সূর্যের জন্ম কীভাবে —এ প্রশ্ন এখন আর কাউকে ভাবায় না। কারণ বহু আগেই সূর্য তথা নক্ষত্রদের জন্ম-মৃত্যুর প্রক্রিয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু পৃথিবী বা মহাবিশ্বের অন্যগ্রহগুলোর জন্ম কীভাবে হয়েছিল, সে ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত কোনো প্রমাণ দাখিল করতে পারেননি তাঁরা। কিন্তু এবার বুঝি ভাঙল এই প্রশ্নের আগল।
মহাকাশে স্থাপিত সবচেয়ে বড় দুরবিন জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ জানাচ্ছে কীভাবে গ্রহদের জন্ম হয়। গ্রহ গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে এই টেলিস্কোপের সাহায্যে। তা থেকেই বিজ্ঞানীরা এখন নিশ্চিত হতে পেরেছেন গ্রহদের জন্মের রহস্য সম্পর্কে। এ বিষয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে।
গবেষকদের একটা আন্তর্জাতিক দল জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের ডাটা পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল, গ্রহদের জন্মবিষয়ক অন্যতম একটি তত্ত্ব ‘আইসি পিবল ড্রিফট’ বা বরফি-শিলা প্রবাহ পরীক্ষা করা। এই তত্ত্ব দেখায়, কীভাবে ধুলো আর পাথর একত্রিত হয়ে গ্রহ তৈরি করে।
ছোট ছোট বরফাবৃত্ত নুড়ি পাথর নবজাত প্রটোপ্ল্যানেটরি বাইরের দিকে আছড়ে পড়ে। সেখানে এসব নুড়িগুলি একত্রিত হয়। এর ফলে কমে যায় নুড়ি পাথরের গতিবেগ। এ সময় সূর্যের উষ্ণতায় বরফ গলে যায়—এগুলোই আসলে গ্রহ গঠনের মূল উপদান। এই ছিল ‘আইসি পিবল ড্রিফট’ তত্ত্বের মূল কথা। কিন্তু এটা হাইপোথিসেই আটকে ছিল, এর পক্ষে বিজ্ঞানীরা কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেননি।
সম্প্রতি জেমস ওয়েব ডাটা বিশ্লেষণ করে, সেই প্রমাণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছেন বিজ্ঞানীরা। এজন্য বিজ্ঞানীরা দূর মহাকাশের কিছু প্রটোপ্লানেটরি ডিস্ক পর্যবেক্ষণ করেছেন।
মহাকাশে হাইড্রোজেন জমা হয়ে মেঘের মতো নেবুলা তৈরি করে। নেবুলার ভেতর ঘুরতে থাকা হাইড্রোজেন গ্যাস গতিশীল হয়ে পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। উৎপন্ন হয় তাপ। সেই তাপে হাউড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াস যুক্ত হয়ে হিলিয়াম তৈরি হয়। একে বলে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া।
এই বিক্রিয়া আর মহাকর্ষ বলেরে প্রভাবে হাউড্রোজেন ও সদ্যোজাত হিলিয়ামগুলি জন্ম দেয় আস্ত নক্ষত্রের। হ্যাঁ, একটা নক্ষত্র তৈরি হতে প্রচুর গ্যাস দরকার হয়। তবে এরও একটা সীমা আছে। তার চেয়ে বেশি গ্যাস যদি নেবুলাতে থাকে, সেটা উপজাত হিসেবে নক্ষত্রের ছড়িয়ে যায় এবং ঘুরতে থাকে নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে। নক্ষত্রের চারপরশে তৈরি হয় অসংখ্য বলয়। সে সব বলয় মিলে একটা ডিস্ক বা চাকতির আকার নেয়। এই চাকতিকেই বলে প্রটোপ্ল্যানেটরি ডিস্ক।
দুই ধরনের প্রটোপ্লানেটরি ডিস্ক আছে —কম্প্যাক্ট ও এক্সেটেন্ডেড। এক্সেটেন্ডেড ডিস্কগুলি মূলত একাধিক বলয় দিয়ে তৈরি এবং প্রসারিত। সেগুলো আলাদা আলাদাভাবেই থাকে। অন্যদিকে কম্প্যাক্ট ডিস্কে চাপ ও মহকর্ষীয় বলের প্রভাবে বলয়গুলি সব একত্রে ঠাসাঠাসি করে থাকে।
নতুন এই গবেষণায় দেখা গেছে, বরফের নুড়িগুলি গোটা প্রোটোপ্ল্যানেটরি ডিস্কজুড়ে বিচরণ করতে পারে। অবশ্য কম্প্যাক্ট ডিস্কে এদের চলাচল অনেক সহজ।
আগে মনে করা হতো, ডিস্কের যে সব অঞ্চলে গ্রহগুলি তৈরি হয়, সেগুলো সুস্থির। কিন্তু পরবর্তীতে গবেষণায় দেখা গিয়েছে, গ্রহ তৈরির উপদান ও অঞ্চলগুলি মোটেও স্থির নয়। এরা যেমন নড়াচড়া করতে পারে, তেমনি পারে নিজেদের ভেতরে যোগাযোগ করতেও। আমাদের সৌরজগতেও এমন ঘটনা ঘটেছে বলে প্রমাণ মিলেছে। এমনটাই জানিয়েছেন নিউইয়র্কের ভাসার কলেজের গ্রহবিজ্ঞানী কোলেট সালিক।
বিজ্ঞানীরা ক্যম্পাক্ট ও এক্সটেন্ডেড ডিস্কগুলো মিলিয়ে দেখেছেন, করেছেন এদের তুলনামূলক বৈশিষ্ট্য নির্ণয়ও। দেখা গেছে এক্সটেন্ডেডের তুলনায় কম্প্যাক্ট ডিস্ক স্নোলাইন বা বরফরেখায় অনেক বেশি জলীয় বাষ্প হারায়।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের প্রটোপ্ল্যানেটরি ডিস্কের ডেটা বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হচ্ছেন, গ্রহ তৈরির মূল উপদানগুলি পুরো ডিস্কের ভেতর দিকে চলে যেতে পারে। সেটা কম্প্যাক্ট ডিস্কে আরও সহজ। কারণ এক্সটেন্ডেড ডিস্কের মতো বলয়গুলিতে কোনো ফাঁক পেরুতে হয় না কম্প্যাক্ট ডিস্কে। এই অবাধ প্রবাহ ডিস্কের কেন্দ্রের দিকে নুড়ি পাথর ও বরফকে প্রতিনিয়ত ঠেলে দিচ্ছে, তাই সেখানে গ্রহ তৈরির মূল উপদান পাথর আর পানির অভাব হচ্ছে না মোটেও। এই ব্যাপারটিই ‘আইসি পিবল ড্রিফট’ তত্ত্বকে সমর্থন করছে।
এটাকে চিত্তাকর্ষক আবিষ্কার বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের উচ্চ রেজ্যুলেশনে ছবি ধারণের ক্ষমতাই এই গবেষণাটিকে সহজ করে তুলেছে। এখন খুব সহজেই গ্রহদের সৃষ্টি বিষয়ক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এর সাহায্যে চালিয়ে নেওয়া সম্ভব বলে মনে করছেন তারা।
আপনার মতামত জানানঃ