রাজধানীজুড়ে একের পর এক উড়ালসড়ক হয়েছে। কিন্তু যানজট কমাতে পারেনি কোনোটিই। সদ্য আংশিক চালু হওয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েও যানজট কমাতে পারেনি; বরং কিছু জায়গায় বেড়েছে।
জনগণের টাকায় এক্সপ্রেসওয়ে হলেও বড় অংশই তা ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে না। ধনী-গরিবের মধ্যে যে বৈষম্য, তা এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে আরও দৃশ্যমান করেছে।
আজ বুধবার ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) উদ্যোগে সমসাময়িক পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিশ্লেষণী এক অনুষ্ঠানে এসব কথা উঠে আসে। অনলাইনে ‘ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পরিকল্পনাগত পর্যালোচনা’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠান হয়।
আইপিডির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন। সেখানে তিনি বলেন, কাওলা অংশ থেকে ইন্দিরা রোড পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে চালু হয়েছে। এখানে ব্যক্তিগত গাড়িই চলছে বেশি। গণপরিবহন এখনো চলছে না। গণপরিবহন বা সাধারণ মানুষ নগর-পরিকল্পনায় গুরুত্ব পাচ্ছে কি না, সেটা একটা প্রশ্ন। আংশিক চালু হওয়ায় এখন যেটা হয়েছে, সেটা এক্সপ্রেসওয়ে বলা যায় না। এখন এটাকে উড়ালসড়কই বলা যায়।
বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় উড়ালসড়কের নিচের সড়ক, রেলব্যবস্থারও উন্নয়ন হয়। কিন্তু এখানে বিপরীতটাই দেখা যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন আদিল মুহাম্মদ। তিনি মেয়র হানিফ উড়ালসড়কের উদাহরণ টেনে বলেন, সেখানে নিচের সড়কের অবস্থা খারাপ। যদি নিচের রাস্তা ভালো থাকে, তাহলে টোল দিয়ে অনেকেই উড়ালসড়কে উঠবেন না। তাই রাস্তা সংস্কারে কোনো উদ্যোগ নেই।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কারণে ধনী-গরিবের বৈষম্য আরও স্পষ্ট হয়েছে উল্লেখ করে আদিল মুহাম্মদ বলেন, ওপরতলার মানুষ ১০ মিনিটে ফার্মগেট বা কাওলা চলে যাচ্ছেন। আর নিচতলার সাধারণ মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকছেন।
ওপরতলার মানুষের আপাত সুবিধার কারণে র্যাম্পগুলোতে যে যানজট তৈরি হচ্ছে, সেটার ফলাফল নিচতলার মানুষ ভোগ করবেন। তিনি আরও বলেন, আগে বৈষম্য থাকলেও এখন ওপরতলা আর নিচতলার যোগাযোগ-বৈষম্য দৃশ্যমান হয়েছে। মানুষের ভেতরে এটা ক্ষোভের জন্ম দেবে।
তিনি মনে করেন, গণপরিবহন বাড়িয়ে ব্যক্তিগত গাড়ির নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই যানজট নিয়ন্ত্রণে আসবে। কারণ, ব্যক্তিগত গাড়ি শহরের অধিকাংশ রাস্তা দখল করে থাকে।
আলোচকেরা জানান, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পুরোপুরি চালু হলেও একাধিক জায়গায় র্যাম্প থাকার কারণে যানজট তৈরি হবে। এটা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) তৈরি হচ্ছে। বেসরকারি বিনিয়োগ থাকলেও দিন শেষে জনসাধারণকেই পরোক্ষভাবে ঋণ শোধ করতে হয়।
কিন্তু সর্বসাধারণের চলাচলের সুযোগ এখনো নেই। এ ছাড়া বক্তারা বলেন, এক্সপ্রেসওয়েতে যদি এমন হতো যে বিআরটি সেবা ওপর দিয়ে চলবে এবং ব্যক্তিগত গাড়ি নিচ দিয়ে চলবে, তাহলে গণপরিবহন প্রাধান্য পেত এবং ব্যক্তিগত গাড়ির লোকজন গণপরিবহন ব্যবহারের দিকে ঝুঁকতেন। ব্যক্তিগত গাড়িকে নিরুৎসাহিত করে গণপরিবহনবান্ধব ব্যবস্থা করাই পরিবহনব্যবস্থার মূল সূত্র।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফরহাদুর রেজা বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন ছিল। কলম্বিয়ার মেডেলিন শহরের উদাহরণ টেনে বলেন, গত দুই দশকে সেখানে পরিবহনব্যবস্থার অনেক উন্নয়ন হয়েছে। কারণ, সেখানে গণপরিবহনকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
আইপিডির উপদেষ্টা আকতার মাহমুদ বলেন, এক্সপ্রেসওয়ে চালুর পর সন্ধ্যার পর থেকে বিমানবন্দরের সামনে থেকে শুরু করে যে যানজট তৈরি হয়, তা ৩০০ ফিট, প্রগতি সরণি ও বনানীতেও চলে যায়। এই সমস্যার কথা আগেই বলা হয়েছিল। চারটি রুটের গাড়িগুলো খুব দ্রুত নেমে যাচ্ছে এয়ারপোর্ট সড়কে। তারপরই যানজটে পড়ে। একই অবস্থা হয় ইন্দিরা রোডের দিকটাতেও।
কোনো প্রকল্প নেওয়ার আগে সব ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রয়োজন বলে জানান পরিবহন ও যোগাযোগ-বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ নুরুল হাসান। তিনি বলেন, চট্টগ্রামেও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হচ্ছে। কিন্তু চট্টগ্রামের মহাপরিকল্পনায় এটা ছিল না। এখনকার প্রকল্পগুলো প্রয়োজনের চেয়ে ইচ্ছার ভিত্তিতে বেশি হচ্ছে। গণতান্ত্রিক দেশে যা হওয়ার কথা নয়।
বড় বড় প্রকল্প হলেও গণপরিবহন উন্নত হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন ওয়ার্ক ফর আ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের পরিচালক গাউস পিয়ারী। কোনো প্রকল্প করার আগে সড়কে নিরাপদে হাঁটার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয় কি না, সেই প্রশ্ন তোলেন তিনি। শহরটাকে অনেক বেশি যান্ত্রিক করে তোলা হয়েছে।
আলোচনায় আরও অংশ নেন আইপিডির পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম এবং যোগাযোগ-বিশেষজ্ঞ আফসানা হক।
আপনার মতামত জানানঃ