সামনেই নির্বাচন এবং এটাই বর্তমান সরকারের আওতাধীন শেষ অর্থবছর। আর দীর্ঘদিন থেকেই এ দেশে চলে আসা একটি অপরেওয়াজ হচ্ছে, সরকারের কার্যমেয়াদের শেষ বছরে গিয়ে চালাক-চতুর সুযোগসন্ধানীরা নিয়মনীতি ভঙ্গ করে হলেও রাষ্ট্রের কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে।
আর সে অপচেষ্টার আওতায় বিভিন্ন আইন ও বিধিবিধান প্রণয়ন, শাস্তি ও ঋণ মওকুফ, আর্থিক সুবিধাদি মঞ্জুর, নির্মাণ ও সরবরাহ কাজের কার্যাদেশ প্রাপ্তি, পদোন্নতি ও পোস্টিং, বিদেশ ভ্রমণ, উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও সংশোধন ইত্যাদি অনেক কিছুই রয়েছে। আর এ নিয়ে চারদিকে একের পর এক যেসব তুঘলকি কাণ্ড ঘটে চলেছে, তার কিছু কিছু বিবরণ প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিশেষত সংবাদপত্রে প্রকাশ হচ্ছে।
অবশ্য প্রকাশিত এসব বিবরণ এ-সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ তৎপরতার খুবই সামান্য অংশ মাত্র। পূর্ণাঙ্গ তালিকা এতটাই দীর্ঘ যে এ ধরনের প্রবন্ধের আওতায় তা সংকুলান করা সম্ভব নয়—এজন্য প্রয়োজন স্বতন্ত্র তালিকাগ্রন্থ।
উল্লিখিত ধরনের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের হিড়িক অতীতেও ছিল, যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এ বছর তা যেন সব রেকর্ডকে ছাপিয়ে যাচ্ছে, বিশেষত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও সংশোধনের ক্ষেত্রে। বিষয়টির গুরুত্ব ও এ-সংক্রান্ত অপতৎপরতার ভয়াবহতা উপলব্ধি করে এ নিয়ে এখানে খানিকটা আলোকপাতের চেষ্টা করা হলো।
তাতে অবশ্য এর সঙ্গে জড়িত অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ, উদ্যোগ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান, সংশ্লিষ্ট দাতা সংস্থা কিংবা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা কেউই উল্লিখিত তৎপরতা গ্রহণ থেকে বিরত থাকবেন বলে মনে হয় না। কিন্তু তার পরও ন্যূনতম বিবেক-বিবেচনা ও নৈতিকতা রক্ষার তাগিদ থেকে বিষয়টি সামনে তুলে আনা প্রয়োজন বলে মনে করছি।
শেষ মুহূর্তের সুযোগ ধরার লক্ষ্যে কোনো ধরনের বাছ-বিচার ছাড়াই যেভাবে নানা যুক্তিহীন খাতে ও যথেচ্ছ সংখ্যায় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে, তাকে রীতিমতো লুটপাট ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই এ প্রকল্পগুলো গ্রহণ করা হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব প্রকল্পের সঙ্গে বৃহত্তর জনস্বার্থের কোনো সম্পর্ক নেই; বরং ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত সুবিধা হাসিলই এগুলোর মূল লক্ষ্য।
এগুলোর আওতাধীন বিভিন্ন অঙ্গের ব্যয় প্রাক্কলনের ক্ষেত্রে যেমন কোনো গ্রহণযোগ্য মানদণ্ড অনুসৃত হচ্ছে না, তেমনি যাচাই করে দেখা হচ্ছে না এগুলোর সম্ভাব্য ফলাফলও। এমনকি এমন প্রকল্পও গ্রহণ করা হচ্ছে যেগুলোর মাধ্যমে উল্টো দেশ ও জনগণের ক্ষতি হচ্ছে। এর মধ্যে এমন বেশকিছু অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পও রয়েছে যেগুলো লোক দেখানো উন্নয়নের নামে মূলত নির্মাণকাজ থেকে কমিশন ভাগাভাগি ছাড়া আর কিছুই নয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আওতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে, এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এমন বিশাল সব অট্টালিকা গড়ে তোলা হয়েছে যেগুলো দেখলে চোখে ধাঁধা লেগে যায়। কিন্তু যখন জানা যায় যে ওই ভবনগুলোর অধিকাংশই দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে, তখন বুকের ভেতরটা বস্তুতই কষ্টে ভারী হয়ে আসে। কোনো প্রয়োজনীয়তা যাচাই না করেই উন্নয়নের প্রচারণার আড়ালে নিছক কমিশন বাণিজ্যের ভাগাভাগির জন্য জনগণের দেয়া কর কিংবা তাদের নামে বিদেশ থেকে আনা ঋণ ব্যবহার করে দেশের কী করুণ উন্নয়নই না ঘটানো হচ্ছে!
উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে যথেচ্ছাচারের মহোৎসব সামাল দিতে পরিকল্পনা কমিশনকে এখন রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। আদৌ প্রয়োজন নেই এ ধরনের অগণিত প্রকল্প অনুমোদনের জন্য প্রায় প্রতিদিনই সেখানে এসে জড়ো হচ্ছে। এমন অসংখ্য প্রকল্প আসছে যেগুলোর ব্যয় প্রাক্কলন এতটাই ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে করা হয়েছে যে দেখলে ঠিকাদারের চওড়া হাসিও ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার কথা।
নতুন কিংবা সংশোধিত উভয় ধরনের প্রকল্পের আওতায়ই ভুয়া, বানোয়াট, অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের খাত অন্তর্ভুক্তির অভিযোগ উঠছে। পত্রিকায় প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন দাতাসংশ্লিষ্ট প্রকল্পেও এ ধরনের মচ্ছব চলছে। অবশ্য করোনার সময় থেকেই দাতাসংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোয় এ ধরনের নগ্ন অস্বচ্ছতা ও অনৈতিকতা চলে আসছে। এ ব্যাপারে পত্র-পত্রিকাগুলোয় সপ্রমাণ তথ্য প্রকাশ হওয়ার পরও দাতা সংস্থাগুলো পুরোপুরি নীরব। তবে কি তাদের গায়েও পচন ধরেছে? সংস্থাগুলোর বিভিন্ন দেশীয় কার্যালয়ের ওপর কি তাহলে তাদের সদর দপ্তরগুলোর কোনো নিয়ন্ত্রণ বা পরিধারণ নেই?
১ সেপ্টেম্বরের দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত খবর, ‘শুধু এমএ পাস করলেই বেতন ৫ লাখ টাকা।’ শিরোনামটির আওতাধীন খবর থেকে জানা যায় যে পরিকল্পনা কমিশনে অনুমোদনের জন্য পেশকৃত স্থানীয় সরকার বিভাগের ‘আরলি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট ক্যাপাসিটি এনহ্যান্সমেন্ট অব পার্টিসিপেটিং ইউনিয়ন পরিষদ’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের ১ হাজার ২৮ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ের মধ্যে ৯৫০ কোটি ১৫ লাখ টাকাই রাখা হয়েছে পরামর্শক ও প্রয়োজন নেই এমন জনবল খাতে, যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের ৯০ শতাংশ।
প্রকল্পের আওতায় ঊর্ধ্বতন প্রকল্প ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, ঊর্ধ্বতন অনুদান ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও ঊর্ধ্বতন নিরীক্ষা বিশেষজ্ঞের মাসিক বেতন ধরা হয়েছে ৫ লাখ টাকা। কিন্তু শিক্ষাগত যোগ্যতা শুধুই সাধারণ এমএ পাস—কোনো বিশেষায়িত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন নেই। এ বিষয়ে মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন যে এটা ভয়ংকর প্রস্তাব।
গত ১৫ সেপ্টেম্বরের খবর, আড়াই হাজার কোটি টাকার বিজ্ঞানশিক্ষা সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় গবেষণাগারের জন্য রাখা হয়েছে মাত্র ২০ কোটি টাকা, বাদবাকি সবটাই ভবন নির্মাণের জন্য।
প্রকল্প প্রণয়নকারী দপ্তর, সুপারিশকারী মন্ত্রণালয়, অনুমোদনকারী কমিশন এবং সর্বশেষ পর্যায়ের একনেক (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) সবার কাছেই কীভাবে মনে হলো যে ভবন নির্মাণ মানেই বিজ্ঞানশিক্ষার উন্নয়ন? সুবিধা ও ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে পারস্পরিক সমঝোতায় (জ্যাঁ জ্যাক রুশোর ভাষায় যা ‘সামাজিক চুক্তি’) উপনীত উল্লিখিত সবার কাছেই এটাকে উন্নয়ন বলে মনে হলেও এ দেশের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতাহীন কিন্তু সচেতন সাধারণ মানুষ এটা ঠিকই বোঝে যে এর সঙ্গে বিজ্ঞানশিক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই—বিজ্ঞানশিক্ষার উন্নয়নের তো নয়ই। এ হচ্ছে নির্মাণ ব্যয়ের অর্থ নিয়ে ঠিকাদার থেকে রাজনীতিক, আমলা হয়ে কনিষ্ঠ করণিক পর্যন্ত নানা স্তরে কমিশন ভাগাভাগি মাত্র।
অবশ্য উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এ ধরনের ভয়ংকর কমিশন ভাগাভাগির কাজ আরো আগে থেকেই শুরু হয়েছে এবং সে ধারাবাহিকতায়ই এ ভয়ংকরতা আজ এমন প্রকাশ্য লুটপাটের রূপ ধারণ করতে পেরেছে। আর এ অগণিত লুটপাটের দালিলিক মূল্যায়নেরই একটি হচ্ছে কিছুদিন আগে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) কর্তৃক বিদ্যুৎ খাতের ওপর প্রণীত প্রতিবেদন, যেখানে এ খাতের ক্যাপাসিটি চার্জ ব্যবস্থাকে একটি লুটেরা মডেল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো যে মূল্যায়নটি বস্তুনিষ্ঠ ও আইএমইডির ওপর অর্পিত বিধিবদ্ধ দায়িত্বের সরাসরি অংশ হওয়া সত্ত্বেও এ মূল্যায়নের কারণে সংশ্লিষ্ট সচিব ও কর্মকর্তাকে তাৎক্ষণিকভাবে শাস্তির মুখে পড়তে হয়। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে বিধিবদ্ধ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের যদি প্রশংসা লাভের পরিবর্তে উল্টো বিপদের মুখে পড়তে হয়, তাহলে এ খাতে লুটপাট যে ক্রমেই আরো বাড়বে এবং ভোটের বছরে এসে তা যে রীতিমতো হরিলুটে পরিণত হবে—সেটাই স্বাভাবিক।
পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের নামে সে হরিলুটের কাজটিই এখন ‘সম্মিলিত প্রয়াস’-এর আওতায় চতুর্দিকে ভয়ংকর গতিতে বেড়ে চলেছে। আর এ ধরনের প্রয়াসের ব্যাপক উপস্থিতির কথা তো পরিকল্পনামন্ত্রী আরো বহু আগেই প্রকাশ্যে নিশ্চিত করেছেন এ কথা জানিয়ে যে উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে দেশে এখন দুর্নীতির জোয়ার উঠেছে এবং সেসবের আওতায় দলবদ্ধ দুর্নীতি হচ্ছে (বণিক বার্তা, ১৩ জানুয়ারি ২০২১)।
এমন পরিস্থিতিতে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে মহালুটপাটের হাত থেকে রক্ষা করতে চাইলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে প্রকল্প অনুমোদনের ব্যাপারে আরো কঠোর হওয়া, যেখানে পরিকল্পনামন্ত্রী মহোদয়ের নিজেরও দায়িত্ব রয়েছে। মুখে ‘ভয়ংকর’ বলা হলো, কিন্তু ভয়ংকর সব প্রকল্প আবার অনুমোদনও পেয়ে গেল, তাহলে তো ওই সব মুখরোচক সত্য উচ্চারণ ও এ-সংক্রান্ত বাস্তব আচরণ পরস্পরবিরোধী হয়ে গেল! অন্যদিকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও সংস্থা থেকে এসব ভয়ংকর প্রকল্প যারা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠান, তাদেরও কি কোনো দায়দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা নেই?
যদি থাকে, তাহলে সীমাহীন সমন্বয়হীনতা ও অস্বচ্ছতায় ভরা এসব প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশন বা একনেক পর্যন্ত আসে কেমন করে? তাহলে কি এ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় না যে এসব প্রকল্প ঘিরে মন্ত্রণালয়গুলোর আওতায়ও দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতার ধারা বাধাহীনভাবে এগিয়ে চলেছে? আর এ বাধাহীনতা থেকে কি এটাও প্রতীয়মান হয় না যে রাষ্ট্রের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী নীতিনির্ধারকরা বিশেষ উদ্দেশ্যে অত্যন্ত সচেতনভাবেই এসব দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও লুটপাটকে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন? কিন্তু দুর্নীতিকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এভাবে প্রশ্রয় দেয়া, সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া এবং রাষ্ট্রের তথা জনগণের সম্পদকে এভাবে ওলটপালট করে খেতে দেয়ার অধিকার কি এ দেশের সংবিধান কাউকে দিয়েছে?
আপনার মতামত জানানঃ