ঘটনার শুরু মূলত রাজধানীর কেন্দ্র বলে বিবেচিত গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া সিটি সুপার মার্কেটের অবৈধ দোকান উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে। গত বছরের ৮ ডিসেম্বর এই উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেন ঢাকা দক্ষিণের বর্তমান মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। উচ্ছেদ অভিযানে ইঁদুরের গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে উক্ত মার্কেটকে কেন্দ্র করে সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির অজগর সাপ। সাবেক মেয়রের বিরুদ্ধে দোকান বরাদ্দের নামে কোটি কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ আসে। উচ্ছেদ অভিযান চলাকালে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ তোলেন— দোকানের বৈধতা পেতে সাঈদ খোকনের মেয়র থাকার সময় দোকানপ্রতি ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা দিয়েছেন তারা। অনেক ব্যবসায়ীর অভিযোগ, টাকা দেওয়ার পরও সে সময় দোকানের বৈধতা পাননি তারা।
দুর্নীতির এই অভিযোগে সাঈদ খোকনের সাথে আরেকটি নাম বড় করে উচ্চারণ হতে থাকে। তিনি হলেন ফুলবাড়িয়া সিটি সুপার মার্কেট-২ এর দোকান মালিক সমিতির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন। দোকান মালিক সমিতির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন দেলু প্রায় দুই যুগ ধরে তিনটি প্লাজা বা মার্কেট এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। তার নেতৃত্বেই অবৈধ এসব দোকান তৈরি করা হয়েছিল। সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের সময়ে দেলোয়ার হোসেনের মাধ্যমে মেয়র খোকন অবৈধ দোকান বৈধ করার নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। কিন্তু অভিযোগের তীর প্রথমে দোকান মালিক সমিতির সভাপতি দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে গেলেও সেটার মোড় ঘুরিয়ে দেন দেলোয়ার হোসেন। গত ৩০ ডিসেম্বর নকশাবহির্ভূত দোকান বরাদ্দ দিয়ে ৩৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজসে ফুলবাড়িয়া সিটি সুপার মার্কেট-২ এর ব্লক-এ,বি সি মূল বিল্ডিং এর মুল নকশাবহির্ভূত অংশ হিসাবে স্থাপনা তৈরি করে দোকান বরাদ্দ দেওয়ার ঘোষণা দেয়। ওই ঘোষণার পর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে যোগাযোগ করেন। তখন আসামিরা তাদের টাকা জমা দিতে বলে। আর যাদের নামে দোকান বরাদ্দ আছে তাদের ভুল বুঝিয়ে ভয়-ভীতি দেখিয়ে ফুলবাড়িয়া সিটি সুপার মার্কেট-২ এর মূল নকশা বহির্ভূত এক্সটেনশন ব্লক-এ, বি, সি-তে দোকান না নিলে মূল মার্কেটের দোকান মালিকদের দোকানের বরাদ্দ বাতিল ও তালা লাগিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে তারা এক্সটেনশন ব্লকে দোকান নিতে বাধ্য হন।
২০১৮ সালে দক্ষিণ সিটির সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের শেষ সময়ে গুলিস্তান ফুলবাড়ীয়া এলাকার ১৬টি মার্কেটে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন তার লোকজন। তখন অবৈধ দোকানকে বৈধতা দেয়ার কথা বলে প্রতি দোকান থেকে লাখ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, কেবল ফুলবাড়ীয়া-২ মার্কেট থেকেই ২০১৮ সালে ২১ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়।
সাবেক মেয়রকে টাকা দেয়ার প্রমাণ রাখতে দেলোয়ার উত্তরা ব্যাংকের ফুলবাড়ীয়া ব্রাঞ্চ এক্সিম ব্যাংকের পল্টন ব্রাঞ্চ, যমুনা ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংকের করপোরেট ব্রাঞ্চের একাউন্ট ব্যবহার করেছেন। এসব ব্যাংকের ৪৮টি চেক ট্রানজেকশনের লিস্ট আছে বলে দেলোয়ার দাবি করেন। এছাড়াও রয়েছে কোটি কোটি টাকা প্রদানের পে-অর্ডারসহ নগদ টাকা দেয়ার একাধিক প্রমাণ। কেবল ফুলবাড়ীয়া-২ মার্কেট থেকে ২১ কোটি টাকা তুলেছে মালিক সমিতি। আর ওই টাকা তৎকালীন মেয়র সাঈদ খোকনকে দেয়ার জন্য জমা দেন ফুলবাড়ীয়া মার্কেট-২ এর সভাপতি দেলোয়ার হোসেন দেলুর অ্যাকাউন্টে।
এঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে তখন সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন দাবি করেন, মেয়র তাপস দেলোয়ার হোসেনকে ব্যবহার করে তার বিরুদ্ধে লেগেছে। এনিয়ে সংবাদ মাধ্যমে চিঠি সহ নিজে সাংবাদিক সম্মেলন করে এসবকে তার বিরুদ্ধে বর্তমান মেয়রের চক্রান্ত বলে দাবি করেন।
সাবেক মেয়রের প্রতিক্রিয়ায় তখন বর্তমান মেয়র তাপস জানিয়েছিলেন, এই উচ্ছেদ অভিযান কোনো ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে নয়। অবৈধ ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে এই উচ্ছেদ অভিযান। এতে ব্যক্তিগতভাবে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র দাবি করা ঠিক নয় বলেও জানান তিনি।
এবার বর্তমান মেয়রের বিরুদ্ধে সাবেক মেয়রের ষড়যন্ত্র করার অভিযোগের তীর নয়, সরাসরি দুর্নীতির অভিযোগ আনলেন বর্তমান মেয়রের বিরুদ্ধে। গতকাল শনিবার(০৯ জানু) হাইকোর্টের সামনে এক মানববন্ধনে বর্তমান মেয়র তাপসের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলেন, বর্তমান মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ডিএসসিসির শত শত কোটি টাকা তার নিজের ব্যাংকে স্থানান্তর করেছেন। সেই টাকার লাভ তিনি গ্রহণও করছেন। এসব কর্মকাণ্ডের কারণে তাপস মেয়র পদে থাকার যোগ্যতাও হারিয়েছেন।
ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট ও সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেট থেকে সম্প্রতি উচ্ছেদ হওয়া দোকানিদের উদ্যোগে আয়োজিত মানববন্ধন কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে সাঈদ খোকন বর্তমান মেয়রের বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগ করেন। গতকাল শনিবার রাজধানীর হাইকোর্টের সামনের ফটকে এ মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। এতে উচ্ছেদ হওয়া দোকানিরা ব্যানার-ফেস্টুন-প্ল্যাকার্ড নিয়ে মানববন্ধনে অংশ নেন। এসবে লেখা ছিল- ‘বৈধ দোকান ভাঙলি কেন, তাপস-দেলু জবাব দে’, ‘নগর ভবন ঘেরাও করো, ক্ষতিপূরণ আদায় করো’, ‘ব্যবসায়ীদের জীবিকা রক্ষায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাই’ প্রভৃতি স্লোগান।
মানববন্ধন কর্মসূচিতে সাঈদ খোকন দাবি করেন, ‘তাপস দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের শত শত কোটি টাকা তার নিজ মালিকানাধীন মধুমতি ব্যাংকে স্থানান্তর করেছেন। শত শত কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লাভ হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং করছেন। অপরদিকে অর্থের অভাবে ডিএসসিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মাসের পর মাস বেতন পাচ্ছেন না। বেতন না পাওয়ার কারণে তারা নগর ভবনে বিক্ষোভও করেছেন। অর্থের অভাবে সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মেয়র তাপস সিটি করপোরেশন আইন-২০০৯, এর দ্বিতীয় ভাগের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৯(২)জ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মেয়র পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন।
বর্তমান মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের নাম উল্লেখ না করেই তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের জবাব দিয়েছেন। তাপস বলেছেন, ‘কেউ যদি ব্যক্তিগত আক্রোশের বশবর্তী হয়ে কোনো কিছু বলে থাকেন, সেটার জবাব আমি দায়িত্বশীল পদে থেকে দেওয়াটা সমীচীন মনে করি না।’
আজ রোববার(১০ জানু) সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন শেখ ফজলে নূর তাপস।
স্থানীয় সরকার আইন অনুযায়ী মেয়র পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন—এমন অভিযোগের জবাবে শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘এটা ওনার ব্যক্তিগত অভিমত। এটার কোনো গুরুত্ব বহন করে না।’
কর্মীদের বেতন দিতে না পারার বিষয়ে ডিএসসিসির মেয়র বলেন, ‘এটা ভ্রান্ত কথা। এমন বক্তব্যের বাস্তবিক কোনো ভিত্তি নেই।’
সাঈদ খোকনের দুর্নীতি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। আপনি দায়িত্ব নেওয়ার এক বছরের মাথায় উল্টো আপনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হলো—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘যদি কেউ উৎকোচ গ্রহণ করে, যদি কেউ ঘুষ গ্রহণ করে, যদি কেউ কোনো কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য কমিশন–বাণিজ্য করে, যদি কেউ সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে, বিল দেওয়ার জন্য কমিশন–বাণিজ্য করে, সরকারি প্রভাব কাজে লাগিয়ে কারো দিকে জিম্মি করে বা কোনো কিছু দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়, কিছু অর্থ নিয়ে থাকে, অর্থ আত্মসাৎ করে থাকে, সে ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়। যে অভিযোগ আনা হয়েছে, এটা কোনোভাবেই কোনো বস্তুনিষ্ঠ বক্তব্য না।’
তবে সংশ্লিষ্টরা কেউ কেউ বলছেন, সাবেক ও বর্তমান এই দুই মেয়রের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত তাপস নির্বাচনে জেতার পরপর যখন নগরোন্নয়নে হাত দিয়েছেন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তুলেছেন। তখন থেকেই সাবেক মেয়রের বিভিন্ন দুর্নীতি উন্মোক্ত করে দেন বলে অনেকের মতামত। এখন দেখার পালা দুই মেয়রের পরস্পরের দিকে কাদা ছুড়াছুঁড়ি কোন পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে। তবে এদিকে আজ রবিবার দুপুরে সচিবালয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) নবনির্বাচিত পরিষদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেছেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বর্তমান মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ও সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন, তা এই দুই ব্যক্তির (তাপস ও খোকন) ব্যক্তিগত বক্তব্য। এখানে দলের কোনো কিছু নেই।
এসডাব্লিউ/কেএইচ/১৯৫৪
আপনার মতামত জানানঃ