পৃথিবীতে প্রাণের বৈচিত্র্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তাদের ভেতরে শুধু বৃহদাকার প্রাণীই নয়, নানা ধরনের অসংখ্য আণুবীক্ষণিক অনুজীবের সংখ্যা গুণে শেষ করা যাবে না। ভাইরাস হল তেমনই এক বিশেষ প্রজাতির অনুজীব। এরা এক ধরনের অতি আণুবীক্ষণিক রোগ সৃষ্টিকারী অনুজীব, যারা কোন প্রাণীর শুধুমাত্র জীবিত কোষের ভেতর রেপ্লিকেশন করতে পারে।
প্রকৃতিতে বিরাজমান প্রায় মিলিয়নের বেশি প্রজাতির ভাইরাসের ভেতর মাত্র ৯০০০ এর মত প্রজাতি সম্পর্কে আমরা এখন পর্যন্ত জানতে পেরেছি!
পৃথিবীর প্রায় সকল ইকোসিস্টেমে এদের অস্তিত্ব রয়েছে। কোনো ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত হবার সাথে সাথেই আক্রমণকারী ভাইরাসের মত অবিকল অসংখ্য কপি তৈরি করতে হোস্ট সেল বা পোষক কোষ বাধ্য হয়। ভাইরাস যখন কোন জীবিত কোষের বাইরে থাকে, তখন তারা বিশেষ স্বতন্ত্র কণা হিসেবে অবস্থান করে, এদের ভিরিয়ন বলা হয়। অনেক বিজ্ঞানীই ভাইরাসকে জীবিত অস্তিত্ব বলে মনে করেন।
কারণ এদের জৈবনিক উপাদান রয়েছে, প্রজননে সক্ষম। তাছাড়া এরা প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তিত হতে পারে। কোন কিছুকে যদি আমরা প্রাণী বলতে চাই, তার এই গুণগুলো থাকা আবশ্যক।
তারপরও প্রাণের কথা বলতে গেলে আরও কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার, যা ভাইরাসের ভেতরে নেই। তাই তাদের বলা হয়, অর্গানিজম অ্যাট দ্যা এজ অব লাইফ।
ধান ভানতে শীবের গীত তো অনেক গাওয়া হল, এবার কাজের কথায় আসা যাক। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা হঠাৎ করেই ভাইরাসখেকো অনুজীবের সন্ধান পেয়েছেন। তারা মূলত নিজেদের খাদ্যের চাহিদা মেটাতে ভাইরাসের উপর আক্রমণ করে থাকে।
পৃথিবীর সর্বত্রই ভাইরাল বায়োমাসের সন্ধান পাওয়া যায়, এমনকি আমাদের বায়ুমণ্ডল কিংবা সাগর মহাসাগরগুলোতেও তারা বিচরণ করছে।
ভাইরাসের ভেতর দুটি রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি বেশি থাকে। তাদের একটি হল নাইট্রোজেন, অপরটি ফসফরাস। কার্বন সমৃদ্ধ খাবারের ক্ষেত্রে এই দুটি উপাদান গুরুত্বপূর্ণ পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। কার্বন সমৃদ্ধ মেরিন কলয়েডগুলোও এর অন্তর্ভুক্ত।
২০২০ সালে জার্নাল ফ্রন্টিয়ার ইন মাইক্রোবায়োলজিতে ইউরোিপ ও যুক্তরাষ্ট্রের একদল বিজ্ঞানীর লেখা একটা গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। সেই গবেষণার রিপোর্ট অনুযায়ী একটি ভাইরাসের প্রজাতি অপর বিভিন্ন প্রজাতির ভাইরাসের সাথে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত তাদের বিবর্তন ঘটাচ্ছে।
তারা একে অপরের জৈব গাঠনিক উপাদানগুলো একে অপরের থেকে ছিনিয়ে নিতেও সক্ষম! এই অনুজীবগুলো ভিরিয়ন পার্টিকেল গুলোকে ফাঁদে আটকে তাদের শক্তির উৎস বা পুষ্টি উপাদান হিসেবে ব্যবহার করতে পারে, এমন কোন শক্ত প্রমাণ কদিন আগেও বিজ্ঞানীদের হাতে ছিল না।
এই গবেষক দলে ছিলেন মার্কিন বিজ্ঞানী জুলিয়া এম ব্রাউন, জোসেফ ব্রাউন, নিকোল জে. পউলটন, রেমিও লোজারেস, নিকোলাস আর. রেকর্ড, মাইকেল কে. সেরিয়াকি এবং স্প্যানিশ বিজ্ঞানী র্যামিরো লোগারেস ও রামুনাস স্টেপ্যানাস্কাস।
সম্প্রতি উত্তর আমেরিকার সমুদ্র উপকূলে দুটি বিশেষ প্রজাতির এককোষী অনুজীবের সন্ধান পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীদের কাছে এই দুটি অনুজীবের অস্তিত্ব প্রথমবারের মত সত্যিকারের ভাইরোফেজের নিদর্শন বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রায় ১৭০০ এর বেশি প্লাংকটন কোষ পরীক্ষা করার পর বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসখেকো অনুজীবের সন্ধান পান। ভূমধ্যসাগর এবং গালফ অব মেরিনের পানি থেকে নমুনা সংগ্রহ করবার পর তারা এই একেকটি অনুজীবের ভেতরে তাদের ডিএনএগুলোকে বিবর্ধিত করেন। এভাবে তৈরি হয় একেকটি জিনোমিক লাইব্রেরি। এদের অনেকগুলো সিকোয়েন্স অনুজীবগুলোর নিজেদের সাথে মিলে যায়।
এছাড়া মেডিটেরিয়াল স্যাম্পলের উপর গবেষণা করে কিছু সিকোয়েন্স পাওয়া যায়, যেগুলোর ব্যাকটেরিয়ার সাথে সম্পর্কিত। প্লাংকটন সাধারণত খাবার হিসেবে এদের ব্যবহার করেছিল।
কিন্তু উত্তর আমেরিকার উপকূল থেকে যে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল, সেখানকার সিকোয়েন্সে ভাইরাসের অস্তিত্ব বেশি খুঁজে পাওয়া যায়। এখানে জিনোমিক লাইব্রেরীর স্নিপেটগুলোর (Snippet) ভেতর প্রায় ৫০ বা তারও বেশি ধরনের বিভিন্ন ভাইরাসের জিনের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। আবার মেডিটেরিয়ান নমুনার বেশিরভাগই ব্যাকটেরিওফাজ।
এরা বিশেষ ধরনের ভাইরাস যারা ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমণ এবং তার শরীরে রেপ্লিকেশন করতে পারে। সামুদ্রিক প্রোটোজোয়াদের জন্য ব্যাকটেরিয়া একটি অন্যতম খাদ্যের উৎস।
তাই ব্যাকটেরিয়োফাজের পাশাপাশি প্রকৃতিতে এমন ভাইরোফাজ বা ভাইরাসখেকো অনুজীবের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া তেমন কোন অবাক করা বিষয় নয়। তবে নতুন আবিস্কৃত এই কোলানোজোয়া এবং পিকোজোয়া প্রজাতির অনুজীবের কাজকর্ম কিন্তু কিছুটা অস্বাভাবিকই বটে।
প্রথমত, তাদের ভেতর কেন ব্যাকটেরিয়াল ডিএনএ খুঁজে পাওয়া যায় নি। দ্বিতীয়ত পরীক্ষায় এই দুটি ভিন্ন প্রজাতির অনুজীব প্রায় একই ধরনের ভাইরাল সিকোয়েন্স প্রদর্শন করে!
এই নতুন অনুজীবগুলো প্রাকৃতিক পরিবেশে খাদ্যশৃংখলা কিভাবে পরিচালিত হয়, সে ব্যাপারে আমাদের প্রচলিত ধারণা আমূল বদলে দেবে। বদলে দেবে প্রকৃতিতে খাদ্য উপাদানের পরিবহণের ধারা সম্পর্কে গবেষণা।
এই অনুজীবগুলো আবিস্কারের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন মহামারি ও দুরারোগ্য ব্যাধিতে নতুন ধরনের জৈব প্রযুক্তিভিত্তিক চিকিৎসা ব্যবস্থার উদ্ভাবন এখন আরও সহজ হবে।
আপনার মতামত জানানঃ