালে কোনও স্বতন্ত্র চিহ্ন রেখে যায় না। তবে আজকের মতো একই পরিমাণে না হলেও এই রোগগুলোর উপস্থিতির লক্ষণ রয়েছে।
“প্রাচীন মিশরীয় সাহিত্যের লিখিত বর্ণনার সঙ্গে ডায়াবেটিসের মিল পাওয়া যায়, যেমন- প্রস্রাবের মিষ্টি-গন্ধের বিবরণ,” বলেন গ্যাঙ্কজ।
“অনুমান করা হয় অতীতে মানুষদের জীবন ছিল সংক্ষিপ্ত ও নৃশংস, তবে তাদের মধ্যে অনেকেই বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিল এবং এই অসংক্রামক রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়েছে”।
গ্যাঙ্কজ এনসিয়েন্ট সিস্টেম্যাটিক ডিজিজ প্রজেক্টের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যার লক্ষ্য প্রাচীন মানব মাইক্রোবায়োম এবং এনসিডির উপস্থিতির মধ্যে যোগসূত্র উন্মোচন করা।
এ পর্যন্ত তিনি মধ্যযুগ থেকে শিল্পযুগের ১৯২ জন ব্রিটিশ ব্যক্তির কঙ্কাল পরীক্ষা করেছেন।
এই প্রজেক্টে মানুষ মারা যাওয়ার সময় তার কোন ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস ছিল কি না তা খোঁজ করতে দাঁতের ফলকে পাওয়া মাইক্রোবিয়াল ডিএনএ ডিকোডিং করা হয়।
তারপরে বর্তমানে মানুষের পরিচিত রোগগুলোর সঙ্গে কঙ্কালে চিহ্নিত করতে পারা রোগের তুলনা করা হয়।
“কঙ্কালের বিভিন্ন ক্ষত থাকে যা রোগটিকে নির্দেশ করে,” বলেন গ্যাঙ্কজ।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ব্যক্তির ক্যাভিটি থেকে বোঝা যায় যে ব্যক্তি দাঁতের রোগে ভুগছিলেন।
একজন ব্যক্তির হাড় দেখে আপনি প্রদাহের লক্ষণ শনাক্ত করতে পারেন। যেমন, আর্থ্রাইটিসের ফলে হাড়ের আকারে চাক্ষুষ বিকৃতি দেখা যেতে পারে।
হাড় এমন এক জীবন্ত জিনিস যা জীবনজুড়ে পরিবর্তিত হয়। তাই কেউ যদি মানসিক চাপে থাকেন তবে তার হাড়ের ধরন এবং গঠন আলাদা হবে,” বলেন গ্যাঙ্কজ।
গবেষণাটি শেষ হলে বিজ্ঞানীদের কঙ্কালের মুখের মাইক্রোবায়োম দেখার অনুমতি দেওয়া উচিত যাতে সেই তথ্য ব্যবহার করে ব্যক্তি কোন দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগেছে কিনা তার সম্ভাব্যতা গণনা করা যায়।
এটি গবেষকদের ধারণা দেবে কীভাবে বাত এবং স্থূলতার মতো বিষয়গুলো সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়েছে, আর এতে কৃষি বিপ্লব, শিল্পায়ন এবং নগরায়ন কী প্রভাব ফেলেছিল।
এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে এই ধরনের বড় পরিবর্তনগুলো মানুষের স্বাস্থ্যের উপর বিশাল প্রভাব ফেলেছিল।
উদাহরণস্বরূপ, অধ্যাপক গ্যাঙ্কজের তত্ত্বাবধানে পেনসিলভানিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক লরা ওয়েইরিচের ২০১৩ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, শিকার থেকে কৃষি কাজের দিকে আসার পর আমাদের পূর্বপুরুষদের মুখের মাইক্রোবায়োম পরিবর্তিত হয়েছে এবং তা আরও অস্বাস্থ্যকর হয়েছে
গবেষণাটি মানব ইতিহাস রচনায় জীবাণুর ভূমিকার উপর জোর দেয়। কিন্তু এই ধরনের গবেষণা শুধুমাত্র ঐতিহাসিক আগ্রহের না।
এটি আধুনিক মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতিতেও ব্যবহার করা যেতে পারে।
ওয়েরিচের গবেষণার অন্যতম লক্ষ্য হল মাইক্রোবায়োম ট্রান্সপ্লান্টেশনের বিকাশ অর্থাৎ অস্বাস্থ্যকর মাইক্রোবায়োমের সঙ্গে স্বাস্থ্যকর মাইক্রোবায়োমের অদলবদল করা।
“এমন একটি দিনের কথা কল্পনা করুন যেখানে আপনার মুখে জীবাণুর কারণ হতে পারে এমন মাইক্রোবায়োম না থাকায় আপনাকে দাঁতই ব্রাশ করতে হবে না। এটি হতে পারে যদি আমরা জানতে পারি যে মানুষের মধ্যে জীবাণুর ব্যাপক উপস্থিতির আগের অবস্থা কী ছিল,” বলেন ওয়েইরিচ।
“আমি সবসময় বলি আমার যদি নিয়ান্ডারথালের মতো দাঁত থাকতো- কারণ নিয়ান্ডারথালদের বেশিরভাগেরই মৌখিক স্বাস্থ্য ভালো ছিল। আমরা যদি তাদের মাইক্রোবিয়াল গঠন নিতে পারি আর আধুনিক মৌখিক মাইক্রোবিয়াল ট্রান্সপ্লান্টেশন বিকাশে সেটা গাইড হিসাবে ব্যবহার করতে পারি, তাহলে ৯০ শতাংশ অ্যামেরিকান তাদের সাড়া জীবনে যে ক্যাভিটিতে ভোগেন তা ঠিক করার চেষ্টা করতে পারি”।
আপনার মতামত জানানঃ