ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলের উপর শনিবার থেকে এক নজিরবিহীন আক্রমণ শুরু করেছে। হামাস যোদ্ধারা গাজা উপত্যকার কাছাকাছি ইসরায়েলি বসতিগুলোতে ঢুকে পড়ে এবং অতর্কিত হামলা চালায়। আকাশ, জল, স্থল দিয়ে ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে শুরু করে হামাস। বসে থাকেনি ইসরায়েলও। হামাসকে নির্মূল করার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। কিন্তু হামাসকে নির্মূল করা কি এতই সহজ?
হামাস একটি ফিলিস্তিনি ইসলামি সশস্ত্র গোষ্ঠী যারা গাজা উপত্যকা শাসন করে। হামাস ২০০৭ সালে ইসরায়েলকে হঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসে। এরপর ইসরায়েলের সাথে আরো কয়েকটি যুদ্ধ করে তারা। কীভাবে হামাস এমন সামরিক সক্ষমতা অর্জন করল—জানতে চাইলে সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ নেতা আলী বারাকা বলেন, ‘প্রয়োজনই উদ্ভাবনের জনক’।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু হামাসের এই পদক্ষেপকে ‘যুদ্ধ’-এর মতোই আপত্তিকর বলে জানিয়েছেন। এ-ও জানিয়েছেন, সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসকে উচিত শিক্ষা দিতে তৈরি তারা। ইসরায়েলের সেনাবাহিনী বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, আপাতত হামাসের ‘নুখবা’ বাহিনীকে জব্দ করতে চায় তারা। গত শনিবার ইসরায়েল হামলার নেপথ্যে নাকি এই ‘নুখবা’ বাহিনী। তাই ভয়ংকর এই বাহিনীকে যেন তেন ভাবে নির্মূল করতে বদ্ধপরিকর তারা।
‘নুখবা’ হল হামাসের অভিজাত বাহিনী। এই বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যকে বাছাই করেন হামাসের প্রবীণ এবং শীর্ষ নেতারা। বেশ কিছু পরীক্ষায় পাস করে তবেই হওয়া যায় ‘নুখবা’-র সদস্য। আর সেই পরীক্ষাও নেহাত সহজ নয়।
কেন এত গুরুত্ব দেওয়া হয় এই ‘নুখবা’ বাহিনীকে? হামাসের হয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল কাজ করে এই ‘নুখবা’। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের হামলার ধরন হতে পারে আত্মঘাতী। সে সব মনে রেখেই যোগ দেন সদস্যেরা। এই ‘নুখবা’ বাহিনী অতর্কিতে হামলায় পারদর্শী। শত্রুর ঘরে তল্লাশি চালিয়ে খুঁজে বের করে মানুষজনকে।
শত্রুর এলাকায় প্রবেশের জন্য অভিনব পন্থা নেয় এই বাহিনী। সুড়ঙ্গ খুঁড়ে তার মাধ্যমেই পৌঁছে যায় লক্ষ্যস্থলে। ক্ষেপণাস্ত্র, স্নাইপার রাইফেল, ট্যাঙ্ক ধ্বংসকারী ক্ষেপণাস্ত্র চালনায় পারদর্শী এই ‘নুখবা’ বাহিনী। হামাসের শীর্ষ নেতাদের নিরাপত্তার দায়িত্বও রয়েছে এদের কাঁধে।
গাজা উপত্যকা ইসরায়েল, মিশর এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যে একটি ৪১ কিমি দীর্ঘ এবং ১০ কিমি-প্রশস্ত অঞ্চল। যেখানে প্রায় ২৩ লাখ লোক বসবাস করে এবং এটি বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা।
ইসরায়েল গাজা এবং এর উপকূলীয় এলাকার আকাশসীমা নিয়ন্ত্রণ করে পাশাপাশি সীমান্ত দিয়ে কারা যাতায়াত করবে ও কী ধরনের পণ্য প্রবেশ করতে পারবে তা তদারকি করে। একইভাবে মিশরও গাজা সীমান্ত দিয়ে কারা প্রবেশ করবে তা নিয়ন্ত্রণ করে।
২০০৭ সাল থেকে গাজা শাসন করছে স্বাধীনতাকামী হামাস গোষ্ঠী। সেই থেকে এই সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ করছে হামাস, এমনটাই দাবি ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর মুখপাত্র জোনাথন কনরিকাসের। তিনি জানিয়েছেন, গাজা শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে রেখেছে হামাস। সেই সুড়ঙ্গের মাধ্যমেই নিমেষে যাতায়াত করে তারা।
কনরিকাস জানিয়েছে, এই সুড়ঙ্গকে ব্যবহার করেই ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছে হামাস। গাজার ভেতরের এই সুড়ঙ্গ দিয়ে ইসরায়েল সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় অনায়াসে পৌঁছে গেছে তারা। তারপর সেখান থেকে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলের ভেতরে। তাদের ধারণা, ওই সুড়ঙ্গে ঘাপটি মেরে রয়েছে ‘নুখবা’ বাহিনীর সদস্যেরা।
পরীক্ষা দিয়ে হামাসের এই বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর নিতে হয় প্রশিক্ষণ। কীভাবে জিম্মি করতে হবে শত্রুপক্ষকে, তা-ও হাতে ধরে শেখানো হয় ‘নুখবা’ বাহিনীর সদস্যদের। হামাস পণবন্দি বা জিম্মি করতে সিদ্ধহস্ত। ইসরায়েলের বহু নাগরিককে জিম্মি করেছে তারা। গাজায় নিয়ে এসে রেখেছে তাদের।
এই ইসরায়েলি নাগরিকদের জিম্মি করার নেপথ্যেও রয়েছে ‘নুখবা’। এই বাহিনীকে বিভিন্ন অস্ত্রচালনা, বিস্ফোরণ ঘটনার প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। স্কুবা ডাইভিংও শেখেন সদস্যেরা। গভীর সমুদ্র দিয়ে সাঁতার কেটে ইসরায়েলের উপকূলে পৌঁছে হামলা চালাতে সমর্থ তারা।
‘নুখবা’-র সদস্যেরা গ্রেনেড ছোড়ারও প্রশিক্ষণ নেন। ২০১৪ সালের গাজার যুদ্ধে এই বাহিনীর শয়ে শয়ে সদস্য প্রাণ হারিয়েছিলেন। ইসরায়েল সেনার হাতে নিহত হয়েছিলেন তারা। এরপর ফের এই বাহিনী আড়েবহরে বৃদ্ধি করার কাজ শুরু করে হামাস। শুরু হয় সদস্য সংগ্রহ। প্যালেস্তাইনের বহু নাগরিক যোগ দেন এখানে। তবে মনে করা হয়, ‘নুখবা’ ছেড়ে বহু সদস্য আইএসে যোগ দিয়েছিলেন। সে কারণেও কিছুটা দুর্বল হয়েছিল এই বাহিনী।
আপনার মতামত জানানঃ