যিশু খ্রিস্টের প্রয়াণ নিয়ে ‘বাইবেল’-এর ‘নতুন নিয়ম’-এর গসপেলগুলিতে যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তার সঙ্গে ভিন্ন মত পোষণ করেন বহু মানুষ। তাঁদের মতে, ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু এবং এক পাথরের গুহায় সমাধিস্থ করার পর যিশুর পুনরুত্থান এবং সশরীরে স্বর্গগমনের ইতিবৃত্তে আধ্যাত্মিকতা থাকলেও, তাকে ঐতিহাসিক সত্য বলে মানা যায় না। খ্রিস্ট ধর্মের ইতিহাসকারদের একাংশ মনে করেন, ক্রুশবিদ্ধ হয়ে যিশুর মৃত্যু হয়নি। মাইকেল বেইগ্যান্ট, রিচার্ড লি এবং হেনরি লিঙ্কন তাঁদের বই ‘হোলি ব্লাড অ্যান্ড হোলি গ্রেল’ (১৯৮২)-এ তুলে ধরেছিলেন এমন এক তথ্য, যা নিয়ে তোলপাড় হয় সারা বিশ্ব।
বেইগ্যান্ট, লি এবং লিঙ্কনের গবেষণা জানায়, ক্রুশবিদ্ধ যিশুকে গুরুতর আহত অবস্থায় এক গুহায় রাখা হয়। পরে সুস্থ হয়ে সেই গুহা থেকে যিশু বেরিয়ে আসেন এবং সেই ঘটনাই তাঁদের মতে ‘পুনরুত্থান’ নামে পরিচিত। গবেষকদের মতে, ইতিহাস যে যিশুর কথা বলে, তিনি বাইবেল বর্ণিত ‘তত্ত্বপুরুষ’ নন। তাঁর সশরীরে স্বর্গারোহণের বিষয়টিও প্রতীকী। ‘পুনরুত্থান’-এর পর যিশুকে আরও কয়েক বার দেখা গিয়েছে, এ কথা বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টেই রয়েছে। (ছবিটি নিকোলাস নোটোভিচের)
তা হলে শেষ পর্যন্ত কী হয় যিশুর? একটা সময়ের পরে আর জেরুজালেম বা সংলগ্ন এলাকায় তাঁর উপস্থিতির কথা জানা যায় না। ১৮৯৪ সালে রুশ অভিযাত্রী নিকোলাস নোটোভিচ একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ‘লাইফ অফ সেন্ট ইসা’ নামের সেই বইতে নোটোভিচ দাবি করেন, তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে যিশুর কিছু যোগ ছিল। যিশুর কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণ পর্যন্ত ঘটনা নিউ টেস্টামেন্টে বর্ণিত হয়নি। নোটোভিচের মতে, সেই সময় রাজা হেরদের কোপ থেকে বাঁচতে যিশুকে প্রাচ্যের এক বৌদ্ধ গুম্ফায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই গুম্ফা আজকের লাদাখে অবস্থিত হেমিস মঠ। ‘পুনরুত্থান’-এর পর যিশু সেখানেই ফিরে যান এবং সেখানেই পরিণত বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। কাশ্মীরে এক বিতর্কিত সমাধিকে যিশুর কবর বলে অনেকেই মনে করেন।
নোটোভিচের রচনা নিয়ে বিতর্ক আজও বহমান। কিন্তু এর পাশাপাশি, যিশুর কবর নিয়ে আরও একটি দাবি রয়েছে। সেই দাবি অনুযায়ী, যিশুর কবর রয়েছে জাপানের আওমোরি প্রিফেকচারের শিঙ্গো নামে এক গ্রামে। আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে জাপানে তাকেনোউচি মাতোরি নামে এক রহস্যময় মানুষ এক ইতিবৃত্ত লিখে গিয়েছিলেন।
‘তাকেনোউচি ডকুমেন্টস’ নিয়ে পরবর্তী কালে বিস্তর বিতর্ক হয়। বেশির ভাগ মানুষই এই নথিপত্রের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেন। ১৯৩৬ সালে এই নথিপত্র আবিষ্কৃত হয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাকি সেগুলি ধ্বংস করে ফেলা হয়। সুতরাং, সেগুলির সত্যাসত্য বিচারের কোনও সুযোগই এখন আর নেই। তবে এই সূত্র মতে, শিঙ্গো গ্রামের একটি বিশেষ জায়গা ‘যিশু খ্রিস্টের কবর’ হিসাবে পরিচিত। এবং এই কারণে শিঙ্গো একটি পর্যটনস্থলও হয়ে উঠেছে।
শিঙ্গো গ্রামেই গড়ে উঠেছে ‘জেশাস মিউজ়িয়াম’। সেখানে যিশুর জাপানবাসের ‘প্রমাণ’ রাখা রয়েছে। এই সংগ্রহশালাতেই তাকেনোউচি ডকুমেন্টসের একটি নকলও রাখা রয়েছে। বিস্তর পর্যটক এই মিউজিয়ামটি পরিদর্শনে এলেও অধিকাংশই একে ভাঁওতা বলে মনে করেন।
যে জায়গাটি যিশুর সমাধি বলে পরিচিত, সেটি একটি টিলার উপরে অবস্থিত। তথাকথিত সমাধিটির উপরে একটি বৃহৎ ক্রস বসানো রয়েছে।
এই ‘সমাধি’র কাছেই আর একটি ঢিবিতে যিশুর ভাইয়ের কান এবং মেরি মাতার কেশগুচ্ছ সমাহিত রয়েছে বলে কথিত।
কিন্তু কেন জাপানে গেলেন যিশু? এর উত্তরও রয়েছে তাকেনোউচি ডকুমেন্টস-এ। বলা হচ্ছে, কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণ পর্যন্ত সময় যিশু বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন অধ্যয়ন করতেই জাপানে গিয়েছিলেন। ক্রুশ থেকে বেঁচে তিনি আবার জাপানেই ফিরে আসেন। লক্ষণীয়, এই কাহিনির সঙ্গে নটোভিচ-বর্ণিত হেমিস গুম্ফার আখ্যানের আশ্চর্য রকমের সাদৃশ্য রয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ