আমাদের জানা মহাবিশ্ব ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে একটি সিঙ্গুলারিটি বিন্দু থেকে শুরু হয়েছিল। ঐ বিন্দু থেকে বিস্ফোরণের পর প্রসারণের মাধ্যমে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর সময় পেরিয়ে আজকের এই অবস্থানে এসেছে। এটিই বিগ ব্যাং বা বৃহৎ বিস্ফোরণ তত্ত্ব নামে পরিচিত।
বিগ ব্যাং তত্ত্ব প্রদান করার পর থেকে মহাবিশ্বকে ভালোভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারছিল। এবং এর সত্যতার পেছনে সমর্থন দেবার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য-প্রমাণও আছে। তবে প্রচুর তথ্য-প্রমাণ ও সমর্থন থাকলেও তা সকল প্রশ্ন বা সমস্যার সমাধান দিতে পারে না। যেমন মহাবিশ্বের একদম প্রাথমিক পর্যায়ে অতিছোট বিন্দুবৎ অবস্থায় থাকার সময়ের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না বিগ ব্যাং তত্ত্বের মাধ্যমে।
তবু, মহাবিশ্ব কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে বিগ ব্যাংই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জোরালো তত্ত্ব। এ তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রায় ১ হাজার ৩৮০ কোটি বছর আছে এক মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে এ মহাবিশ্ব যাত্রা করে। সেখান থেকে ধীরে ধীরে নানা গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ ইত্যাদি জন্ম নিচ্ছে। অর্থাৎ মহাবিশ্ব ক্রমে বিকাশমান।
কিন্তু বিজ্ঞানীদের ছোট একটি অংশ প্রায় ৩০ বছর ধরে বলতে চেষ্টা করছেন, বিগ ব্যাং নামে আদৌ কিছু ঘটেছিল কি না তা যথেষ্ট সন্দেহজনক। কারণ মহাবিশ্ব বিশ্লেষণ করা বা বোঝার জন্য বিগ ব্যাং যথেষ্ট সহায়ক নয়। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাধা।
২০২১ সালে মহাকাশে হাবলের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। এটা এমন সব তথ্য ও ছবি পাঠাচ্ছে, যা মহাবিশ্ব সম্পর্কে বিজ্ঞানী ও সাধারণ মানুষের বদ্ধমূল ধারণ বদলে দিচ্ছে।
এ অবস্থায় গত সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্ক টাইমসে বিগ ব্যাং ‘বিরোধী’ হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের দুই পদার্থবিজ্ঞানী অ্যাডাম ফ্রাঙ্ক ও মার্সেলো গ্লেজার ‘দ্য স্টোরি অব আওয়ার ইউনিভার্স মে বি স্টার্টিং টু আনর্যাভেল’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন।
প্রবন্ধে তারা দাবি করেন, জেমস ওয়েব আমাদের যেসব তথ্য দিচ্ছে তাতে মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করার জন্য বিগ ব্যাংয়ের মতো ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেলের’ কোনো দরকার নেই। আরেকটু উঁচু গলায় বললে বলতে হয়, স্ট্যান্ডার্ড মডেল বা বিগ ব্যাং তত্ত্ব বাতিল হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের একটা নতুন ‘ধারণা’ বা ‘তত্ত্বগত বিপ্লব’ জরুরি হয়ে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিশিষ্ট অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট ও প্লাজমা বিজ্ঞানী এরিক লার্নার বিগ ব্যাংয়ের অকার্যকারিতা ও মহাবিশ্বকে বোঝার নতুন পদ্ধতি নিয়ে ৯ সেপ্টেম্বর এশিয়া টাইমসের সঙ্গে কথা বলেছেন। ফ্রাঙ্ক ও গ্লেজারের সাম্প্রতিক প্রবন্ধের সূত্র ধরে লার্নারও প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন।
লার্নার বলেন, বিগ ব্যাংয়ের স্ট্যান্ডার্ড মডেল থেকে আমাদের সম্পূর্ণ সরে দাঁড়াতে হবে। মহাবিশ্বের বিভিন্ন উপাদান নিয়ে চিন্তাপদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে। এমনকি স্পেস ও টাইম বা মহাশূন্য ও কাল নিয়েও আমাদের নতুন করে চিন্তা করতে হবে। এক কথায় মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের নতুন একটা গল্প শুরু থেকে আরম্ভ করতে হবে।
লার্নারের মতে মহাবিশ্বকে প্লাজমা কসমোলজি দিয়ে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। এ তত্ত্বের সারকথা, ল্যাবরেটরির বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমেই মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করা যায়। এর জন্য সময়ের উৎপত্তি, ডার্ক ম্যাটার বা ডার্ক এনার্জির মতো বিষয়গুলোর কোনো দরকার নেই।
কিন্তু মূলধারার পদার্থবিজ্ঞানীরা ফ্রাঙ্ক, গ্লেজার বা লার্নারদের কথাকে এখনও তেমন একটা পাত্তা দিচ্ছেন না। তাদের দাবি, সৃষ্টিতত্ত্ব অন্য বিজ্ঞান থেকে আলাদা।
তবে লার্নারের আশা, জেমস ওয়েবের তথ্য তাদের তত্ত্বের পক্ষেই যাবে। মহাবিশ্বের তত্ত্ব নিয়ে গবেষকদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যেও নতুন তর্কবিতর্ক শুরু হওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
আপনার মতামত জানানঃ