রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ঘটা ‘বালিশ-কাণ্ড’র পর এবার স্বাস্থ্য প্রকল্পের প্রস্তাবে তেমনি আরেক কাণ্ড দেখা গেলো। একেকটা সাধারণ জিনিসের দাম ধরা হয়েছে আকাশছোঁয়া। যে দামের সাথে বাস্তবের যেমন কোনো মিল নেই, তেমনি নেই ভাবনাতেও।
স্বাস্থ্য প্রকল্পের প্রস্তাবে একেকটি পালস অক্সিমিটারের (শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা নিরূপণ যন্ত্র) দাম ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। যার বাজার মূল্য ১৫শ টাকা থেকে তিন হাজার টাকার মধ্যে। এছাড়া প্রতিটি ফেসমাস্কের দাম ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৬০০ টাকা, যার বাজার দর ৫ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে। এছাড়া আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধরা হয়েছে অস্বাভাবিক দাম।
‘কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাবে এমন আকাশছোঁয়া দাম প্রস্তাব করা হয়।
জানা যায়, মূল প্রকল্পে না থাকলেও প্রথম সংশোধনী প্রস্তাবে দুটি পালস অক্সিমিটার (এফডিএ অনুমোদিত) কেনার জন্য বরাদ্দ রাখা হয় ২ লাখ টাকা। প্রতিটির মূল্য ধরা হয় ১ লাখ টাকা করে। এখন দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাবে একেকটি অক্সিমিটারের দাম ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা করে ধরে দুটির জন্য বরাদ্দ চাওয়া হয় ৫ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধি পায় ৩ লাখ টাকা। অথচ অনলাইন মার্কেট প্লেস আলিবাবাতে চায়নার তৈরি একেকটি অক্সিমিটার পাওয়া যাচ্ছে ২ থেকে ১৬ ডলারের মধ্যে। এ হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে) দাঁড়ায় ১৭০ থেকে ১ হাজার ৩৬০ টাকা। এছাড়া অপর মার্কেট প্লেস দারাজে ১ হাজার ৫৫০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকার মধ্যে অক্সিমিটার পাওয়া যাচ্ছে। এর সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৭ শতাংশ ট্যাক্স, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স এবং সরবরাহকারীর লাভ যোগ করলেও কখনই সাড়ে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকার বেশি হওয়ার কথা নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়া মূল অনুমোদিত প্রকল্পে অ্যানেসথেশিয়া বিভাগের জন্য ১১টি পালস অক্সিমিটারের দাম ধরা হয়েছিল প্রতিটি ৮৩ হাজার ১৬০ টাকা। এ হিসাবে মোট বরাদ্দ ধরা হয় ৯ লাখ ১৪ হাজার ৭৬০ টাকা। প্রথম সংশোধিত প্রস্তাবে ১১টির জন্য একেকটির দাম ধরা হয় ৮৫ হাজার টাকা করে মোট ৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। সর্বশেষ দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাবে ওই ১১টির জন্য প্রতিটির দামের প্রস্তাব করা হয় ২ লাখ ২১ হাজার টাকা করে মোট ২৪ লাখ ৩১ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে প্রথম সংশোধনীর তুলনায় বৃদ্ধি পায় ১৪ লাখ ৯৬ হাজার টাকা।
এর বাইরে মূল অনুমোদিত প্রকল্পে না থাকলেও ডিপিপির (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) আরেক স্থানে প্রথম সংশোধনীতে দুটি অক্সিমিটারের দাম ধরা হয় ১০ লাখ টাকা। দ্বিতীয় সংশোধনীতে এসে ১০টি অক্সিমিটারের জন্য প্রস্তাব করা হয় ৯ লাখ টাকা।
এছাড়া অ্যানেসথেশিয়া বিভাগের জন্য মূল প্রকল্পে ৪০টি ফেসমাস্কের (১-৫ আকারের) দাম ধরা হয়েছিল প্রতিটি ১ লাখ টাকা করে ৪০ লাখ টাকা। পরে প্রথম সংশোধনীতে এসে ব্যয় কমিয়ে ৪০টি মাস্কের জন্য ধরা হয় প্রতিটির জন্য ৬ হাজার টাকা করে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এখন দ্বিতীয় সংশোধনীতে এতে ধরা হয় ৪০টির জন্য প্রতিটি ১৫ হাজার ৬০০ টাকা করে ৬ লাখ ২৪ হাজার টাকা। কিন্তু বাজারে ৫ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে।
এদিকে রাজস্ব খাতে আরও কিছু ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক ব্যয় ধরা হয়। এর মধ্যে- প্রথম সংশোধনী প্রস্তাবে রেজিস্ট্রেশন খাতে বরাদ্দ ছিল ৬ লাখ টাকা। সেটি বাড়িয়ে দ্বিতীয় সংশোধনীতে প্রস্তাব করা হয় ১ কোটি ১০ লাখ টাকা। মুদ্রণ ও বাঁধাই অঙ্গে ৩ লাখ টাকার স্থলে ধরা হয় ১৫ লাখ টাকা।
স্টেশনারি অঙ্গে ৬ লাখ টাকার স্থলে ধরা হয় ১২ লাখ ১৮ হাজার টাকা। ভ্রমণ অঙ্গে ৮ লাখ টাকার স্থলে ২০ লাখ টাকা।
এক্ষেত্রে প্রকল্প প্রস্তাবটির ওপর গত ২৬ আগস্ট অনুষ্ঠিত পিইসি সভায় পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, এসব খাতে অস্বাভাবিক অর্থ সংস্থান বৃদ্ধি করা হয়েছে। তাই এসব অঙ্গের ব্যয় যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করতে হবে। সেই সঙ্গে অন্যান্য মনিহারি ক্রয় বাবদ ৪০ লাখ টাকার প্রস্তাব বাদ দিতে হবে। এছাড়া প্রচার ও বিজ্ঞাপন খাতে ৪০ লাখ টাকা, সাধারণ সরবরাহ খাতে ১৪ লাখ টাকা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা খাতে ১৩ লাখ ৪০ হাজার টাকার বরাদ্দ যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করতে হবে।
চিকিৎসা শিক্ষা এবং কুষ্টিয়া ও এর আশপাশের অঞ্চলের মানুষকে আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করতে ২০১২ সালে মেডিকেল কলেজ স্থাপনের প্রকল্প নেয় সরকার। কিন্তু প্রকল্পটি অনুমোদনের আগে কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। এমনকি তখন পর্যন্ত কোনো জমিও নির্বাচন করা হয়নি বলে গত বছরের জুনে আইএমইডির প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে।
প্রকল্পটির ব্যয় বাড়ানো ছাড়াই দুই ধাপে এর সময়সীমা বাড়িয়ে ২০১৬ সাল পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু ২০১৮ সালে প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনীতে সময়সীমা বাড়িয়ে ২০১৯ করার পাশাপাশি ব্যয়ও বাড়িয়ে ৬১১ দশমিক ০৮ কোটি করা হয়।
২০১৯ সালে এসে প্রকল্পটির ৩৪ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়। প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনী এক বছর ধরে আটকে থাকায় প্রকল্পের কাজও থমকে আছে। আইএমইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, কেবল ভবন নির্মাণই অসম্পূর্ণ থাকেনি, পাশাপাশি কিছু ভবনের দরপত্রের কাজও শেষ হয়নি।
‘শুরু থেকেই অব্যবস্থাপনা পাওয়া গেছে’ উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৭১টি প্যাকেজের আওতায় সবগুলো অবকাঠামো নির্মাণ করার কথা থাকলেও কেবল চারটি প্যাকেজের আওতায় একটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। যার ফলে সময় ও অর্থ অপচয় হয়েছিল উল্লেখ করে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পের কাজগুলো ছোট ছোট প্যাকেজে ভাগ করায় বড় ঠিকাদাররা এতে তেমন আগ্রহ দেখায়নি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রকল্প কর্তৃপক্ষ ২০০৮ সালের পরিবর্তে ২০১১ সালের হার অনুযায়ী দরপত্র আহ্বান করেছে। যার ফলে জটিলতা আরও বেড়েছে।
২০১২ সাল থেকেই মেডিকেল কলেজটিতে প্রতিবছর ৫০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। কোনো ধরনের যন্ত্রপাতি ছাড়াই অন্য একটি ভবনে এর অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চলছে। ভবন নির্মাণের কাজ শেষ না হওয়ায় এখনো হাসপাতাল বা চিকিৎসা জন্য কোনো ধরনের যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা যায়নি।
২০১৮ সালের ২১ জুন প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনী অনুমোদন দেওয়ার সময় উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) উল্লেখিত ‘কাজের সুযোগ’ পরিবর্তন এবং আর্থিক-পরিকল্পনাগত শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে যারা অনিয়মত করেছে, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিল একনেক।
তবে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এসব অনিয়মের পরিপ্রেক্ষিতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? আইএমইডির প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে একজন সাংবাদিক তা জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের (আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগ) সদস্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, প্রতিবেদনের আলোকে চাকরিচ্যুত করাসহ নানা ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং প্রকল্পটি পুনরায় ঢেলে সাজানো হয়েছে।
‘তবে, প্রকল্পের ক্রুটিগুলো এখনো রয়ে গেছে’, বলেও জানান তিনি।
আইএমইডি তাদের প্রতিবেদনে অদক্ষ ঠিকাদার ও কাজের প্রতি অবহেলাসহ ২৫টি ক্রুটির কথা উল্লেখ করেছে। একটি ভবন নির্মাণে রডের পরিবর্তে বাঁশ ও কাঠ ব্যবহারের কথাও উঠে আসে প্রতিবেদনে। ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি ভবনের একটি অংশ ধসে পড়ে। এতে এক শ্রমিক নিহত ও ১০ জন আহত হন।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দায়ী ঠিকাদারকে পরবর্তী দুই বছর গণপূর্ত বিভাগের নিলাম প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া সত্ত্বেও প্রকল্পটির কাজ অব্যাহত ছিল এবং দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্যেও কেউ দায়বদ্ধ ছিল না।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, দেশের যেকোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা নিজেদের দুর্নীতি করার সুযোগ রাখার জন্যই এমন কাণ্ড ঘটিয়ে থাকেন। এটা যে লোকচক্ষুর আড়ালেই করে থাকেন তেমনও না। বিভিন্ন প্রকল্প এমনই বিধায় তারাও তেমন করে দাম নির্ধারণ করে প্রস্তাব দেন। কিন্তু এতো এতো অসামঞ্জস্য থাকা স্বত্বেও প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পাঠানো থেকেই ধারণা করা যায় তাদের নিকট এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এক্ষেত্রে সরকারের নজরদারির অভাব রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। একইসাথে সরকার সংশ্লিষ্ট লোকদের বিশাল সুবিধার কথা মাথায় রেখে এমন হরিলুট সম্পন্ন প্রস্তাব তৈরী হয় বলেও জানান তারা। তবে আশার খবর হলো, একনেক এবং প্রধানমন্ত্রী এমন প্রস্তাবে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রত্যাখ্যাত করেন। তবে বিভিন্ন প্রকল্পে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের অংশ না দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের যে সমস্যার সৃষ্টি হয়, সেদিকেও প্রধানমন্ত্রীকে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান তারা।
এসডাব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০৫
আপনার মতামত জানানঃ